‘ঘরে থাকুন, সুস্থ থাকুন’। রেডিও, টিভি, খবরের কাগজে, এমনকি মোবাইলে কাউকে কল করতে গেলে কেন্দ্রীয় সরকারের সতর্কতাবাণী আগে শুনে নিতে হয়। তবুও চেতনা যেন কাজ করে না। অবাধ্য মানুষের ভিড়ে বাজারে, দোকানে, ব্যাঙ্কে করোনা প্রতিরোধে অবশ্য পালনীয় শারীরিক দূরত্ব বজায় থাকে না। ঘরবন্দি না থেকে মানুষ বাইরে বেরোচ্ছে। মাস্কে মুখ ঢাকছে না। তাই মানুষকে সবক শেখাতে পুলিশও নানা ভূমিকা নিচ্ছে। কখনও নির্মম লাঠিপেটা করছে, কখনও বিধি অমান্যকারীদের গোলাপ ফুল বা লজেন্স দিচ্ছে, কখনও বা করোনা সঙ্গীত শোনাচ্ছে। কিন্তু কেন সচেতনতা জাগছে না মানুষের? মানুষ কি নিছক মজার জন্য নিয়ম ভাঙছে? সবটাই কি সচেতনতার অভাব? নাকি অনন্যোপায় হয়েই মানুষকে বেরোতে হচ্ছে। এক বিরাট সংখ্যক মানুষের অবস্থা ‘দিন আনি দিন খাই’। মাত্র চার ঘণ্টার নোটিসে লকডাউন ঘোষণা তাঁদের চরম বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তাদের সঞ্চয় নেই, রোজগার বন্ধ। ভেবেই পাচ্ছেন না, পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দেবেন কিভাবে? এই পরিস্থিতিতে অনেককে বেরোতেই হচ্ছে। বাঁচার এই অনিশ্চয়তার আতঙ্ক তাঁদের মনে করোনা সংক্রমণের ভয়ের থেকে অনেক বেশি। এই অসহায়তা নিরসনের নামে সরকারের অনেক ঘোষণা আছে। কিন্তু কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ওই সব তথাকথিত প্যাকেজ এই বিপর্যস্ত মানুষগুলিকে আশ্বস্ত করতে পারছে না। মানুষ বোঝে, যত গর্জায় তত বর্ষায় না। বাস্তবে এগুলি কার্যকরী করতে হলে যে বরাদ্দ, যে পরিকাঠামো, যে দায়বদ্ধতা দরকার তা কোনও সরকারেরই নেই। সরকারি নেটওয়ার্কের বাইরে এই মানুষগুলির একটা বড় অংশ থেকে গিয়েছে। সরকারি আমলারা তাঁদের নিয়মের গেরোয় আবদ্ধ। তাঁরা, শাসকদলের কর্তাব্যক্তিরা এবং পুলিশ প্রশাসন– এই চক্রই ঠিক করে সরকারি বরাদ্দটুকু কোন কোন মানুষের কাছে পৌঁছাবে?
দ্বিতীয়ত করোনা সংক্রমণের ঘটনার বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারের ভাবনা সংক্রমণবৃদ্ধির হারের পিছনে পিছনে চলেছে। সংক্রমণের যে পর্যায়ে যে ভাবনাটা ভাবলে আগামী পর্যায়কে ঠেকানো সম্ভব, তা সরকার ভাবছে না। যখন বিদেশ থেকে সংক্রমণ ঢুকছে, তখন সরকার তাকে ঠেকানোর ব্যবস্থা নিল না। যখন সংক্রমণ রাজ্যে রাজ্যে ঢুকে গেল, তখন সরকার হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা করে দিল, অথচ পরিযায়ী শ্রমিকসহ গরিব মানুষের কথা ভাবল না। ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে লাগলেন, তখন সরকার তাঁদের জন্য সুরক্ষা সামগ্রীর অর্ডার দিল। যখন সংক্রমণ দ্রুতহারে বাড়তে বাড়তে কমিউনিটি সংক্রমণের দরজায় এসে দাঁড়াল, তখন সরকার টেস্টিং কিটের অর্ডার দিল। ফলে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সরকার নিজেই সচেতন ভূমিকা নিল না। তৃতীয়ত, সচেতনতা অবশ্যই বিজ্ঞানমনস্কতার পথেই গড়ে উঠে। অন্ধবিশ্বাস নয়, বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার অনুবর্তী হলে মানুষ সত্যকে ধরতে পারে এবং আতঙ্কমুক্ত হয়। কিন্তু কেন্দে্রর শাসকদলটি করোনা প্রতিরোধে গোমূত্রপানের নিদান দিয়ে মানুষের মধ্যে ধর্মান্ধ বিশ্বাস তৈরি করছে, যা সচেতন মননের বিরোধী। এই অবস্থায় হাজারো প্রচারেও আতঙ্ক কমে না। আতঙ্ক না কমলে সচেতনতা তৈরি হয় না। তাই আতঙ্কিত জনগণ করোনার মৃতদেহ দাহ করতে বাধা দিচ্ছে, ডাক্তার-নার্সরা যেখানে থাকছেন, সেখান থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। এলাকায় আইসোলেশন সেন্টার গড়তে দিচ্ছে না। সরকারের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা, তার চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে জনমনে আস্থা না তৈরি হলে জনমনে আতঙ্ক কাটে না, সচেতনতাও জাগে না।
ফলে লক ডাউন অমান্যকারী জনগণকে সবক শেখাতে পুলিশের অতিসক্রিয়তা কিংবা অতিনম্রতা কোনওটাই কাজে দিচ্ছে না। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সকলকে এক মানুষের মত দাঁড় করাতে সরকারকে বিজ্ঞান অনুসারী হতে হবে, থালা বাজিয়ে বা বাতি জ্বালিয়ে নয়।