দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়া সাক্ষী থাকল এক ঐতিহাসিক জনবিক্ষোভের৷ ২১ নভেম্বর থেকে শুরু করে লাগাতার বিক্ষোভ দেখিয়ে চলেছেন কলম্বিয়ার মানুষ৷ দক্ষিণপন্থী প্রেসিডেন্ট ইভান দুকিউয়ের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন সেখানকার শিল্পী, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, মডেল, খেলোয়াড় থেকে শুরু করে সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষ৷ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে কলম্বিয়ার ছাত্রসমাজ৷ দেশ জুড়ে রাস্তায় রাস্তায়, চক–চৌরাস্তার মোড়ে, কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় মানুষ খালি হাতে, ঘর থেকে বাসনপত্র নিয়ে বাজাতে বাজাতে কিংবা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বেরিয়ে এসে সামিল হয়েছেন বিক্ষোভে৷
কেন তাঁরা রাজপথে? নয়া–উদারবাদী নীতির অনুগামী প্রেসিডেন্টের তথাকথিত আর্থিক সংস্কারের ধাক্কায় এমনিতেই মানুষের জীবনে গরিবি–বেকারির দুর্দশা বেড়েছে৷ এর ওপর বছর শেষ হওয়ার আগেই প্রেসিডেন্ট দেশের কর–কাঠামোর পরিবর্তন করতে চলেছেন৷ তাঁর সরকার কর্পোরেট পুঁজিপতিদের বিপুল কর ছাড় দিতে চায়, সুবিধা পাইয়ে দিতে চায় দেশের বৃহৎ ব্যবসায়ীদের৷ ফলস্বরূপ আরও ব্যাপক হবে মানুষে মানুষে আর্থিক বৈষম্য৷ হাতে গোনা পুঁজিমালিকদের স্বার্থে প্রেসিডেন্ট দুকিউ সরকারের এই জনবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষুব্ধ কলম্বিয়ার মানুষ সোচ্চার হয়েছেন প্রতিবাদে৷ গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও গণসংগঠনের প্ল্যাটফর্ম ‘ন্যাশনাল স্ট্রাইক কমিটি’৷ পাশাপাশি, তাঁরা চান সামাজিক আন্দোলনের অধিকার৷ কলম্বিয়া এমন একটি দেশ যেখানে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন কোনও নতুন কথা নয়৷ আন্দোলনকারীদের হামেশাই খুন বা অত্যাচারের শিকার হতে হয়৷ বহু ক্ষেত্রেই অপহরণের মতো ঘটনাও ঘটে৷ সেখানে আছে কুখ্যাত এক পুলিশবাহিনী– ‘মোবাইল অ্যান্টি–ডিস্টারবেন্সেস স্কোয়াড্রন’, স্প্যানিশ ভাষায় আদ্যক্ষর নিয়ে যার নাম ‘ইএসএমএডি’৷ এই বাহিনী বাতিল করার দাবি উঠেছে বিক্ষোভে৷ পাশাপাশি ছাত্রসমাজের দাবি, প্রতিশ্রুতিমতো প্রেসিডেন্টকে উচ্চশিক্ষায় সরকারি খরচ বাড়াতে হবে৷
২১ নভেম্বর বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর পরই কলম্বিয়ার পুলিশ নির্মম হাতে আন্দোলন দমনে নেমে পড়ে৷ ২৩ নভেম্বর ১৮ বছরের এক বিক্ষোভকারী ছাত্রের মৃত্যু হয়৷ উত্তাল হয়ে ওঠে আন্দোলন৷ পুলিশের নির্মম হামলা উপেক্ষা করে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে রাস্তায় নেমে লাগাতার বিক্ষোভ দেখান কলম্বিয়ার মানুষ৷ গত ১০ ডিসেম্বর রাতে কলম্বিয়ার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর পুলিশ বর্বর হামলা চালায়৷ দু’জন ছাত্রকে অপহরণ করে পুলিশের দালালরা গাড়িতে তুলে নেয়৷ আন্দোলনকারীরা গাড়িটির পিছু ধাওয়া করে ঘটনার ছবি তুলে রাখেন৷ শেষ পর্যন্ত একজন ছাত্রকে উদ্ধার করতে সমর্থ হন আন্দোলনকারীরা৷ মানবাধিকার কমিশনের তথ্য অনুযায়ী লাগাতার এই বিক্ষোভে চারশোরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন, গ্রেপ্তার হয়েছেন হাজারেরও বেশি৷ গত ১৬ ডিসেম্বরও দেশ জুড়ে বিক্ষোভের ডাক দেয় স্ট্রাইক কমিটি৷ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস নিয়ে হামলা চালায় পুলিশ৷ দাবি আদায়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ন্যাশনাল স্ট্রাইক কমিটি ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বিক্ষোভ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷
এক বিক্ষোভকারী জানিয়েছেন, শুরুতে সরকারবিরোধী ক্ষোভ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ জড়ো হয়েছিলেন আন্দোলনে৷ কিন্তু যত দিন গেছে, ততই সংগঠিত হয়েছেন তাঁরা৷ এলাকায় এলাকায় গণকমিটি গড়ে তুলেছেন৷ ফলে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে কলম্বিয়ার মানুষের পক্ষে৷ বাস্তবে অত্যাচারী শাসকের কাছ থেকে দাবি আদায়ের একমাত্র পথ সঠিক নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে অসংখ্য গণকমিটি গড়ে তুলে দেশজোড়া আন্দোলনের চাপ সৃষ্টি করা৷ কলম্বিয়ার সংগ্রামী মানুষ সেই পথ ধরেই চলেছেন৷