২৩ মার্চ নবান্নে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় বৈঠকে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর পক্ষ থেকে রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য এবং রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমরেড তরুণ নস্কর উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা দলের পক্ষ থেকে যে লিখিত বক্তব্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পেশ করেন তা নিচে দেওয়া হল।
মাননীয়া মহাশয়া,
রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধে এই সভার আয়োজন করার জন্য প্রথমেই আমাদের দলের পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। গত ১৯ মার্চ এমনই একটি প্রস্তাব আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক তাঁর বিবৃতিতে ব্যক্ত করেছিলেন।
বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের অতিমারি আক্রমণ ও বিপুল হারে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধিতে আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। ভারতে তার আগ্রাসী বিস্তার এবং এ রাজ্যেও ক্রমাগত আক্রান্তের সংখ্যাবৃদ্ধি জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ও অসহায়তা সৃষ্টি করেছে।
এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে রাজ্য সরকারের কাছে আমাদের প্রস্তাব –
(১) রাজ্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক Virologist, Epidemologist, Public Health Specialist, সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসক সংগঠন, মেডিকেল সায়েন্সের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানী, হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে রাজ্যস্তরে নিয়মিত বৈঠক করে তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী রাজ্য সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং এঁদের নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের মেডিকেল টাস্ক ফোর্স গঠন করতে হবে।
অনুরূপভাবে সারা দেশের বিশিষ্ট চিকিৎসক, সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসক সংগঠন এবং মেডিকেল সায়েন্সের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারও যাতে এই ধরনের পদক্ষেপ করে, সেই প্রস্তাব কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠানো দরকার।
(২) কেন্দ্রীয় সরকার এখনও পর্যন্ত করোনা সংক্রমণকে কমিউনিটি সংক্রমণের পর্যায় বলে ঘোষণা করেনি। কিন্তু আমরা সেই বিপজ্জনক পর্যায়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছি। তাই সংক্রমিত এলাকা, সম্ভাব্য সংক্রমণ এলাকা এবং সংক্রমণের পথগুলিকে, গণ পরিবহণকে ১৪ দিনের বেশি লকডাউন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে এ রাজ্যে চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থার জন্য সরকারি, বেসরকারি তত্ত্বাবধানে সকলের চিকিৎসার সুযোগ তৈরি করতে হবে। পরবর্তী সময়ে অবস্থার পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সরকারি নিয়মে ফিনানশিয়াল ইয়ার এন্ডিং-এর তারিখ ৩১ মার্চ থাকলেও বর্তমান অবস্থায় তা এ’টেন্ড করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(৩) করোনা আক্রমণ থেকে মুক্ত মানুষদের সুরক্ষিত রাখার জন্য :
(ক) গত ১৪ দিন আগে থেকে এখন পর্যন্ত যারা বিদেশ থেকে এ রাজ্যে প্রবেশ করেছেন, তাদের তালিকা তৈরি করে বাধ্যতামূলক ‘কোয়ারেন্টাইন’এ রাখা ও ‘ল্যাব-টেস্ট’ করতে হবে।
(খ) দেশের মধ্যে যারা বিদেশ থেকে আগতদের সংস্পর্শে আসছেন এবং অন্যান্য রাজ্য থেকেও যারা এ রাজ্যে আসছেন, তাদের বিজ্ঞানসম্মত পর্যবেক্ষণে রাখার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে।
(গ) সংশোধনাগারে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিহত করার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(ঘ) হোম কোয়ারেন্টাইন-এ রাখলে অনেককে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে লোকালয়ে ঘোরাঘুরি করার সংবাদ পাওয়া গেছে। এতে করোনা আক্রমণ ছড়ানোর বিপদ বহুগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে এবং সব রকম সতর্কতাকেই ব্যর্থ করে দিতে পারে। তাই তাদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন-এ থাকার ব্যবস্থা করা হোক।
(ঙ) যেহেতু শুধু বিদেশ থেকে আসা মানুষরাই নন, অন্যান্য রাজ্যেও রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই সেখান থেকে আসা মানুষদের উপরও নজরদারি থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। এমতাবস্থায় ব্লক স্তর পর্যন্ত উপযুক্ত সংখ্যায় বিজ্ঞানসম্মত কোয়ারেন্টাইন সেন্টার গড়ে তুলতে হবে। ছুটি হয়ে যাওয়া স্কুল-কলেজগুলি এবং অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি হলকে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার বানিয়ে এই কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
(চ) বিদেশ থেকে বা অন্য রাজ্য থেকে আসা মানুষজন গ্রামাঞ্চলে এবং শহরাঞ্চলেও অ-সনাক্তকৃত অবস্থায় থেকে যাচ্ছেন, তাদের অনেকে কোয়ারেন্টাইন বা পর্যবেক্ষণে থাকার গুরুত্ব বুঝতে পারছেন না। এদের চিহ্নিত করার জন্য বিভিন্ন সংগঠন, স্থানীয় ক্লাব ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্য নেওয়া হোক এবং প্রশাসনের সহযোগী হিসাবে তাদের যুক্ত করা হোক।
(ছ) বিভিন্ন শহরের ফুটপাথে বসবাসকারীদের পাশের স্কুল বিল্ডিং-এ স্থানান্তরিত করে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
(জ) হাসপাতালগুলিতে জ্বর, সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্টের রোগীদের ভিড় কমাতে এবং রোগীদের মধ্যে পর্যাপ্ত দূরত্ব বজায় রাখতে আলাদা ‘স্ক্রিনিং ওপিডি’ খোলা হোক এবং সেখানে উপযুক্ত সংখ্যক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করা হোক।
(ঝ) আশাকর্মী, উষাকর্মী, গ্রামীণ চিকিৎসকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে ও উপযুক্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা করে নিয়মিত community screening-এর ব্যবস্থা করা দরকার। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এই কাজে সাহায্য করার জন্য আবেদন করা হোক।
(৪) বর্তমান অবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য রাজ্যের সর্বত্র হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দে্র যাতায়াতের জন্য গণ-পরিবহণের বদলে উপযুক্ত স্যানিটাইজেশন করা আলাদা পরিবহণের ব্যবস্থা করা হোক। যে সমস্ত সরকারি দপ্তর খোলা থাকছে, সেখানকার কর্মীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে যারা লকডাউনের জন্য তাদের গ্রামে বা বাসস্থানে যেতে পারছেন না — তাদের জন্য সরকারের তরফ থেকে পরিবহণের ব্যবস্থা করতে হবে।
(৫) রোগ নির্ণয়ের জন্য মহকুমা এবং ব্লক স্তর পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কোনও একটি কেসও নজরদারির বাইরে না থাকতে পারে।
(৬)AIIMS Guideline অনুযায়ী চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও আশাকর্মীদের যথোপযুক্ত পরিমাণে personal protective equipments, designated mask, hand wash, hand sanitiser, gloves সরবরাহ করতে হবে।
(৭) আতঙ্ক ও উদ্বেগজনক এই পরিস্থিতিতে mask, hand wash, hand sanitiser, medicine নিয়ে কালোবাজারি রুখতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। লকডাউন কালে সবজি ইত্যাদি সহ সব রকমের খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রেও কালোবাজারি বন্ধ করতে হবে।
(৮) বর্তমান বিপজ্জনক পরিস্থিতি আসার আগেই অর্থনৈতিক মন্দাজনিত কারণে অসংখ্য শ্রমিক কর্মচ্যুত। সাধারণ মানুষ ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিপর্যস্ত। করোনা-ভীতির কারণে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা, দৈনিক মজুররা কাজ হারাচ্ছেন, রিক্সা-টোটো-অটো চালক, হকার, ক্ষুদ্র দোকানদাররা চূড়ান্ত সংকটজনক অবস্থায় পড়েছেন, খেতমজুরদের জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। পরিচারিকাদের কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। লকডাউনের কারণে তারা কাজে আসতে পারছেন না। এমতাবস্থায় উপরিউক্ত শ্রমজীবী মানুষ ও বিপিএল তালিকাভুক্ত পরিবারগুলিকে বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ ও চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকারকে বহন করতে হবে। অনেক গরিব মানুষেরই নানা কাগজপত্র নেই– তাই ডিজিটাল রেশনকার্ড আছে কি না, বা অন্যান্য কাগজপত্র দেখাতে পারছে কি না, খাদ্যদ্রব্য সরবরাহে তা বিবেচ্য বিষয় করা চলবে না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিভিন্ন দেশ এ সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের জন্য অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারও যাতে এই ঘোষণা করে তার জন্য রাজ্য সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করুক।
(৯) বেসরকারি সংস্থা সহ বিভিন্ন শিল্পে বা ক্ষুদ্রশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের কাজ বন্ধ রাখা হলেও তাদের যাতে লকডাউন কালে আসতে না পারার কারণে বেতন বা মজুরি বন্ধ করা না হয় এবং তাদের চাকরিতে ছেদ না ঘটে ও চাকরি বহাল থাকে তা সুনিশ্চিত করতে হবে।
(১০) করোনা প্রতিরোধের নামে এক শ্রেণির মানুষ এবং রাজনৈতিক নেতা-কর্মী সাধারণ মানুষের অসহায়তা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতা এবং অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক ও ক্ষতিকর দাওয়াই-এর কথা বলছে, গো-মূত্র ইত্যাদি খাওয়ার কথা বলছে। ধর্মের নামে, ঐতিহ্যের নামে বা বিশ্বাসের নামে যারা এসব প্রচার করছে, তাদের চিহ্নিত করে আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
আশা করি মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী সরকারের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগ নিয়েছেন তার সাথে বর্তমানে সর্বস্তরের দরিদ্র মানুষের খাদ্যদ্রব্য ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে ব্যাপক সাহায্যের প্রয়োজন তার গুরুত্ব উপলব্ধি করে আমাদের প্রস্তাবগুলি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবেন এবং যুদ্ধকালীন তৎপরতায় উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।