বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী এই মুহূর্তে দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী দেশ কাতার। বিপুল প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের ভাণ্ডার রয়েছে উপসাগরীয় এই দেশটির মাটির নিচে। প্রতি বছর বেকার সমস্যায় জেরবার জনবহুল দেশগুলি থেকে দলে দলে শ্রমিক পাড়ি দেন কাতারে– রোজগারের খোঁজে। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত হয়েছে এক ভয়ঙ্কর তথ্য। ‘মিডল ইস্ট আই’-এর রিপোর্ট উল্লেখ করে সেখানে বলা হয়েছে, কাতারে ২০১০ থেকে ‘২০– এই দশ বছরে মারা গেছেন ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা আর নেপাল থেকে কাজ করতে যাওয়া ৬৭৫০ জন শ্রমিক। আফ্রিকা ও এশিয়ার অন্যান্য দেশের মৃত শ্রমিকদের সংখ্যা এতে ধরা হয়নি।
২০২২-এ ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা কাতারে। সেই উপলক্ষে সেখানে নানা ধরনের কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। দলে দলে কাতারে গেছেন এশিয়া ও আফ্রিকার লক্ষ লক্ষ ঠিকা শ্রমিক। রোজগারের আশায় পরিবার-পরিজন ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে কাতারে ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজে যোগ দেন এঁরা। কাতার সরকারের দায়িত্ব, দেশে কাজ করতে আসা এই শ্রমিকদের শ্রম-অধিকার ঠিকমতো রক্ষিত হচ্ছে কিনা, বিদেশে এসে তাঁরা কোনও রকম সমস্যায় পড়ছেন কিনা, তা দেখা। অথচ পরিযায়ী শ্রমিকদের এত বেশি সংখ্যায় মৃত্যু দেখিয়ে দিচ্ছে, কাতার সরকারের চোখে তাঁদের জীবন নেহাতই মূল্যহীন।
এ নিয়ে বহু বার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অনেক শ্রমিক সংগঠন ও মানবাধিকার সংস্থা। কাতার সরকারের কাছে বারবার এই শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা, অসুস্থ হলে চিকিৎসা পাওয়া ও কাজের ক্ষেত্রে সুরক্ষার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করার দাবি উঠেছে। দাবি উঠেছে, শ্রমিকের আইনসঙ্গত অধিকারগুলি হরণ করছে যারা, সেইসব মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। কিন্তু কাতার সরকার কর্ণপাত করেনি। সে দেশে দীর্ঘদিন ধরে চালু থাকা ‘কাফালা ব্যবস্থা’য় এই সেদিন পর্যন্ত শ্রমিকদের দাস শ্রমিক হিসাবে গণ্য করা হত। বিশ্ব জুড়ে প্রতিবাদ ওঠায় ২০২০-র সেপ্টেম্বরে কাতার সরকার কাফালা ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু কম মজুরি, কাজের দীর্ঘ সময়, মজুরি দিতে দেরি, কাজের অসুরক্ষিত পরিবেশ ইত্যাদি যে সমস্যাগুলি শ্রমিকদের, বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে, সে ব্যাপারে কাতার সরকার মাথা ঘামাতে রাজি নয়।
শ্রমিকদের মৃত্যু নথিভুক্ত করার ক্ষেত্রে কাতার সরকারের চূড়ান্ত অনীহার কথা বলা হয়েছে এই রিপোর্টে। শুধু তাই নয়, মালিকের অবহেলায় যথাযথ সুরক্ষা না থাকা বা কাজের দুর্বিষহ পরিবেশের কারণে হওয়া এই মৃত্যুগুলিকে ‘স্বাভাবিক কারণে মৃত্যু’ বলে উল্লেখ করেছে কাতার প্রশাসন। মৃতদেহগুলির যথাযথ ময়নাতদন্ত না করে মৃত্যুর কারণ এমনভাবে দেখাচ্ছে যাতে আইনের প্যাঁচে পড়তে না হয়। কাতারে গ্রীষ্মকালের অত্যন্ত চড়া তাপমাত্রায় খোলা জায়গায় দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে গিয়ে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় বহু শ্রমিকের। এ ব্যাপারে আইএলও সহ শ্রমিক-সংগঠনগুলি বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও হেলদোল নেই। ফলে নিয়োগকারী ঠিকাদাররাও অবাধে চূড়ান্ত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে বাধ্য করে বিদেশ থেকে আসা শ্রমিকদের। শ্রমিক-মৃত্যু নিয়ে কাতার সরকারের এই অস্বচ্ছতা ও উদাসীনতার নিন্দা করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও।
পরিযায়ী শ্রমিকরা যে দেশের নাগরিক, বিদেশে কাজ করতে গিয়ে তাঁদের জীবনের সুরক্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে কিনা– তা দেখার দায়িত্ব শ্রমিকরা যে দেশের নাগরিক, সেখানকার সরকারেরও। কাতারে শ্রমিকদের এই মর্মান্তিক মৃত্যু প্রমাণ করছে, পাকিস্তান, বাংলাদেশ কিংবা নেপাল সরকারের মতো ভারত সরকারও বিদেশে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের ভাল-মন্দের বিষয়ে নিতান্তই উদাসীন।
অথচ এই শ্রমিকরাই প্রতিটি রাষ্ট্রের স্তম্ভস্বরূপ। এদের অমানুষিক পরিশ্রমের ওপরেই ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোটা সভ্যতা। এরাই গড়ে তোলে ধনকুবেরদের প্রাসাদ, ভরে তোলে মুনাফার সিন্দুক। কাতারে পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি সেখানকার সরকারের এই অমানবিক আচরণ আরও একবার দেখিয়ে দিল, পুঁজিবাদী দেশের সরকার আজ গরিব মেহনতি মানুষকে বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও দিতে রাজি নয়।
(তথ্যসূত্র : পিপলস ডিসপ্যাচ)