সম্প্রতি হরিয়ানার সুরজকুণ্ডে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের উপস্থিতিতে ‘চিন্তন শিবির’–এ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বন্দুকধারী মাওবাদীদের পাশাপাশি প্রতিবাদী কলমধারীদেরও নির্মূল করার কথা বলেছেন৷ বলেছেন, এইসব বিশিষ্ট জনেরা দেশের যুবসমাজকে বিভ্রান্ত এবং বিপথগামী করছেন৷ এর ফলে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হবে৷
এর আগেও প্রধানমন্ত্রী সরকারের সমালোচকদের টুকরে টুকরে গ্যাং, আন্দোলনজীবী, শহুরে নকশাল প্রভৃতি তকমা দিয়ে তাঁদের দমন করার কথা বলেছেন৷ এখন আবার কলমধারীদের কথা জোরের সঙ্গে বললেন এবং তা বললেন সব রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মুখ্যসচিব, ডিজিপি, গোয়েন্দাবাহিনীর শীর্ষকর্তা প্রভৃতি প্রশাসনের মাথাদের সঙ্গে বৈঠকে৷ ইঙ্গিত স্পষ্ট, শুধু কেন্দ্রীয় সরকারই নয়, রাজ্যগুলিও যেন একই ভাবে সমালোচকদের দমনের কাজে অগ্রসর হয়৷
প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ নাগরিক সমাজকে লক্ষ্য হিসাবে বেছে নিলেন কেন?
জাতীয় এবং আঞ্চলিক বুর্জোয়া–পেটিবুর্জোয়া দলগুলি যখন পুঁজির স্বার্থরক্ষায় পুঁজিপতি শ্রেণির সামনে নিজেদের আভূমি নত করে ফেলেছে তখন দেশে নাগরিক সমাজের ভূমিকাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে৷ দেশের মানুষ তাঁদের প্রতিবাদী ভূমিকা দেখেছে এনআরসি–সিএএ বিরোধী আন্দোলনে, দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনে৷ পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে প্রতিবাদী কৃষকদের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন সমাজের অগ্রণী এই অংশটি৷ কংগ্রেসের মনমোহন সিংহ সরকারের আমলে দুর্নীতিতে যখন সরকার ও প্রশাসন আকণ্ঠ ডুবে গিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে দিল্লিতে আন্না হাজারের আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল৷ আবার বিজেপি ঘনিষ্ঠ ধর্মোন্মাদদের হাতে প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী সাংবাদিকদের হত্যা ও গো–রক্ষার নামে সংঘবদ্ধ নরহত্যার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে খেতাব ও পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ধ্বনিত হয়েছিল শিল্পী–সাহিত্যিক–বুদ্ধ্ বলিষ্ঠ প্রতিবাদ৷ বিজেপি সরকারের আনা সর্বনাশা জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে এখন সারা ভারতের সবচেয়ে অগ্রণী শিক্ষাবিদ–বিজ্ঞানীরা রুখে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করেছেন, পথে নেমেছেন৷
কেন্দ্রের বিজেপি সরকার একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থরক্ষাকেই একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত করে একের পর এক বেপরোয়া পদক্ষেপ নিয়ে জনস্বার্থকে দুপায়ে মাড়িয়ে চলেছে৷ এক দিকে নিত্য–নতুন আইন এনে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলিকে তারা কেড়ে নিচ্ছে, অন্য দিকে দেশের অধিকাংশ সম্পদ, জনসাধারণের শ্রম ও অর্থে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প–কারখানা–সংস্থা সব কিছু নির্বিচারে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিচ্ছে৷ শ্রম–শোষণ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে৷ কর্মসঙ্কোচন মারাত্মক আকার নিয়েছে৷ এই নীতির ফল হিসাবেই একচেটিয়া পুঁজির মুনাফা আজ আকাশ ছুঁয়েছে৷ স্বাভাবিক ভাবেই কৃষক–শ্রমিক–কর্মচারী-সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বারুদের মতো জমা হচ্ছে৷ কিন্তু সরকারি ক্ষমতায় থাকা কিংবা ক্ষমতা দখলের আশায় থাকা বিরোধী দলগুলি পুঁজির স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে শোষিত মানুষের পক্ষে কোনও আন্দোলন গড়ে তুলতে রাজি নয়৷ নরেন্দ্র মোদিরা তাঁদের আগ্রাসী মেরুকরণের রাজনীতির মধ্যে বিরোধী রাজনীতির বড় অংশকেই যুক্ত করে ফেলেছেন৷ রাহুল গান্ধী থেকে অরবিন্দ কেজরিওয়াল সবাই ছুটছেন মন্দিরে মন্দিরে৷ কেউ হনুমান মন্ত্র জপ করছেন তো কেউ পৈতে বের করে ব্রাহ্মণত্বের প্রমাণ দিচ্ছেন৷
তবুও শাসক বিজেপি জানে, প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি যতই পুঁজির দাসত্ব করুক, সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বারুদে যে–কোনও সময় আগুন লাগতে পারে৷ সরকার জানে, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংসৃক্তির ক্ষেত্রে তারা যে স্বৈরাচারী আক্রমণ নামিয়ে আনছে তার বিরুদ্ধে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের পাশাপাশি চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবীদের শক্তি যুক্ত হলে প্রতিবাদের শক্তি বেড়ে যাবে বহুগুণ৷ দেশজুড়ে এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে৷ তাই উদ্বিগ্ণ শাসক শ্রেণির লক্ষ্য চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবী তথা নাগরিকদের এই ভূমিকাকে দমন করা৷ আর জনচক্ষে সেই দমন–পীড়নকে ন্যায্য প্রতিপন্ন করতে হলে তাঁদের গায়ে দেশবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী, সমাজে বিকৃত মানসিকতা সৃষ্টিকারী প্রভৃতি যে কোনও একটা তকমা লাগিয়ে দেওয়া দরকার৷ তাই যে মাওবাদীদের অস্তিত্ব সারা ভারতে নগন্য, সেই মাওবাদী আতঙ্কের ভূতই তাঁরা বারবার ঝুলি থেকে বের করেন এবং সরকারের যে কোনও সমালোচকের গায়ে সেই তকমা লাগিয়ে দিতে চান৷ এবারও বিরোধী মতকে স্তব্ধ করতে প্রধানমন্ত্রী সেই নিদানই হেঁকেছেন৷
অবশ্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই প্রথম নন, এ জিনিস অতীতেও বারবার দেখা গেছে৷ কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করার সময়ে নাগরিক সংগঠনগুলিকে বিদেশি শক্তির মদত জোগানোর অভিযোগ করতেন৷ একদা মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও নন্দীগ্রামে কৃষকদের প্রতিবাদ আন্দোলন দমন করতে ‘আন্দোলনে মাওবাদীরা আছে’ বলে মিথ্যা প্রচার করেছিলেন৷
বাস্তবিক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বুদ্ধিজীবীদের, চিন্তাশীল নাগরিকদের প্রতি সরাসরি হুমকি ছাড়া কিছু নয়৷ একই সঙ্গে এই হুমকি দেশের সচেতন প্রত্যেক নাগরিকের প্রতি– বেশি ভেবো না, বেশি বোলো না, বেশি প্রতিবাদ কোরো না৷ করলেই দেশদ্রোহী কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহী তকমা লাগিয়ে জেলে ভরে দেবো৷ আমার হাতে পুলিশ–প্রশাসন–গোয়েন্দা, সামরিক–আধাসামরিক বাহিনী রয়েছে৷ এমনকি কোর্টের রায়ও আমি প্রভাবিত করতে পারি (বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীদের মুক্তি)৷ এই শাসকরা আজ সরকার বিরোধিতাকেই দেশবিরোধিতা প্রতিপন্ন করছে৷
দেশে পুঁজির মারাত্মক কেন্দ্রীভবন ঘটেছে৷ এক শতাংশ পুঁজিপতির হাতে কুক্ষিগত হয়েছে দেশের ৭০ শতাংশ সম্পদ৷ স্বাভাবিক ভাবেই রাষ্ট্রও আরও বেশি করে পুঁজির লেজুড়বৃত্তি করছে৷ একচেটিয়া পুঁজিই সংসদীয় দলগুলির খরচ জোগাচ্ছে৷ তাই কোথায় কারা সরকারে থাকবে, কারা মন্ত্রী হবে, কোন দপ্তরের মন্ত্রী হবে সবই পুঁজিমালিকরা ঠিক করে দিচ্ছে৷ লোকসভা আর বিধানসভা আজ জনসাধারণকে প্রতারণার মঞ্চে পরিণত হয়েছে৷ সেখানে যে সব আইন তৈরি হয় তা পুঁজির স্বার্থকে নিশ্চিত করতেই৷ এই অবস্থায় ক্রমাগত প্রচারের দ্বারা তারা প্রতিপন্ন করতে চায়– পুঁজির স্বার্থ, পুঁজিপতিদের স্বার্থ মানেই দেশের স্বার্থ, পুঁজিপতিদের পুঁজির বৃদ্ধি মানেই দেশের সমৃদ্ধি– তা দেশের শ্রমিক কৃষক সাধারণ মানুষের জীবনের বিনিময়ে হলেও৷
কিন্তু শাসকরা এ–ও জানে, শোষণে জর্জরিত দেশের শ্রমিক–কৃষক–সাধার্ মানুষ মিথ্যার আড়ালে থাকা সত্যকে ঠিকই খুঁজে বের করবে৷ সে ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের, সমাজের চিন্তাশীল মানুষদের ভূমিকাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ তাই শাসকদের ভয় কলমকে, ভয় যুক্তিকে, ভয় নতুন ভাবনাকে, স্বাধীন চিন্তাকে৷ সেই স্বাধীন চিন্তাকে দমন করার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর নিত্য–নতুন নিদান৷
আসলে শাসকদের দরকার বুদ্ধিজীবীর নামে একান্ত অনুগত একদল বিচার–বুদ্ধিহীন স্তাবক তৈরি করা, যারা সহজেই ক্ষমতার দাসত্ব মেনে নেবে৷ বুদ্ধিজীবী, শিল্পী–সাহিত্যিকরা যতক্ষণ জনবিচ্ছিন্ন তথাকথিত বিশুদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করেন ততক্ষণ শাসকের অসুবিধা থাকে না৷ তাদের পুরস্কার দিয়ে, নানা আনুকুল্য দিয়ে ভরিয়ে রাখে তারা৷ কিন্তু সাধারণ মানুষের লড়াই–আন্দোলনের পাশে দাঁড়ালেই বুদ্ধিজীবীরা দেশের শত্রু বনে যান৷ তাই সামগ্রিক ভাবে সমস্ত সচেতন নাগরিকই প্রধানমন্ত্রীর এই আক্রমণের লক্ষ্য৷