ভারতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ উদ্বেগজনক ভাবে বেড়েই চলেছে। ২২ মার্চ থেকে দেশ লকডাউনে। তা সত্ত্বেও করোনা সংক্রমণের গ্রাফ উর্ধ্বমুখীই। সংক্রমণে এগিয়ে থাকা মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত প্রভৃতি রাজ্যের পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। অন্যান্য রাজ্যও স্বস্তিতে নেই।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা শুরু থেকেই বলছেন, একদিকে লকডাউন, অন্যদিকে টেস্ট– এই দুই অস্ত্রেই এই ভয়াল ভাইরাসকে কাবু করা সম্ভব। অথচ সরকার শুধু লকডাউন করেই খালাস। টেস্টের জায়গায় চলছে ক্ষমাহীন, অপরাধতুল্য অবহেলা। দেশের প্রতিটি রাজ্য থেকে ডাক্তার-নার্সদের বিক্ষোভের খবর সংবাদপত্রে দেখা যাচ্ছে। এই যুদ্ধে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে যে ডাক্তার-নার্সরা লড়ছেন, সরকার তাঁদেরই সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি। তাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন ব্যাপক সংখ্যায় এবং কোয়ারান্টিনে যাচ্ছেন। চিকিৎসা সামলানোর মতো যথেষ্ট সংখ্যক ডাক্তার-নার্স অবশিষ্ট আছে কি? এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন– সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করা। আইসিএমআর ব্যাপক হারে র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্টের কথা বলছে। কিন্তু টেস্ট হবে কী দিয়ে? কিট নেই। প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ত থালা বাজানোয়। কেন্দে্র ক্ষমতাসীন বিজেপি দলটির উদগ্র প্রয়াস– ঘন্টা বাজিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে জাতীয় ঐক্যের বাতাবরণ সৃষ্টি করা। এই রাজনীতি কি এখন জরুরি ছিল? নাকি জরুরি ছিল পর্যাপ্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা?
করোনা ভাইরাসের এই অতর্কিত আক্রমণ সমাজের ভেতরকার কিছু দুষ্ট ক্ষত চিহ্নিত করে গেল। কুসংস্কার এবং অন্ধ বিশ্বাস যে আমাদের সমাজে কত গভীরে বাসা বেঁধে আছে তা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল। প্রাক লকডাউন পর্বে বিজেপির ধর্মীয় শাখা অখিল ভারত হিন্দু মহাসভা দিল্লিতে সমাবেশ করে আয়োজন করেছিল ‘গোমূত্র পার্টির’। তাঁদের প্রচার, করোনা ঠেকানোর মোক্ষম দাওয়াই গোমূত্র। তবে বিদেশি গরু হলে হবে না, খাঁটি দিশি চাই। এ খবর ছড়ানো হল সংবাদমাধ্যমে। এ রাজ্যেও শুরু হল করোনা প্রতিষেধক হিসাবে গোমূত্র বিক্রি। দেশব্যাপী অন্ধ বিশ্বাসের কী গভীর আস্তরণ! যখন প্রয়োজন ছিল এই অন্ধতার নিগড় থেকে অজ্ঞ, অশিক্ষিত মানুষকে মুক্তি দেওয়া, তখন কেন্দে্র ক্ষমতাসীন সরকার এর পৃষ্ঠপোষকতাই করে চলেছে।
ভয়াবহ করোনা ভাইরাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছড়িয়ে পড়ল সাম্প্রদায়িক ভাইরাসও। প্রথম দিকে প্রচার ছিল বিদেশে নানা প্রয়োজনে যে উচ্চবিত্ত মানুষদের আনাগোনা, তাঁরাই এদেশে এই মারণ ভাইরাসের বাহক। কিন্তু দিল্লির নিজামুদ্দিন এলাকায় একটি মুসলিম ধর্মীয় সংগঠনের সভায় আগত দেশি-বিদেশি নানা প্রতিনিধির মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ ত্বরান্বিত হওয়ার পর প্রচারের অভিমুখ পাল্টে গেল। করোনা বিস্তারের জন্য একতরফা দায়ী করা হতে থাকল মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের এজন্য সমগ্র মুসলিম সমাজ দায়ী হবে কেন? করোনা অতিমারির সময়ে এই ধরণের সমাবেশ করা ওই সংগঠনের পক্ষে যেমন অনুচিত কাজ, তেমনি দিল্লি সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরণের সমাবেশ করতে দেওয়াও অদূরদর্শিতার পরিচয়। হিন্দু মহাসভার গোমূত্র পানের ফর্মুলা জাহির করা বা যোগী আদিত্যনাথের ধুমধাম করে ভিড় জমিয়ে অযোধ্যা পরিক্রমার জন্য যেমন সমগ্র হিন্দু সমাজকে অভিযুক্ত করা চলে না, তেমনই তবলিগি জামাতের ওই সভার জন্য সমগ্র মুসলিম সমাজকে দায়ী করা হবে কেন? দায়ী যদি করতেই হয় তাহলে কাঠগড়ায় তুলতে হবে উভয় ধর্মের মৌলবাদীদের। মৌলবাদীরা যুক্তি মানে না, অন্ধ বিশ্বাসই তাদের চিন্তার আধার। এ রাজ্যে ঠাকুর বালক ব্রহ্মচারীর মৃত্যুর পর তাঁর ভক্তরা গুরুর মৃতদেহ এক মাস আগলে রাখলেন– এই বিশ্বাস থেকে যে, তিনি বেঁচে উঠবেন। এই অন্ধতা, এই যুক্তিহীনতাকে দূর করতে হলে প্রাত্যহিক জীবনের আচার আচরণ এবং চিন্তার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে ঠাঁই দিতে হবে। এদেশের দুর্ভাগ্য, কেন্দে্র ক্ষমতাসীন সরকার গত ৬ বছর ধরে সরকারি ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নানা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানধর্মী চিন্তাকে সরিয়ে রেখে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মান্ধ ধ্যানধারণার বিস্তার করে চলেছে।
এদেশের শ্রমশক্তির যে ৯০ শতাংশেরও বেশি অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন তারা লকডাউনের জেরে কাজ হারিয়ে মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন। এদের সমস্যা সমাধানের বিষয়ে ভারতের পুঁজিবাদী সরকার কার্যত কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি। পুঁজিপতিদের ত্রাণে দরাজহস্ত সরকার, শ্রমজীবীদের পেটের ভাত জোগাতে নয়।
করোনা ভাইরাস নিয়ে বিদ্বেষের রাজনীতি বন্ধ হোক। সর্বস্তরে আওয়াজ উঠুক দেশের মানুষকে বাঁচাতে সরকার ডাক্তারদের পরামর্শ কার্যকর করুক। মানুষকে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়াই একমাত্র কাজ নয়, বেঁচে থাকার রসদ চাই।