কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ২০ সেপ্টেম্বর করপোরেট কর ছাঁটাইয়ের ঘোষণা করেছেন৷ একে ‘ঐতিহাসিক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও৷
এতদিন বড় সংস্থার (যাদের ব্যবসা বছরে ৪০০ কোটি টাকার বেশি) করপোরেট কর ছিল ৩০ শতাংশ৷ সারচার্জ ও সেস মিলিয়ে ৩৪.৯৪ শতাংশ দিতে হত৷ এখন কর ২২ শতাংশে নামায় কার্যক্ষেত্রে দিতে হবে ২৫.১৭ শতাংশ৷ যার অর্থ, কর কমেছে ১০ শতাংশ৷ নতুন কলকারখানা খুলতে চাওয়া সংস্থার জন্যও করপোরেট করের হার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশে আনা হল৷ সেস ও সারচার্জ নিয়ে এই হার ২৯.১২ শতাংশ থেকে কমে হল ১৭.০১ শতাংশ৷ বাজেটে শেয়ার বাজারে বিদেশি সংস্থাগুলির মুনাফার উপরে বাড়তি সারচার্জ যুক্ত করা হয়েছিল৷ তার কিছুটা অংশ আগেই প্রত্যাহার করে নিয়েছিল সরকার৷ সাম্প্রতিক কর ছাড়ের ঘোষণায় আরও একদফা কর ছাড় বা তার উপর বাড়তি সারচার্জ প্রত্যাহার করা হল৷
সব মিলিয়ে শিল্পমন্ত্রীর ঘোষণা করপোরেট গোষ্ঠী বা শিল্পমহলের প্রত্যাশা ছাপিয়ে গিয়েছে৷ কিছু দিন ধরে তারা কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের উপরে বারে বারে চাপ দিয়ে ১ লক্ষ কোটি টাকার ‘স্টিমুলাস’ চেয়েছিল৷ অর্থমন্ত্রী তাদের ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকার স্টিমুলাস দিলেন৷ বোঝা যাচ্ছে সরকার করপোরেট বা শিল্পমহলের কতখানি বাধ্য৷ বিপরীতে জনগণের স্বার্থে কোনও দাবি উঠলে তারা আশ্চর্য রকমভাবে বধির হয়ে যায়৷ স্বভাবতই উচ্ছ্বসিত শিল্পমহল ও বণিক সভাগুলি একে ‘প্রাক দেওয়ালির রোশনাই’ বলে উদ্বাহু হয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছে৷
এরই মধ্যে অর্থমন্ত্রী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির সংযুক্তিকরণের ঘোষণা করেছেন৷ এর দ্বারা সরকার ব্যাঙ্কগুলিতে বেসরকারিকরণের ষড়যন্ত্র শুরু করে দিল৷ করপোরেটদের চাপেই সরকারের এই সিদ্ধান্ত৷ এর ফলে বড় ঋণ পাওয়ার সুযোগ তাদের সহজলভ্য হবে৷ দেশের অর্থনীতির মন্দাজনিত গভীর সংকট ও করুণ অবস্থা দেখে শেয়ার বাজারকে চাঙ্গা করতে সরকারের এই মরিয়া পদক্ষেপ৷ কারণ কিছুদিন ধরে শিল্পমহল সরকারের সমালোচনায় সোচ্চার হচ্ছিল৷
অথচ সারা দেশের চিত্রটা কী? আজ বেশিরভাগ মানুষের চিন্তা তাঁরা বাঁচবেন কী করে৷ গোটা দেশে শিল্প ধুঁকছে, নতুন লগ্নি হচ্ছে না৷ বিদেশি লগ্নি তলানিতে৷ কৃষির অবস্থা শোচনীয়, ফসলের দাম নেই, ঋণের দায়ে লক্ষ লক্ষ চাষি আত্মহত্যা করছে,পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে৷ নোট বাতিল ও জিএসটির ধাক্কায় ছোট–বড়–মাঝারি কলকারখানার নাভিশ্বাস উঠছে৷ লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে, যার সংখ্যা বিগত দু’বছরে দু’কোটি৷ বেকারির হার সর্বোচ্চ, কলকারখানার উৎপাদন বৃদ্ধি এক শতাংশের কম, কৃষিতে তা দুই শতাংশের কম৷ ক্ষুধা সূচকে ভারতের জায়গা হয়েছে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের নিচে৷ চলতি অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসে আর্থিক বৃদ্ধির হার পাঁচ শতাংশে নেমে এসেছে৷ এক গভীর মন্দার অন্ধকার নেমে এসেছে মানুষের জীবনে৷
এক কথায় বর্তমান চরম আর্থিক বৈষম্য এই মন্দার কারণ, যা দ্রুত হারে বাড়ছে৷ দেশে ৬২ শতাংশ মানুষ অত্যন্ত গরিব, দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে পড়ছে, ৬৭ কোটি ভারতীয় মাত্র এক শতাংশ সম্পদের মালিক, ২৩ কোটি মানুষ আধপেটা খাবারও জোটাতে পারে না৷ প্রতিদিন ৭ হাজার মানুষ অনাহারে–বিনা চিকিৎসায় মারা যায়৷ প্রতি ঘন্টায় ৫ জন শ্রমজীবী মানুষ আত্মহত্যা করে৷ আর্থিক অসাম্য দ্রুত হারে বাড়ছে৷
দেশের কল–কারখানা–খনি–বাগিচা-কৃষিজমি নিয়ে অর্থনীতির কর্মকাণ্ড৷ এ সবের যা উৎপাদন ক্ষমতা তাকেই কাজে লাগানো যাচ্ছে না৷ কল–কারখানার ৫০–৬০ শতাংশ উৎপাদন ক্ষমতা অলস হয়ে পড়ছে৷ যা–ও চলছে তা ঢিমে তালে, শিফট বন্ধ হচ্ছে, কোথাও সপ্তাহে ২–৩ দিন উৎপাদন চালু রেখে বাদবাকি দিন উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হচ্ছে৷ উৎপাদনের হার কমছে৷
অসাম্য বা বৈষম্য যত বাড়ছে, উৎপাদনের হার তত কমছে৷ কারণ সকল শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত কমে চলেছে৷ এই ক্রয়ক্ষমতার ওপরই দেশের বাজার নির্ভর করে৷ আবার রফতানির বাজারও সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে৷
ফলে লগ্নিকারীরা লাভের আশা দেখতে না পেয়ে যতটুকু লগ্নি করছিল তার পরিমাণও আপেক্ষিক অর্থে কমিয়ে দিচ্ছে৷ সব মিলিয়ে অর্থনীতির বৃদ্ধির হার কমছে৷
মুষ্টিমেয় লগ্নিকারী করপোরেটদের কর ছাড় দিয়ে বা ‘স্টিমুলাস’ দিয়ে, ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে ঋণের জোগানের সুযোগ বাড়িয়ে, সরকারি অর্ডার বাড়িয়ে এবং তাদের উৎপাদিত পণ্য প্রতিরক্ষা সহ নানা সরকারি সংস্থায় কিনে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে বিজেপি সরকার খাতায়–কলমে উৎপাদন অনেক বেড়েছে বলে দেখানোর চেষ্টা করছে৷ কিন্তু গোঁজামিলের এই হিসাবে আর্থিক বৈষম্য ঢাকা দেওয়া যায় না৷ বরং তাতে আর্থিক অসাম্য আরও বাড়ে, মন্দা গভীরতর হয়৷ দেশের মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ে না৷ আর্থিক সুযোগ–সুবিধা উপরতলার শিল্পপতিদের পাইয়ে দেওয়া আসলে অনেকটা গাছের গোড়া কেটে আগায় জল ঢালার মতো৷ এতে নিচের তলার মানুষ যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে যায়৷ দেশের আর্থিক হাল ক্রমশ খারাপ হচ্ছে এই অসাম্যের জন্য৷ গভীর হচ্ছে অর্থনীতির মন্দাজনিত বিপর্যয়৷
রাজস্ব ক্ষতি করে শুধুমাত্র করপোরেটদের কর ছাড় দিয়ে এই এক লক্ষ পঁয়তাল্লিশ হাজার কোটি টাকা সরকার যদি পরিকাঠামোর উন্নতিতে ব্যয় করতে পারত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, পরিবহণ ইত্যাদির মতো বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রগুলিতে ব্যয় বাড়াত, কৃষিতে ব্যবহার্য সার–বীজ–কীটনাশক প্রভৃতিতে ‘স্টিমুলাস’ দিত, ফসলের সংগ্রহমূল্য বাড়াত, পেট্রল–ডিজেলে অতিরিক্ত সেস ও সারচার্জ তুলে নিত, তবে সাধারণ মানুষের জীবনে কিছুটা সুরাহা হত৷ কর্মসংস্থান হত৷ অর্থনীতির চাকাও ঘুরত৷
দু–একটি বিপর্যয়ের কথা প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যায়৷ মন্দা যখন মহামন্দা রূপে গোটা দুনিয়া, বিশেষত ইউরোপের পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল– সেটা ছিল ১৯২৯ সালের ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেসন’ আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় কালের কয়েকটা বছর৷ উন্নত দেশগুলিতে অর্থনীতির একটি শব্দ তখন তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে উঠে এসেছিল৷ শব্দটি হল ‘ডেফিসিট ফিনান্সিং’৷ অর্থাৎ বাজেট ঘাটতি বা রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ বাড়িয়ে চাহিদা বৃদ্ধি করা৷ নানা অর্থনৈতিক কাজ বাড়িয়ে তোলা, যাতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে৷ পরোক্ষ কর কমিয়ে দেওয়া যাতে মানুষের পকেটে খরচ করবার মতো টাকার পরিমাণ বাড়ে৷ খরচ বাড়লে মানুষের হাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আয়ের পরিমাণ বাড়বে৷ এতে অর্থনীতির চাকা ঘুরতে থাকবে৷ টাকা হাতে এলে মানুষ পণ্য ও পরিষেবার পিছনে খরচ করবে, এতে উৎপাদনের পরিমাণও বাড়বে৷ অর্থনীতির ভাষায় এর পোশাকি নাম ‘কেইনসিয়ান মাল্টিপ্লায়ার প্রসেস’৷ আপেক্ষিক অর্থে সেই সময়কালে অব্যবহূত উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াবার, অর্থনীতির স্বাস্থ্য ফেরানোর যতটুকু সুযোগ ছিল, সর্বোচ্চ মুনাফার ভিত্তিতে পরিচালিত জরাগ্রস্ত মুমূর্ষু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সেটুকুও আজ আর সম্ভব হচ্ছে না৷ এ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের মধ্যে নানা অর্থনৈতিক জোট, ডব্লিউটিও, আইএমএফ প্রভৃতি সংস্থা কর–দর–বাজেট ঘাটতি, আমদানি ও রপ্তানি প্রভৃতি বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে৷ এ নিয়ে কড়া আন্তর্জাতিক বিধি নিষেধ আছে৷ এ ছাড়াও দেশের আর্থিক নিয়মানুসারে ‘ফিসক্যাল রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট (এফআরবিএম) অ্যাক্ট’–এর ফলে রাজকোষ ঘাটতি বাড়ানোর ব্যাপারেও সমস্যা আছে৷
এর ফলে ৫–৬ শতাংশ হারে জাতীয় আয় যতটুকু বাড়ছে তার পুরোটাই ঢুকেছে অল্প সংখ্যক লোকের পকেটে৷ ধনীরা ধনীতর হচ্ছে, দরিদ্ররা দরিদ্রতর৷ সরকারকে যদি এফআরবিএম আইন মেনেই চলতে হয়, তবে করপোরেট কর–সেস–সারচার্জ–এইসব ছাড় দেওয়ার ফলে যে রাজস্ব ক্ষতি হয়, এই ক্ষতিটা পূরণ হবে কী করে? এখনও পর্যন্ত পরিকাঠামো বা সামাজিক ক্ষেত্রে যতটুকু ব্যয় হয়, তার পরিমাণ আরও কমিয়ে ক্ষতিটা পূরণ করবে সরকার৷ এর ফলে ক্রমাগত বাড়বে কর–দর–বেকারি–অনশন-আত্মহত্যার মিছিল৷ অন্য দিকে চোখ ধাঁধানো আগাম ‘দেওয়ালির রোশনাই’য়ের মধ্যে আপামর সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে আসবে অনিশ্চয়তার গাঢ় অন্ধকার৷