করোনা অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ আসার সময় থেকেই দলের মেডিকেল ফ্রন্ট রাজ্যের ২৩টি জেলায় কোভিড ম্যানেজমেন্ট টিম তৈরি করে সচেতনতা মূলক প্রচার, অনলাইনে আলোচনা সভার মধ্যে দিয়ে লক্ষাধিক মানুষকে কোভিড বিষয়ে সর্তকতা ও প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়গুলি পৌঁছে দিয়েছে। দলের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক, সার্ভিস ডাক্তার, গ্রামীণ চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা দিনরাত কাজ করে চলেছেন। এ কাজে ৩১৫ জন চিকিৎসক সহ ২৮০৪ জন পুরুষ ও মহিলা স্বেচ্ছাসেবক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কোভিডে অসুস্থদের চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়ার জন্য ‘হ্যালো ডাক্তার’ নামে পাঁচটি, ‘টেলিমেডিসিন’ নামে ছটি ইউনিট প্রত্যেক দিনই নির্দিষ্ট সময়ে অসুস্থদের পরামর্শ ও প্রেসক্রিপশন করে দিচ্ছেন। এইভাবে প্রায় ৭০০০ জন মানুষ ইতিমধ্যে সাহায্য পেয়েছেন। ৩ জুন দলের কেন্দ্রীয় অফিসে দলের পক্ষ থেকে এক সাংবাদিক সম্মেলনে রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য এ কথা জানান।
তিনি বলেন, দলের সক্রিয় প্রায় সমস্ত কর্মী এবং সমর্থকদের একাংশ অত্যন্ত দ্রুততার সাথে কোভিড আক্রান্ত ও ইয়াস ঝড়ে দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়ে লাগাতার কাজ করে চলেছেন। অি’জেন সাপোর্ট সেন্টার গঠন, অক্সিজেন সিলিন্ডার এর ব্যবস্থা করা, পালস অক্সিমিটার সরবরাহ, অক্সিজেন রেকর্ড রাখা, সংক্রমিত পরিবারে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া, অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা, হাসপাতালে ভর্তি করানোর কাজও চলছে অবিরাম। দরিদ্র মানুষের মধ্যে মাস্ক, স্যানিটাইজার, সাবান ব্যাপক সংখ্যায় বিতরণ করা হয়েছে। জেলায় জেলায় দলের উদ্যোগে চারটি হোম কোয়ারান্টাইন ও স্যাটেলাইট সেন্টার চলছে। এ পর্যন্ত এভাবে সরাসরি সাহায্য পেয়েছেন প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। দলের সিনিয়র ডাক্তাররা এ রাজ্য ছাড়াও অন্যান্য রাজ্যের আক্রান্ত মানুষকেও অনলাইনের মাধ্যমে চিকিৎসার পরিষেবা পৌঁছে দিচ্ছেন। কোচবিহার, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় চলছে ৬টি গণকিচেন। যেখানে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ রান্না করা খাবার পাচ্ছেন।
দলের এই উদ্যোগের সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ছাত্র ফ্রন্ট (এআইডিএসও), যুব ফ্রন্ট (এআইডিওয়াইও), মহিলা ফ্রন্ট (এআইএমএসএস), শিক্ষক অধ্যাপক ফ্রন্ট এর অসংখ্য কর্মী। জেলায় জেলায় স্থানীয় স্তর পর্যন্ত গঠিত কোভিড কেয়ার কমিটি, কোভিড প্রতিরোধে জনস্বাস্থ্য কমিটি, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা, মনীষী স্মরণ সংস্থা, সংহতি মঞ্চ ইত্যাদি প্রায় ১৫৬টি সংস্থা এই কাজে যুক্ত হয়েছে। তাতে বহু মানুষ উপকৃত হয়েছেন। এমনই একজন ৩১ বছর বয়সী, কলেজ অধ্যাপিকা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। দুবার যক্ষ্মা আক্রান্ত হয়ে করোনা পজিটিভ। তার বৃদ্ধ বাবা-মাও কোভিডে আক্রান্ত। অধ্যাপিকার অবস্থার অবনতি ঘটছে কিন্তু বাবা মাকে একা কোভিড আক্রান্ত রেখে কোথাও যেতে তিনি রাজি হননি। সেই সময় কোন এক সূত্রে এ আই ডি এস ও পরিচালিত টেলি ক্লিনিকের দুটি ফোন নম্বর পেয়েছিলেন। তারপর সেখানে ফোন করে তার অবস্থার কথা বলায় ক্লিনিকের টিম চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয় এবং শুধু এটুকুই নয় অধ্যাপিকাকে এই টিমের পক্ষ থেকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় এবং তার অসুস্থ বাবা-মায়ের দেখভালের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও করা হয়। পরবর্তীতে অধ্যাপিকা সুস্থ হয়ে মর্মস্পর্শী ভাষায় আবেদন জানিয়েছেন, ‘আমি বাঁচতে চাই আর সারাজীবন আপনাদের পাশে থাকতে চাই’। এমন বহু মানুষ প্রশংসা করে আবেগ ব্যক্ত করেছেন।
অতিমারিতে মানুষকে সাহায্য করার সাথে সাথে সরকারি অবহেলা ও অব্যবস্থার বিরুদ্ধেও চলছে আন্দোলন। স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতির দাবিতে স্বাস্থ্যদপ্তরগুলিতে ডেপুটেশন দেওয়া ও প্রত্যেক দেশবাসীকে বিনামূলে ভ্যাক্সিন দেওয়া, পিএম কেয়ারের পুরো টাকা কোভিড মোকাবিলায় ব্যবহার করা, গ্রামে পঞ্চায়েত ও শহরে ওয়ার্ড স্তরে হাসপাতাল নির্মাণ প্রভৃতি দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে অনলাইন স্বাক্ষর সংগ্রহ চলছে।
কোভিডের এই সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যেই ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের তাণ্ডবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা নামখানা, কাকদ্বীপ, পাথরপ্রতিমা, গোসাবা, বাসন্তী, কুলতলী। পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগর, হলদিয়া উপকূলবর্তী এলাকা এবং উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট, হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি সহ বিস্তীর্ণ এলাকা। এই সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সাথে সাথেই ছুটে গেছেন দলের নেতাকর্মীসহ ছাত্র যুব ভলেন্টিয়াররা। উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়ে তাঁরা সুন্দরবনের সাধারণ মানুষের সাথে বিভিন্ন জায়গায় কোমর জলে দাঁড়িয়ে মানব ঢাল তৈরি করে বাঁধ রক্ষা করা ও জল আটকানোর চেষ্টা করেছেন। যে ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। এই বিস্তীর্ণ এলাকায় কয়েক হাজার বাড়ি জলের তলায় তলিয়ে গেছে। নোনা জল ঢুকে চাষের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে ত্রাণশিবিরে বা খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে অসংখ্য মানুষ।
ইয়াসের পূর্বাভাস পাওয়া মাত্রই দলের পূর্বতন দুই বিধায়ক কমরেড তরুণ নস্কর ও কমরেড জয়কৃষ্ণ হালদার মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে স্মরণ করিয়ে ছিলেন উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। আয়লা, আমফান পরবর্তীতে নদী বাঁধগুলির সংস্কারের দাবি তোলা হয়েছিল কিন্তু বছরের পর বছর বাঁধ মেরামত না করে বা কোনও রকম ব্যবস্থা গ্রহণ না করে সরকারি অবহেলায় এই মানুষগুলোকে অসহায় অবস্থায় ঠেলে দেয়া হয়েছে। এই অবস্থার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করে যেমন আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছে। পাশাপাশি দলের বিভিন্ন গণসংগঠনের পক্ষে থেকে এইসব সহায় সম্বলহীন মানুষকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ত্রাণশিবির করে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার কাজও চলছে।
কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য জানান, স্বাভাবিক ভাবেই দলের এই বিরাট কর্মকাণ্ডের প্রচার বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যমগুলিতে নেই। সাধারণ মানুষ জানেন একটা উন্নত আদর্শকে ভিত্তি করে দলের কর্মীরা নিঃস্বার্থভাবেই সামাজিক প্রয়োজনে কাজ করে যায়। যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেমন প্রথম পথে নামতে দেখা যায় এই দলকে ঠিক তেমনই করোনা ও ঘূর্ণিঝড়ে বিধবস্ত রাজ্যের মানুষ প্রথম দিন থেকেই পাশে পেয়েছে এই দলের নেতা কর্মীদের।
কমরেড ভট্টাচার্য জানান, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডে সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেশবাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন করেছেন। তিনি বলেন, আমরা এই সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে বিশেষ করে সমুদ্র সংলগ্ন পূর্ব মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগণা ও উত্তর ২৪ পরগণায় যে বিরাট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার জন্য রাজ্যের শিক্ষক, অধ্যাপক, চিকিৎসক, আইনজীবী, চাকরিজীবী সহ সমস্ত নাগরিকদের কাছে আর্থিক সাহায্যের আবেদন করছি। সাথে সাথে যে ত্রাণকাজে আমাদের বিভিন্ন ফ্রন্টের কর্মীরা নিয়োজিত আছেন, তাঁদের সাথে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে বিশেষ, করে ছাত্র-যুব সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।