‘জ্ঞান–বিজ্ঞান বিমুক্তয়ে’ অর্থাৎ জ্ঞানই মুক্ত করে৷ এ কথা লেখা রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি–র লোগোতে৷ অথচ সেই ইউজিসি–ই জ্ঞানচর্চার সুষ্ঠু পরিবেশকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে৷
ইউজিসি নির্দেশ জারি করেছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাজকর্ম অপছন্দ হলেও কোনও শিক্ষক সে সব নিয়ে কিছু বলতে তো পারবেনই না, এমনকী শিক্ষা সংক্রান্ত কোনও বিষয়ে প্রকাশ্যে কারও সঙ্গে আলোচনা করারও অধিকার থাকবে না তাঁদের৷ রাজনৈতিক কার্যকলাপ, ধর্মঘট থেকে দূরে থাকতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের৷ তাঁরা সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনও কিছু লিখতে পারবেন না৷ এমনকী পরিচয় গোপন করেও সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলতে পারবেন না৷ রাজনৈতিক বিষয়েও কিছু বলতে পারবেন না৷
মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর মুখে বলেছেন, ‘‘আমাদের সরকার শিক্ষকদের মতপ্রকাশের অধিকার মোটেই কেড়ে নিতে চায় না৷’’ অথচ ইউজিসি–র সাম্প্রতিক (অক্টোবর ২০১৮) ফর্মানের বয়ান এরকমই৷ কেন এরকম ফতোয়া? কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়্ শিক্ষকেরা সরকারের বিরুদ্ধে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারবেন না কেন?
শিক্ষাক্ষেত্র হল সভ্যতার হৃদপিন্ডের মতো৷ এ যদি অবিরত সচল–সক্রিয় না থাকে তা হলে সভ্যতার মৃত্যু অনিবার্য৷ মানুষ দীর্ঘকাল ধরে জীবনসংগ্রামের নানা উত্থান–পতনের পথ বেয়ে সাধারণ ভাবে যে ধারণা–অভিজ্ঞতা–অনুভূতি-উপলব্ধি অর্জন করে তারই পরীক্ষিত এবং বিশেষীকৃত রূপ হল শিক্ষা৷ এই শিক্ষার আলোয় আলোকিত না হলে কোনও মানুষের মানবসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ কখনই ঘটতে পারে না৷ তাই মানবতাবাদী চিন্তাবিদেরাও সকলেই চেয়েছেন সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দিতে৷ প্রত্যেকটি মানুষের বিকাশের পথ উন্মুক্ত করে দিতে৷ যাঁরা এই শিক্ষাবিস্তারের দায়িত্বে সরাসরি যুক্ত থাকবেন তাঁদের হাত–পা–চোখ–মুখ যদি বেঁধে রাখা হয়, তা হলে কার্যত সমাজের বিকাশের অন্যতম প্রধান রাস্তাটাই ধ্বংস করা হয়৷ বস্তুত মানুষের জ্ঞান অর্জনের সাধনার পদে পদে আছে প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এমনকী জেহাদের ইতিহাস৷ শিক্ষা অর্জনের অন্যতম প্রধান শর্ত হল অন্যায়কে জোর গলায় অন্যায় বলতে পারা৷ না হলে ন্যায়কে গ্রহণ করার মতো শক্তি তৈরিই হয় না৷ তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত মুক্তকণ্ঠে যে কোনও মতামত প্রকাশের অধিকার থাকা৷ অথচ ইউজিসি করছে তার বিপরীত কাজ৷
ভারতে স্বাধীনতার পর থেকে কংগ্রেসও বারবার এই ষড়যন্ত্র করেছে৷ সিপিএমও প্রকারান্তরে একই কাজ করেছে৷ পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার কেড়ে নিচ্ছে তাই নয়, একই স্বরে বলছে শিক্ষকরা কোনও বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবে না৷ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এমনও বলেছেন, আমরা শিক্ষকদের মাইনে দিই, ফলে আমাদের কথা শুনে চলতে হবে৷
আদতে একচেটিয়া পুঁজির মালিকশ্রেণির স্বার্থে জনগণের উপর অবাধ শাসন–শোষণ চালাতে সমস্ত ভোটবাজ ক্ষমতালোভী দলগুলোই এই কাজ করে৷ তাঁরা ক্ষমতার উদগ্র ঝাঁঝে অন্ধ এবং বধির হয়ে গেছেন৷ না হলে এটুকু তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারতেন, শিক্ষকদের গলা টিপে ধরে তাঁরা অপশাসনবিরোধী গণবিক্ষোভকে ঠেকিয়ে রাখতে কোনওমতেই পারবেন না৷ প্রগতিশীল শিক্ষানুরাগী মানুষ ইতিমধ্যেই বিজেপি–র এই আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন৷ শিক্ষাকে বাঁচানোর জন্যই এই প্রতিবাদের কণ্ঠস্বরকে আরও জোরালো করা দরকার৷
(৭১ বর্ষ ১২ সংখ্যা ২ – ৮ নভেম্বর, ২০১৮)