বিপুল হারে সারের দাম বাড়ানোর ঘোষণা করেই ভোটের জন্য আপাতত ঢোক গিলেছে বিজেপি সরকার। ভারতের বৃহত্তম সার প্রস্তুতকারী সংস্থা ইফকো (ইন্ডিয়ান ফার্মার্স ফার্টিলাইজার কো-অপারেটিভ লিমিটেড) বিভিন্ন রকম সারে ৪৬ শতাংশ থেকে ৫৮ শতাংশ হারে দাম বাড়ানোর ঘোষণা করেছে। ইউরিয়া সারের পর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি)। তাঁর দাম ৫০ কেজির বস্তায় ১২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৯০০ টাকা। প্রতি বস্তায় বৃদ্ধি ৭০০ টাকা। অন্যান্য সারের দামও বেড়েছে চড়া হারে। এই বৃদ্ধির ফলে কৃষি আরও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ল। কৃষকদের ঋণগ্রস্ততার সঙ্কট আরও বাড়ল। আর সাধারণ মানুষ, যারা কৃষিপণ্য কিনে খান, তাদের উপরও মূল্যবৃদ্ধির বোঝা চাপল। যদিও দাম বৃদ্ধির ঘোষণা করেই পশ্চিমবঙ্গে চলা ভোটের কথা ভেবে আপাতত তা কার্যকরী হবে না বলেছে কেন্দ্রীয় সরকার এবং ইফকো।
তবে ভবিষ্যতে দামবৃদ্ধির বিপদ থাকছেই। এ জন্য কে দায়ী? মোদি সরকার বলছে তারা দাম বাড়ায়নি। বাড়িয়েছে সার কোম্পানি। সার কোম্পানি কী করে দাম বাড়াতে পারছে? কারণ সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই কেন? কারণ কেন্দ্রীয় সরকার সারের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রায় তুলে দিয়েছে। পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের যে নীতি ১৯৯১ সালে কংগ্রেস পরিচালিত সরকার গ্রহণ করেছে,সেই নীতি মেনেই পরের পর কেন্দ্রীয় সরকার সারের উপর নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে তুলে দিয়েছে। বাজার মানে পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রিত বাজার। এই পুঁজিপতিরাই ঠিক করেছে কোন সারের দাম কী হবে।
এখন কেবল ইউরিয়া সারের দাম ও বণ্টন নিয়েন্ত্রণ করে সরকার। বাকি সব সারের দাম নির্ধারণ করে এই কোম্পানিগুলি। পুঁজিবাদী অর্থনীতি অনুযায়ী কোম্পানিগুলির লক্ষ্য সর্বোচ্চ মুনাফা তোলা। সেই লক্ষ্যেই তারা সারের দাম বাড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তারা দোহাই দিয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির। দেবেই,তারা যে কোনও অজুহাত তুলে জনশোষণের ব্যবস্থা করবে। এদের হাত থেকে চাষিকে রক্ষা করার জন্যই তো সরকারের নিয়ন্ত্রণ দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি সত্ত্বেও যাতে দেশীয় বাজারে সারের দাম না বাড়ে সে জন্য ভরতুকির ব্যবস্থা করা দরকার ছিল। অথচ সরকারের নীতি হল ভরতুকি তুলে দাও। ফলে সরসকারের এই বিপুল দামবৃদ্ধি সরকারের নীতিরই পরিণাম। এবং সরকার এজন্য পুরোপুরি দায়ী।
সরকারের এই মূল্যবৃদ্ধির তীব্র বিরোধিতা করেছে এসইউসিআই (সি)। অল ইন্ডিয়া কিসান খেতমজদুর সংগঠন (এআইকেকেএমএস) এর তীব্র বিরোধিতা করে কৃষকদের আন্দোলনে নামার আহ্বান জানিয়েছে। কৃষি আইনের বিরুদ্ধে দিল্লিতে কৃষক সংগঠনগুলির যে যুক্তমোর্চা আন্দোলনে সামিল তারও সারের দাম বাড়ানোর কড়া নিন্দা করেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকদের বিক্ষোভ শুরুও হয়েছে।
প্রবল চাপে পড়েছে বিজেপি। কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করে দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে বাস্তবে সারের দাম বৃদ্ধি,বীজের দাম বৃদ্ধি,কীটনাশকের দাম বৃদ্ধি,সেচের জন্য ব্যবহৃত ডিজেলের দাম বৃদ্ধি ঘটতে দিয়ে কৃষকদের আয় অর্ধেক করে দেওয়ার রাস্তা পাকা করে দিচ্ছে বিজেপি। কৃষকরা ক্ষুব্ধ। এমনিতেই কৃষি আইনের মধ্য দিয়ে সরাসরি একচেটিয়া মালিকদের শোষণের সামনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে কৃষকদের।
সরকারি উদ্যোগে ফসল কেনার পরিকাঠামো গড়ে না তুলে,বরং যতটুকু পরিকাঠামো ছিল তাকে ধ্বংস করে বা নিষ্ক্রিয় করে কৃষকদের অভাবি বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এর ফলে ক্রমাগত লোকসানের শিকার হয়ে কৃষক জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। অথচ খাদ্যের চাহিদা কখনও কমে না। ফলে তার সরবরাহকারী, উৎপাদনকারী সেই কৃষকদের এই সঙ্কট হওয়ার কথা নয়। তা হচ্ছে পুঁজিবাদী পরিচালনার জন্যই।
সার | বর্তমান দাম/৫০কেজি | বর্ধিত দাম | বস্তায় বৃদ্ধি |
ডিএপি | ১২০০ টাকা | ১৯০০ টাকা | ৭০০ টাকা |
এনপিকে (১০: ২৬:২৬) | ১১৭৫ টাকা | ১৭৭৫টাকা | ৬০০টাকা |
এনপিকে (১২:৩২:১৬) | ১১৮৫ টাকা | ১৮০০ টাকা | ৬১৫টাকা |
এলপিকে (২০:২০:১৩) | ৯২৫ টাকা | ১০৫০ টাকা | ৪২৫ টাকা |
সারের দাম বৃদ্ধিতে খাদ্যের দামও বাড়বে। গ্রাম শহর নির্বিশেষে সব অংশের গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষদের সংসার চালাতে আরও সঙ্কটের মধ্যে পড়তে হবে। এই দুঃসহ অবস্থার মধ্যে দেশের মানুষকে ঠেলে দিল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। শুরু মনমোহন সিংহের হাত ধরে। তাকে আরও ভয়ঙ্কর রূপ এনে দিল মোদি সরকার।
সারের দাম বৃদ্ধিতে চাষের খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে যাবে। এমনিতেই চাষের বিপুল ব্যয় বহন করতে না পেরে ছোট চাষিদের বিরাট অংশ জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। নতুন দামবৃদ্ধি জমিহারা চাষির সংখ্যাকেই আরও বাড়িয়ে তুলবে। সরকার আপাতত পিছু হটলেও আন্দোলন তীব্র করতে হবে।