মাও সে তুঙ তাঁর একটি বিখ্যাত বক্তৃতায় চিনের প্রাচীন উপকথার সেই বোকা বুড়োর ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের উদাহরণ দিয়েছিলেন, যে কিনা কোদাল নিয়ে নেমে পড়েছিল বাড়ির সামনে পথ আটকে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো বিরাট পাহাড় কেটে সরাবে বলে। বুদ্ধিমানেরা বলেছিল, এ ভাবে একা পাহাড় সরানো যায় না। কিন্তু সেই বুড়োকে নিরস্ত করা যায়নি। সে বলেছিল, আমি না পারি আমার ছেলেরা, তাদের ছেলেরা, তাদের ছেলেরা পারবে। একটু একটু করে পাহাড় ঠিক সরবেই। শেষ পর্যন্ত পাহাড় সরিয়েই থেমেছিল সে। লাগাতার আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্বতন বিজেপি রাজ্য সরকারের চালু করা জাতীয় শিক্ষানীতির একটি অঙ্গ চার বছরের ডিগ্রি কোর্স প্রত্যাহারে কর্ণাটকের সরকারকে বাধ্য করলেন সে রাজ্যের শিক্ষাপ্রেমী জনগণ। প্রমাণ করলেন, একমাত্র সঠিক লক্ষ্যে সংগঠিত আন্দোলনের পথেই আজও সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর শাসকের চাপিয়ে দেওয়া জনবিরোধী নীতির পাহাড় সরানো যায়।
দেশ জুড়ে নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি চালু করে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা এবং শিক্ষার সামগ্রিক ব্যবসায়ীকরণ করে দেশের অধিকাংশ মানুষকে প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে রাখার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন চালিয়ে আসছে বিপ্লবী ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও।এই জাতীয় শিক্ষানীতির অংশ হিসাবে কর্ণাটকে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ছাত্র-শিক্ষক-শিক্ষাবিদ মহলের সাথে কোনও রকম আলাপ-আলোচনা মত বিনিময় ছাড়াই চার বছরের ডিগ্রি কোর্স চালু করে দিয়েছিল বিজেপি সরকার।এর বিরুদ্ধে সে রাজ্যের ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক-বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত করে আন্দোলন গড়ে তোলে এআইডিএসও এবং অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটি। ২০২১-এর ডিসেম্বরে এআইডিএসও-র নেতৃত্বে মাইসোরে বিরাট বিক্ষোভ সমাবেশ হয়।রাজ্য জুড়ে নানা জায়গায় হাজার হাজার ছাত্র প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেয়।জাতীয় শিক্ষানীতি এবং এই চার বছরের ডিগ্রি কোর্সের পিছনে যে কায়েমি স্বার্থ কাজ করছে বিভিন্ন সভা-সেমিনারের মাধ্যমে মানুষের কাছে তা তুলে ধরা হয়। এই পদক্ষেপ যে কলেজ স্তরের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও বিপুল ব্যয়বহুল করে তুলে সাধারণ গরিব ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার উপর মারাত্মক আক্রমণ আনছে, সে কথা বুঝে কর্ণাটকের ছাত্রসমাজ এই আন্দোলনকে বিপুল সমর্থন জানায়। দেশ জুড়ে জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে এক কোটি সই সংগ্রহের কর্মসূচি ঘোষণা করে এআইডিএসও।তার মধ্যেই কর্ণাটকের বিজেপি সরকার একাধিক স্কুল মিশিয়ে দেওয়ার নাম করে ১৩ হাজার ৮০০টি সরকারি স্কুল তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। এই সর্বনাশা সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলন আরও একমুখী ও শক্তিশালী হয়। গোটা রাজ্যের ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকরা এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান।৩৫ হাজারেরও বেশি ছাত্র এই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে, রাজ্যের মানুষের কাছ থেকে ৩৬ লক্ষের বেশি সই সংগ্রহ করে।বিপ্লবী ভগৎ সিং-এর জন্মবার্ষিকীতে এক বিরাট সমাবেশ থেকে এই স্বাক্ষর সম্বলিত দাবিপত্র সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আওয়াজ ওঠে– জাতীয় শিক্ষানীতি প্রত্যাহার করো, জনগণের শিক্ষা কেড়ে নেওয়া চলবে না, শিক্ষা বাঁচাও-মানবতা বাঁচাও।
সর্বাত্মক প্রতিবাদের সামনে সরকারি স্কুল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় সরকার। ২০২৩-এ সরকার পরিবর্তনের পরেও ধারাবাহিক আন্দোলন চলতে থাকে। আন্দোলনের চাপে কর্ণাটকের বর্তমান সরকার ইউজিসি-র প্রাক্তন চেয়ারম্যান প্রফেসর সুখদেব থোরাটের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে। শিক্ষাজগতের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট মানুষ, ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকের মতের ভিত্তিতে এই কমিশনের পেশ করা অন্তর্বর্তী রিপোর্টে বলা হয়, এই চার বছরের কোর্স সমাজের দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া অংশের সামনে শিক্ষার সুযোগকে সঙ্কুচিত করবে এবং কলেজগুলিতে ইতিমধ্যেই শিক্ষক ও পরিকাঠামোর যথেষ্ট অভাব থাকায় তারাও এই চার বছরের কোর্স চালুতে আগ্রহী নয়। এই রিপোর্টের প্রস্তাব অনুযায়ী আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে চার বছরের কোর্স বাতিল করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে কর্ণাটক সরকার। সেভ এডুকেশন কমিটির কর্ণাটক রাজ্য সভাপতি অধ্যাপক আল্লামাপ্রভু বেট্টাদুরু এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। কমিটির পক্ষ থেকে আগামী দিনে ভারতের নবজাগরণের মনীষী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বপ্নের পরিপূরক বৈজ্ঞানিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে কর্ণাটক সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
গোটা দেশে এই প্রথম একটি রাজ্যের সরকার জাতীয় শিক্ষানীতির প্রস্তাবিত পদক্ষেপ থেকে পিছু হঠতে বাধ্য হল এবং এই ঐতিহাসিক জয় সম্ভব হল সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সংগ্রামী মানসিকতার কারণেই। শ্রমিক-কৃষক-শিক্ষক-অধ্যাপক-লেখক-চিকিৎসক সহ সমস্ত গণতন্ত্রপ্রিয় সচেতন মানুষ এই আন্দোলনকে নিজের আন্দোলন মনে করে এর পাশে দাঁড়িয়েছেন। আজ, পঙ্কিল ভোটসর্বস্ব রাজনীতি যখন মানুষের মধ্যে আন্দোলনমুখী মানসিকতা নষ্ট করে দিচ্ছে, ‘আন্দোলন করে কিছু হয় না’ এই মিথ্যা প্রচারে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে, তখন কর্ণাটকের এই ঘটনা দেখিয়ে দিল, একমাত্র সঠিক নেতৃত্বে এবং সঠিক নৈতিকতার ভিত্তিতে পরিচালিত গণআন্দোলনই শাসককে মাথা নোওয়াতে বাধ্য করতে পারে। সাধারণ শোষিত মানুষের সামনে মাথা উঁচু করে বাঁচার এটাই একমাত্র পথ।