কথায় আছে কারও পৌষমাস তো কারও সর্বনাশ। পৌষমাস কাদের? পৌষমাস হল এ দেশের বৃহৎ শিল্পপতিদের। পৌষমাস হল দেশের সেইসব মালিকদের যারা করোনা অতিমারির সময়েও সম্পদ বাড়িয়ে শত কোটি টাকার উপরে পৌঁছে গেল। গত ছ’মাসে নতুন ১৫ জন বিলিওনেয়ারের জন্ম হল এ দেশে। সর্বনাশ কাদের? সর্বনাশ হল এ দেশের কোটি কোটি শ্রমজীবী শোষিত মানুষের। সর্বনাশ হল পুঁজিবাদের শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হাড়-মাস এক হয়ে যাওয়া জীবিকাচ্যুত কোটি কোটি দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ভয়ঙ্কর মন্দার সম্মুখীন। ২০২০-২১ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিক জিডিপি সঙ্কুচিত হয়েছে ২৩.৯ শতাংশ যা গত ৪০ বছরের ইতিহাসে নজিরবিহীন। পুরো অর্থবর্ষে জিডিপি কমে আট শতাংশ থেকে ১১.৫ শতাংশ হতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ফিচ, মুডিজ, গোল্ডম্যান স্যাক্স, মর্গান স্ট্যানলি, ক্রিসিল, ইক্রা, কেয়ার প্রভৃতি মূল্যায়ন ও আর্থিক উপদেষ্টা সংস্থা। শিল্পোৎপাদন নিম্নমুখী, দীর্ঘমেয়াদি ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন কমেছে ২৩ শতাংশ। উৎপাদন না থাকায় কাজ ও চাহিদা দুটোই অনুপস্থিত। আবার পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। দীর্ঘমেয়াদি ভোগ্যপণ্য যেমন জামা, জুতো, টিভি, ফ্রিজ প্রভৃতি দূরের কথা, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন আইএলও এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের যৌথ সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতে ৪১ লক্ষের উপর মানুষ কাজ হারিয়েছেন।
স্থায়ীভাবে কাজ হারানোর খাঁড়ার উপরে কয়েক কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ ঝুলছে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো সঙ্কটকে তীব্রতর করেছে কেন্দে্রর বিজেপি সরকারের বিভিন্ন নীতি। করোনাকালে গৃহীত শিল্পনীতি, শ্রমনীতি, কৃষিনীতি সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি বিলগ্নীকরণের যে নীতি মোদি সরকার গ্রহণ করেছে তা একদিকে যেমন গরিব-মধ্যবিত্তকে আরও রিক্ত নিঃস্ব করে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছে, অন্যদিকে দেশের বৃহৎ শিল্পপতি মালিকদের হাতে আরও সম্পদ তুলে দিয়ে তাদের কোটিপতি থেকে শত-কোটিপতি করে তুলেছে। একদিকে যেমন কোটি কোটি কর্মচারী ছাঁটাই হয়েছে, বেতন কমেছে, কোপ পড়েছে মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ে, কৃষক নিজেও ভূমিদাসে পরিণত হতে চলেছে। বিপন্নতার শিকার ক্ষুদ্র শিল্প ও ক্ষুদ্র ব্যবসা। তেমনি শিল্পপতিরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রতিরক্ষা, বিমান, যোগাযোগ, রেল, কৃষি প্রভৃতি লাভজনক ক্ষেত্রগুলিতে তাদের মুনাফার বাজার সম্প্রসারিত করার সুযোগ পেয়েছে আইনিভাবে। সাধারণ মানুষকে তার আমানত থেকে বঞ্চিত করে শিল্পপতিদের ঋণ দেওয়া ও কর ছাড়ের ব্যবস্থা হয়েছে খোলাখুলি। এসবই ১ শতাংশ পুঁজিপতি শ্রেণির জন্য ডেকে এনেছে পৌষমাস আর ৯৯ শতাংশ শ্রমজীবী সর্বহারা শ্রেণির জন্য ডেকে এনেছে সর্বনাশ।
এ দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি মুকেশ আম্বানি, যাঁর সম্পদ করোনা বিপর্যয়ের শুরুতে ২৮ শতাংশ কমে সাড়ে তিন লক্ষ কোটি হয়েছিল, তিনি অচিরেই সরকারি বদান্যতায় আমাজন, ফেসবুক, গুগল প্রভৃতি বহুজাতিকের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে অনলাইন ব্যবসাকে হাতিয়ার করে মাত্র চার মাসে প্রতি ঘণ্টায় ৯০ কোটি টাকা আয় করে আগের বছরের থেকে ৫৫ শতাংশ সম্পদ বৃদ্ধি করে নিজের সম্পত্তি ৮৫ শতাংশ বাড়িয়েছেন। তাঁর বর্তমান সম্পত্তি হল ৬ লক্ষ ৫৮ হাজার কোটি টাকা এবং তিনি এখন বিশ্বের চতুর্থ ধনীতম ব্যক্তি। সম্প্রতি যে আইআইএফএল হুরুন ইন্ডিয়া রিচ লিস্ট ২০২০ সামনে এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, করোনা সংকটের মধ্যেও অন্তত হাজার কোটি টাকা সম্পত্তির তালিকায় রয়েছেন ৮২৮ জন ভারতীয়। ২০১৯-এ এই সংখ্যা ছিল ৭৫০। এর মধ্যে অতি ধনীর তালিকায় রয়েছে ২৬২ জন শিল্পপতি, যাঁদের মোট সম্পত্তি ৮২৩ ডলারের বেশি। এঁদের মধ্যে রয়েছেন হিন্দুজা ব্রাদার্স, শিব নাদার, গৌতম আদানি, আজিম প্রেমজি প্রভৃতি শিল্পগোষ্ঠী। এদের সম্পত্তির পরিমাণ ভারতের গড় জাতীয় উৎপাদনের ১ থেকে ৩ শতাংশ। মার্চ মাসের পরে গত ছ’মাসে নতুন বিলিয়নেয়ার হয়েছেন ১৫ জন।
প্রশ্ন হল, অর্থনীতির এই সংকটময় মুহূর্তেও একদল বিলিওনেয়ারে পরিণত হচ্ছেন কী করে? উত্তর একটাই– গরিবের ধন ক্রমাগত ধনীর সিন্দুকে জমা হওয়ার প্রক্রিয়াতেই একদল বিলিওনেয়ারে পরিণত হচ্ছেন। আরও দেখা যাচ্ছে, এই সময় একদিকে যেমন এমএসএসই সেক্টর অর্থাৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলি সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, গরিব আরও গরিব হয়েছে, তেমনি বৃহৎ শিল্পগুলির প্রায় কোনও ক্ষতি হয়নি। বৃহৎ শিল্পের মালিকরা অনলাইন বা সেই সম্পর্কিত বিভিন্ন ব্যবসা যেমন, অনলাইন পড়াশোনা, ওয়ার্ক ফ্রম হোম, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট তৈরি প্রভৃতির সুযোগ পেয়েছে। স্যানিটাইজার, মাস্ক প্রভৃতি চিকিৎসা সামগ্রী তৈরিতেও এরা বিনিয়োগ করেছে। শেয়ার মার্কেট বা ফাটকা ব্যবসাতেও বিপুল টাকা ঢেলেছে এরা। আর কেন্দ্রীয় সরকার সাধারণ মানুষের আমানত ফাঁকা করে ব্যাঙ্কগুলি থেকে কোটি কোটি টাকা এদের যোগান দিয়েছে। ফলে ক্ষতি হওয়া তো দূরের কথা সংকটের মধ্যেও চালু এদের রমরমা ব্যবসা। আর গরিব মানুষ, ছোট ব্যবসায়ী, মধ্যবিত্ত মানুষ সকলেই ক্রমাগত মালিকদের শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছেন সরকারি বদান্যতায়। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে গরিব মানুষ এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের হাতে টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর স্লোগান ছিল ‘ভোকাল ফর লোকাল’। আসলে লোকালকে বাঁচানোর জন্য ভোকাল হওয়া নয়, লোকালকে বৃহৎ পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য ভোকাল হবার ডাক তিনি সেদিন দিয়েছিলেন। সেজন্যই তো করোনা অতিমারির সময়ে সাধারণ মানুষ যখন সর্বস্বান্ত, জীবন-জীবিকাচ্যুত হয়ে হাহাকার করছে তখন এদেশের ১ শতাংশ মানুষ নতুন করে বিলিওনেয়ারে তালিকার নাম তুলছে। এই বৈপরীত্যই এদেশের বাস্তব চিত্র। এই বৈষম্যের অবসান সম্ভব একমাত্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে।