২৪ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে৷ বি এ–বি এস সি অনার্স, জেনারেল, মেজর কোর্সের প্রকাশিত ফলে পাশের হার কমেছে ব্যাপক ভাবে৷ বি এ–তে প্রায় ৬৪ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ২৮ হাজার৷ পাশের হার ৪৩ শতাংশ যা গতবার ছিল ৭৫ শতাংশ, বি এস সি–তে পরীক্ষার্থী ছিল প্রায় ১৫ হাজার যার মধ্যে পাশ করেছে ১১ হাজার৷ পাশের হার ৭১ শতাংশ যা গতবার ছিল ৮৫ শতাংশ৷ সব মিলিয়ে এবার পাশ করেছে ৪৩.৯ শতাংশ ছাত্রছাত্রী৷ অকৃতকার্যের সংখ্যা ৫৭ শতাংশ৷ তাই রেকর্ড সংখ্যক ফেলের ঘটনায় ছাত্র–শিক্ষক–অভিভাবক সহ শিক্ষামহল বিস্মিত৷ ইতিমধ্যেই এই অপ্রত্যাশিত ফলে মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে নিউ আলিপুর কলেজের প্রাণীবিদ্যার এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছেন৷ স্বাভাবিক কারণেই ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন৷
কিন্তু রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী রেজাল্ট বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধান না করে ছাত্রছাত্রীদের ঘাড়েই দোষ চাপিয়ে বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করে চলেছেন–‘পরীক্ষার্থীরা ফেলও করবে, আবার আন্দোলনও করবে’? কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ফলাফলের মূল্যায়নে নতুন নিয়মের জন্যই এই বিপর্যয় ঘটেছে– যে কথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও স্বীকার করেছে৷
এই নতুন নিয়ম কী? আগে নিয়ম ছিল প্রথম বর্ষের একজন অনার্সের ছাত্র অনার্সের বিষয়টিতে পাশ করলেই দ্বিতীয় বর্ষে যাওয়ার সুযোগ পেত, পাশের দুটি বিষয়ে পাশ না করলেও৷ সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় বর্ষে গিয়ে সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষার মাধ্যমে ওই দু’টি বিষয়ে পাশ করতে হত৷ আবার পাশ কোর্সের একজন ছাত্রের ক্ষেত্রে তার তিনটি বিষয়ের মধ্যে কোনও একটিতে পাশ করলেই সে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সুযোগ পেত৷ বাকি দু’টি বিষয়ে সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হত৷
এবার এই নিয়ম বদল করে অনার্সের ক্ষেত্রে অনার্সের সাথে অন্তত একটি পাশের বিষয়েও পাশ করতে হবে, আর পাশ কোর্সের ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে অন্তত দু’টি বিষয়ে পাশ করতেই হবে এই নিয়ম চালু করা হয়েছে৷ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, এই নতুন নিয়ম সম্পর্কে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দেড় শতাধিক কলেজের ছাত্রছাত্রীরা তো দূরের কথা অনেক কলেজের কর্তৃপক্ষ এমনকী অধ্যক্ষদেরও আগে থেকে জানানো হয়নি৷ মূল্যায়ন পদ্ধতিতে এমন একটা পরিবর্তন তো পঠন–পাঠন–পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত সকলের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে করা উচিত ছিল এবং শিক্ষাবর্ষের শুরু থেকে নোটিশ দিয়ে জানানো দরকার ছিল শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইটে দিয়েই কি দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? এটা কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিপনার পরিচয় নয় কি? কিন্তু যে প্রশ্নটি আজও জরুরি– বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী একাধিক পেপারে পাশ নম্বরটুকু তোলার মতো ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি কেন? বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং সর্বোপরি ‘টাকা দিচ্ছেন’ বলে যিনি সর্বত্র বড়াই করে বেড়ান সেই শিক্ষামন্ত্রী কী বলছেন? তাঁরা কি জানতেন না বেশিরভাগ কলেজে অনার্সের জন্যই পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই৷ অনার্সের সাথে সাথে পাশ কোর্সের বিষয়কে সমান গুরুত্ব দিয়ে পড়াবার ব্যবস্থা তো অনেক বড় কথা৷ এ ছাড়াও লাইব্রেরিতে উপযুক্ত সংখ্যক বই, ল্যাবরেটরির উন্নত ব্যবস্থা না থাকার জন্য অনেক কলেজেই কোনও মতে অনার্সের ক্লাস হলেও পাশের ক্লাস হয়ই না৷ কলেজগুলিতে বছরে ২১০ দিন ক্লাস হওয়ার কথা, হরেক রকম পরীক্ষার সিট পড়ায় ক্লাস হচ্ছে মাত্র ১২০ দিন৷
সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের কর্তৃপক্ষের একমাত্র নজর ছাত্রছাত্রীদের ঘাড় ভেঙে টাকা আদায়ের দিকে৷ ফলে পড়াশোনা করাটা ছাত্রছাত্রীদের টিউশন নির্ভর৷ তাহলে কলেজ কি আছে শুধু সার্টিফিকেটে স্ট্যাম্প মারতে? বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পরিকাঠামোও অত্যন্ত দুর্বল৷ পর্যাপ্ত কর্মী সংখ্যার অভাব৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরীক্ষা নিয়ামক ও উপপরীক্ষা নিয়ামকের এক গুচ্ছ পদ ফাঁকা৷ একাধিক দক্ষ ও অভিজ্ঞ আধিকারিককে সরানো হয়েছে অন্যত্র৷ পরীক্ষা নিয়ামকের দপ্তরই দুর্বল হয়ে গেছে৷ যে কারণে এ বছর রেজাল্ট প্রকাশ করতে সময় লেগেছে ৬ মাস৷ তাতেও অসম্পূর্ণ ফলাফলের সংখ্যা ১০ হাজার৷ কর্তৃপক্ষের এই চূড়ান্ত অবহেলায় ক্রমশ শিক্ষাপ্রেমী জনগণ, অভিভাবক, ছাত্রছাত্রীরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর থেকে আস্থা হারাচ্ছেন৷ এই ত্রুটিগুলি দূর না করে শুধু নিয়ম চালু করলো বিল্ডিং রঙ করা, সি সি টি ভি বসানোর মতো চটকদারি কাজ করেই কি দায়িত্ব পালন করা যাবে?
ছাত্রদের আন্দোলনের ফলে এই মারাত্মক ত্রুটিগুলি প্রকাশ্যে এসে যাওয়ায় এখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং সরকার বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের কথা বলছে৷ কিন্তু মূল সমস্যাগুলির সমাধান না করলে এ ধরনের ঘটনা বারবারই ঘটতে থাকবে৷