গুলাম মহম্মদ মির। শ্রীনগরের ৮৫ বছর বয়স্ক এই মানুষটি গত নভেম্বর মাসে মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরে এসেছেন। কাশ্মীরে এখন দিনে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ থাকে না। অথচ মহম্মদ মির একজন সিওপিডি রোগী। প্রায় সারাক্ষণই তাঁর অক্সিজেন লাগে। অক্সিজেন তৈরির মেশিন চালাতে বিদ্যুৎ প্রয়োজন। অবশ্য শুধু মিরই নন, কাশ্মীর জুড়ে এমন শত শত রোগী আছেন যাদের হয় সর্বক্ষণ, না হয় বেশির ভাগ সময় অক্সিজেন লাগে। এঁদের প্রায় সকলকেই নিজ খরচে চিকিৎসা চালাতে হয়। চেন্নাইয়ে ব্যবসা করা সামি মির হিন্দু পত্রিকার সংবাদিককে জানিয়েছেন, ‘ডাক্তারবাবু আমার বাবাকে সারাক্ষণ অক্সিজেন দিতে বলেছেন। আধঘণ্টার জন্যও অক্সিজেন বন্ধ হলে তাঁর মৃত্যু হবে। আমাদের একটি বিদ্যুৎচালিত অক্সিজেন তৈরির মেশিন আছে। কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহের এই দুরবস্থা যেন আমার বাবাকে সারাক্ষণ মৃত্যুভয় দেখিয়ে চলেছে। অনিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহের কারণে মাঝে মাঝেই আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি, এই বোধহয় বাবাকে হারালাম। বাবার জন্য নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে আমাকে প্রায়ই ব্যবসার কাজ ছেড়ে কাশ্মীরে ছুটে যেতে হয়।’ এমনই আর একজন সিওপিডি রোগী এম ওয়াই কুরেশিকে বিদ্যুতের অভাবের কারণে লালবাজারে তাঁর নিজের বাড়ি থেকে সরিয়ে জম্মুর সমতল এলকায়, যে এলাকাটা কাশ্মীরের থেকে কিছুটা বেশি গরম– নিয়ে গিয়ে রাখতে হয়েছে।
কাশ্মীরের জন্য বিদ্যুতের প্রয়োজন যেখানে ২ হাজার মেগাওয়াট, সেখানে নিয়মিত সরবরাহ রয়েছে ১২৫০ মেগাওয়াটের। এর মধ্যে কাশ্মীরে তৈরি হয় মাত্র ৫০-১০০ মেগাওয়াট। স্বাভাবিকভাবেই ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছাড়াই থাকতে হয় কাশ্মীরের নাগরিকদের।
২০১৯-এর ৫ আগস্ট কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, এতে কাশ্মীরের মানুষের সুবিধাই হবে। সরকার তাদের জন্য সমস্ত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করবে। কাশ্মীরের বেকারদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করবে সরকার। এই ধারা প্রত্যাহার করার ফলে কাশ্মীরে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ হবে, যা কাশ্মীরকে একটি শিল্প-সমৃদ্ধ রাজ্যে পরিণত করবে। কাশ্মীর থেকে সন্ত্রাসবাদ চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। মানুষ স্বাধীন ভাবে বসবাস করতে পারবে এবং এ রকম আরও অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।
তারপরে সাড়ে চার বছর পেরিয়ে গেছে। ঝিলম নদী দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। কী পেয়েছে কাশ্মীরের মানুষ? নূ্যনতম নাগরিক-প্রয়োজন বিদ্যুতের হাল আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ৪৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা করে বলেছিলেন, সবাই বিনিয়োগ করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। শুধুমাত্র ৩৭০ ধারার জন্যেই তা সম্ভব হচ্ছে না। এখন আর কোনও বাধাই রইল না। বাস্তবে কাশ্মীরে কত বিনিয়োগ হয়েছে? তথ্য বলছে, বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা। নামমাত্র। কোনও শিল্পপতি-পুঁজিপতি বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাননি।
সরকারি নিয়োগের প্রতিশ্রুতি সারা দেশের মতোই মিথ্যায় পর্যবসিত। সন্ত্রাসবাদ কিছুমাত্র কমেনি। বরং তাকে অজুহাত করেই জম্মু-কাশ্মীর আজ কার্যত এক সামরিক রাজ্যে পরিণত হয়েছে। গোটা কাশ্মীর আজ মিলিটারির বুটের তলায়। রাজনৈতিক কার্যকলাপ প্রায় বন্ধ। রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন চলছে ২০১৮ সাল থেকে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের অফিসগুলি তালাবন্ধ। তালাবন্ধ খবরের কাগজের অফিসে। অজস্র সাংবাদিক জেলে। অধিকাংশ সময়ই ইন্টারনেট বন্ধ। সংবাদ মানেই সরকারি বয়ান। মিলিটারি হামলায় সাধারণ মানুষ পাইকারি হারে গ্রেফতার হয়ে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। কেন গ্রেফতার, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, পরিবারের লোক কিছুই জানতে পারছেন না। মানবাধিকার সংগঠনের অস্তিত্ব মুছে ফেলা হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ কিছুমাত্র কমেনি। স্থানীয় নাগরিকরা তো বটেই, এমনকি পরিযায়ী শ্রমিকরা পর্যন্ত তার শিকার হচ্ছেন। ২০১৯ থেকে ৭৪ জন নিরাপত্তা রক্ষী খুন হয়েছেন। এরই পরিণামে সেখানকার সাধারণ মানুষের রুজিরোজগারের বলতে গেলে একমাত্র উৎস পর্যটন শিল্প মরতে বসেছে। মানুষের দুরবস্থা চরমে পৌঁছেছে।
বাস্তবে কাশ্মীর জুড়ে শান্তির দেখা মিলছে শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিজেপি নেতাদের বত্তৃতায়। সেই শান্তির রাজত্ব এমনই যে, ১১ ডিসেম্বর, যে দিন সুপ্রিম কোর্ট ৩৭০ রদকে বৈধ বলে ঘোষণা করল, সে দিন একদিকে গোটা কাশ্মীরকে সেনায় ছেয়ে ফেলা হয়েছিল, অন্য দিকে কাশ্মীরের বিরোধী নেতাদের সবাইকে গৃহবন্দি করে তাঁদের বাড়ির চার দিকে বিপুল সংখ্যায় সেনা মোতায়েন করে রাখা হয়েছিল। কাশ্মীরের জনগণের প্রাপ্তির আর কোনও খোঁজ বিজেপি নেতারা এখনও পর্যন্ত দিতে পারেননি। (সূত্রঃ দি হিন্দু, ১৬ ডিসেম্বর ’২৩)