স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনার নবম খণ্ডে ‘স্বামী-শিষ্য সংবাদ’-এ আছে, বিবেকানন্দ শিষ্যদের নিয়ে বসে আছেন এক স্থানে। সেখানে গোরক্ষণী সভার কয়েকজন প্রচারক চাঁদা চাইতে গিয়েছেন। বিবেকানন্দ তাঁদের কাছে ‘উদ্দেশ্য’ জানতে চাইলে তারা জানান– দেশের গোমাতাকে কসাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করা। বিবেকানন্দ শুনে ওই প্রচারকদের জিজ্ঞসা করলেন, মধ্যভারতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে অসহায় মানুষে পাশে দাঁড়ানোর জন্য তাঁরা কিছু করেছেন কি না! প্রচারকরা জানান, দুর্ভিক্ষে সাহায্য করা তাঁদের কাজ নয়, গোমাতাদের রক্ষা করাই তাঁদের প্রধান কাজ।
বিবেকানন্দ উত্তরে বলেছিলেন–‘‘যে সভা-সমিতি মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে না, নিজের ভাই অনশনে মরছে দেখেও তার প্রাণরক্ষার জন্য একমুষ্ঠি অন্ন না দিয়ে পশুপক্ষী রক্ষার জন্য রাশি রাশি অন্ন বিতরণ করে, তাদের জন্য আমাদের সহানুভূতি নেই!” বিবেকানন্দের শ্লেষ আছড়ে পড়েছিল– ‘এমন মাতা না হলে এসব সন্তান প্রসব করেছেন কে?’
আধুনিক গো-রক্ষকরা বিবেকানন্দের এই বক্তব্য জানেন কি? যে বেদনা থেকে তাঁর এই মন্তব্য, তা উপলব্ধি করছেন কি? বর্তমান ভারত বিশ্বের ক্ষুধার্ত ১১৯টি দেশের মধ্যে ১০৩ নম্বরে, প্রতিদিন যেখানে ৭ হাজার মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, যেখানে প্রতিদিন ২৩ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। অথচ কেন্দে্রর ক্ষমতায় আসীন নেতারা এর প্রতিকারে কোনও চেষ্টা না করে হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলে গো-রক্ষা সাধনায় মেতেছে।
তবে সব গরুর প্রতি তাদের সমদৃষ্টি নেই। এখানেও বিভাজনের রাজনীতি। তাদের পক্ষপাতিত্ব শুধু দেশজ গরুর প্রতি। এখন বিজেপি উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সব কেন্দ্রগুলিতে দলীয় প্রভাব বিস্তার করেছে। এই রকম একটি সংস্থা দ্য ডিপার্টমেন্ট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ডিএসটি)-কে দিয়ে তারা প্রস্তাব করিয়েছে, দেশীয় গরু এবং তার থেকে প্রাপ্ত দ্রব্যগুলির বিশেষ গুণের উপর গবেষণায় জোর দিতে হবে। প্রস্তাবের মুখবন্ধে বলা হয়েছে বিভিন্ন রোগ যেমন ক্যানসার, ডায়াবেটিস, লিউকোডার্মা, আর্থারাইটিস চিকিৎসার ক্ষেত্রে দেশি গরু থেকে প্রাপ্ত দ্রব্যের কার্যকারিতা কতটা রয়েছে তা নিয়ে গবেষণা করতে হবে। যে পাঁচটি বিষয়ে গবেষণা করতে বলা হয়েছে, সেগুলি হল–দেশীয় গরুর স্বতন্ত্রতা, ঔষধ ও স্বাস্থে্যর ক্ষেত্রে গো-দ্রব্যের প্রয়োগ, কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োগ, খাদ্য ও পুষ্টিতে গো-দ্রব্যের ভূমিকা, গরুর জাত সংক্রান্ত আলোচনা।
কেন্দ্রীয় সরকারের ডিএসটি মন্ত্রক দাবি করেছে প্রাচীন আর্য়ুবেদিক সাহিত্যে দেশীয় গরু জাত দ্রব্যের ভেষজ গুণাবলির কথা নাকি বলা হয়েছে যা এই সমস্ত রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কাজে লাগত। প্রশ্ন হল, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, আর্থারাইটিসের মতো আধুনিক রোগের নাম কি প্রাচীন আর্য়ুবেদ শাস্তে্র বর্ণিত ছিল? ইতিহাস বলে, না, তা জানা ছিল না।
যখন সারা দেশে মৌলিক গবেষণা অর্থের অভাবে ধুঁকছে, গবেষণায় অর্থবরাদ্দ বৃদ্ধির দাবিতে বৈজ্ঞানিকেরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে সামিল হচ্ছেন তখন শুধুমাত্র ‘বিশ্বাসের’ উপর ভিত্তি করে এই ধরনের গবেষণার উদ্যোগ কেন? প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন দেশের বিজ্ঞানী মহল। ডিএসটির এই উদ্যোগকে ত্রুটিপূর্ণ এবং অবৈজ্ঞানিক বলে চিহ্নিত করে এই গবেষণার জন্য বরাদ্দ অর্থ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন দেশের ১১০ জনের বেশি বিজ্ঞানী।
তাঁরা লিখিতভাবে জানিয়েছেন–‘‘এই প্রস্তাবটি ভারতীয় বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ভীষণভাবে অধঃপতিত করবে, যেহেতু বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ ছাড়াই কেবলমাত্র ‘বিশ্বাসের’ উপর নির্ভর করে এই গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। বিজ্ঞান কখনও ‘বিশ্বাস’-কে স্বীকৃতি দেয় না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যে সত্য উদঘাটিত হয় তাকেই বিজ্ঞান গ্রহণ করে।
তা হলে এই ‘কাউপ্যাথির’ কী উদ্দেশ্য? আসলে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার বিজ্ঞান চর্চার জন্য সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজনীয়, সেই যুক্তিবাদী মননকে নানা ভাবে ধ্বংস করতে চাইছে। এমন সব বিষয়ে গবেষণার প্রস্তাব তারা দিচ্ছে যা শাসকদলের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এতে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী ভোটব্যাঙ্ক দৃঢ় হতে পারে, কিন্তু চরম ক্ষতি হবে বিজ্ঞানের, ক্ষতি হবে মানবসভ্যতার।