চার বছর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে প্রশান্ত ভাল চাকরির হাতছানিতে মুম্বই চলে যায়। মাস ঘুরলে মোটা বেতন, থাকার জন্য আকাশচুম্বী ফ্ল্যাটের ১২ তলায় ঘর, খাওয়া-দাওয়াও যথেষ্ট ভাল। এমনকি এক-দু’বছর পর বরাত যদি খোলে, তা হলে প্রমোশন হবেই। এক কথায় রাজি হয়ে কাজে ঢোকে সে। কয়েক মাস পরেই মালিকের দুর্ব্যবহার, কাজের অত্যধিক চাপ, নানা অজুহাতে মাইনে কাটা, তারপর কোম্পানির লোকসানের গল্প ফেঁদে কাজ থেকে পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়া– প্রশান্তের স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়ে। আত্মীয়-বন্ধুদের কাছে সে মুখ দেখাবে কী করে। অবসাদে ভুগতে লাগল প্রশান্ত। আত্মহত্যা করে বসে এমন পরিস্থিতি।
পরে কলকাতায় ফিরে আবার নতুন কাজে যোগ দেয় সে। সেখানেও চলে কর্তৃপক্ষের নানা হয়রানি। সাথে চলে আগে কাজ চলে যাওয়ার জন্য কটূক্তি। একদিন কর্তৃপক্ষের সাথে রাগারাগি, পরিণতিতে কাজ থেকে ছাঁটাই। বাড়িতে অবসরপ্রাপ্ত বাবা, মা, স্ত্রী ও শিশুসন্তান। সংসার চলবে কী করে? উপায় খুঁজে না পেয়ে অবসাদ আরও বেড়ে যায়। অবশেষে মনোবিদের কাছে নিয়ে যেতে হয় তাঁকে। তিনি প্রশান্তকে নজরে রাখার জন্য পরিজনদের পরামর্শ দেন।
রজনীশ নামী তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিতে ঢুকেছিল অনেক স্বপ্ন নিয়ে। সেখানে দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে সে। কাজ করার সময় প্রয়োজনেও ফোন করার উপাই নেই, সহকর্মীদের মধ্যে কথা বলা বারণ, কাজের প্রতিটি মুহূর্তের উপর কর্তৃপক্ষের নজরদারি, বাথরুমে বা খেতে গেলে হিসাব কষে মাইনে ছাঁটাই। শ্রম আইন শব্দটাই এখানে অচল। অন্যায় জুলুম যতই হোক কিছু করবার নেই! কারণ একটাই, প্রতিবাদ করলে ছাঁটাই অনিবার্য। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় রজনীশ জানে, তাঁর মতো অসংখ্য বেকার যুবক দিবারাত্র কাজের জন্য হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছে। অগত্যা চাপের মুখে কাজ করতে বাধ্য হয়ে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয় সে।
চুপ করে থেকে অসহনীয় পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে সম্প্রতি মর্মান্তিক পরিণতি ঘটেছে ২৫ বছরের যুবক সৌরভ কুমার লাড্ডার জীবনে। মুম্বইয়ে ম্যাকেনসি কোম্পানিতে কর্মরত আইআইটি ও আইআইএম ডিগ্রিপ্রাপ্ত ওই যুবক চাকরি পাওয়ার কিছু দিনের মধ্যে ‘কর্মক্ষেত্রে চাপের কারণে’ আত্মহত্যা করে জীবনের জ্বালা জুড়িয়েছেন।
কর্মক্ষেত্রে অসহনীয় পরিবেশের কারণে মাত্র ২৬ বছর বয়সে পুনের একটি বহুজাতিক সংস্থার চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অনিতা সেবাস্টিয়ান পেরিলের মৃত্যু হয় সম্প্রতি। কর্মক্ষেত্রের চাপে অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার, খাবার ও জল খাওয়ার সুযোগ ঠিকমতো না পাওয়ার ফলে শারীরিক ও মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া, অসুস্থ অবস্থাতেও কাজ করতে বাধ্য হওয়ায় চাকরিতে ঢোকার ৪ মাসের মধ্যেই স্টে্রাকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান পেরিল। এঁরা কেউ মাটিকাটার দিনমজুর নন, সকলেই ‘হোয়াইট কলার’ এমপ্লয়ি। এঁদের বেশিরভাগই ভাল মাইনের কর্মী। কেউ কেউ স্যুটেড-বুটেড হয়ে ল্যাপটপ হাতে অফিসে যান, এসি রুমে বসে কাজ করেন। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় যেন নিশ্চিন্ত জীবন। কিন্তু তাঁরা রয়েছেন প্রতি মুহূর্তের সংকটে। প্রবল অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটে এই কর্মীদের। দিনে ১২-১৩ ঘণ্টা কাজ, ছুটির দিনেও কাজের চাপ, ব্যক্তিগত পরিসরে (সময়ে) অফিসের কাজের চাপ, খাওয়া বা বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আলাদা কোনও সময় না দেওয়া, সুস্থ পরিবেশের অভাব, কর্তৃপক্ষের দুর্ব্যবহার ইত্যাদিতে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত থাকেন কর্মচারীরা।
ভয়াবহ নজির হল, কর্মক্ষেত্রে অসহনীয় পরিস্থিতির কারণে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৭.৫ লক্ষ মানুষ মারা যান। তাঁদের মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষ ‘হোয়াইট কলার’ কর্মজীবী– ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, শিক্ষক বা অফিস-কর্মী। ভারতের ৫৫ শতাংশ মানুষ কর্মক্ষেত্রে ‘বুলিং’-এর শিকার হন অর্থাৎ অপদস্থ বা অপমানিত হন– জানা গেছে ইউনিসনের সমীক্ষায়। বিশ্বে ২৩ শতাংশ চাকরিরত মানুষ কর্মক্ষেত্রে অপদস্থ বা অপমানিত হন। ভারতে এই হার বিশ্বের গড়ের দু’গুণেরও বেশি। কাজের সময়ের সাপ্তাহিক হিসাবে পৃথিবীর মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে ভারত, যা প্রায় সপ্তাহে ৪৬.৭ ঘণ্টা। ২০২৪-এর কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রকের তথ্য বলছে, বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজের চাপে ভারাক্রান্ত মানুষের ভিড় ভারতে। ‘গ্যালপ’-২০২৪ এর রিপোর্টে দেখা গেছে, প্রায় ৯০ শতাংশ ভারতীয় কর্মী কর্মক্ষেত্রে নানা সমস্যায় ভুগছেন, তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ অবসাদের শিকার। ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের মতে, ৭০ শতাংশ মানুষ কর্মক্ষেত্রে অসুখী, ৫৪ শতাংশ কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন। আইএলও-র ২০২৩-এর রিপোর্ট বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতে কাজের সাপ্তাহিক সময়সীমা সর্বোচ্চ। অথচ মাথাপিছু আয় অত্যন্ত কম। স্টার্ট-আপ ব্যবসার ক্ষেত্রে কাজের ঘণ্টা আরও বেশি, বেতনও অনেকটা কম। সব কর্মক্ষেত্রেই মহিলাদের হেনস্থা হতে হয় আরও বেশি।
সরকারি ক্ষেত্রে কাজের নিরাপত্তা, ইউনিয়ন করার অধিকার কিছুটা হলেও রয়েছে। বেসরকারি নানা ক্ষেত্রে ভাল মাইনের হাতছানি দিয়ে কর্মী নিয়োগ করা হয়। শ্রম-আইনের তোয়াক্কা না করে ক্রীতদাসের মতো খাটানো হয় নানা কর্পোরেট সংস্থার কর্মীদের। এঁরা আধুনিক সমাজের ‘দাস’ হিসাবে নিজেদের নিংড়ে দিয়ে মালিকের শোষণযন্ত্রকে সচল রাখতে বাধ্য হন। ভারতের ৯০ শতাংশ কর্মজীবী কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। এই ক্ষেত্রগুলিতে মালিকরা বেপরোয়া শোষণ চালায় কর্মীদের উপর। বর্তমানে কর্মী নিয়োগের যে আইন রয়েছে, তা-ও না মেনে চুক্তির ভিত্তিতে, স্বল্প বেতনে কর্মী নিয়োগ করে কর্তৃপক্ষ। সংস্থার দেওয়া ‘টার্গেট’ পূরণ করতে শেষ রক্তবিন্দুটুকু দেওয়ার পরেও কর্মীদের সর্বক্ষণই দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় এই বোধহয় ছাঁটাইয়ের খড়গ নেমে এল! বহু কোম্পানিতেই অসহনীয় পরিবেশে কাজ করিয়ে তারপর কাজের মান খারাপ বলে অপমান করে কর্মীদের ছাঁটাই করা হয়। ভারতে কর্পোরেট অভিধানে এর গালভরা নাম ‘আগাছা অপসারণ করা’।
সম্প্রতি এনসিআরবি-র রিপোর্টে শিহরণ জাগানো তথ্যে কর্মক্ষেত্রে হয়রানির বিষময় পরিণাম প্রকাশ্যে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, ভারতে আত্মহত্যাকারী মানুষের ৪১ শতাংশরই বয়স ৩০-এর নিচে। এঁদের অনেকেই কর্মরত যুবক-যুবতী। জানা গেছে, কাজের অনিশ্চয়তাও আত্মহত্যর একটা বড় কারণ।
বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কর্মচারীদের দেখে একটা সংখ্যা হিসাবে, যারা উৎপাদন করতে পারে, উৎপাদন আরও বাড়াতে পারে। সেজন্য তাদের জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজন অনুযায়ী মাইনে দেয়। কিন্তু বহুজাতিক সংস্থার মালিকদের প্রধান উদ্দেশ্য, কাজের ঘণ্টা বাড়িয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করে আরও বেশি মুনাফা লোটা। কর্মীদের ভাল-মন্দ নিয়ে তাদের কোনও চিন্তা নেই। বাস্তবে পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থায় শ্রমিক-কর্মচারীরা জীবন্ত উৎপাদন-যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়। মালিকদের একমাত্র লক্ষ্য মুনাফা। আর এই মুনাফা হয় শ্রমিক-কর্মচারীদের শোষণ করে তাদের জীবনের বিনিময়েই। পুঁজিবাদ যত সংকটগ্রস্ত হচ্ছে, শোষণ তত নির্মম হচ্ছে। তাই একে মেনে নিয়ে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। কর্মক্ষেত্রে সংগঠিত হওয়া এবং বৃহত্তর ক্ষেত্রে এর বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চলছে তাতে নিজেদের যুক্ত করতে পারলেই এই পরিস্থিতিকে কিছুটা হলেও বদলানো এবং তার পরিণতিতে সামগ্রিক পরিস্থিতিকে বদলানো সম্ভব।