এস ইউ সি আই (সি)–র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, এ যুগের অন্যতম মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের ৪২তম স্মরণবার্ষিকী ছিল ৫ আগস্ট৷ এই উপলক্ষে দলের পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্য ৭ আগস্ট আসামের গুয়াহাটিতে এক সভায় বক্তব্য রাখেন৷ সম্পাদিত বক্তব্যটি এখানে প্রকাশ করা হল৷
আজকের এই সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সর্বহারার মহান নেতা, এ যুগের অগ্রগণ্য মার্কসবাদী দার্শনিক, আমাদের শিক্ষক পথপ্রদর্শক কমরেড শিবদাস ঘোষের ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে৷ তাঁর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জানানোর অর্থই হচ্ছে তাঁর শিক্ষাগুলো স্মরণ করা, সঠিকভাবে অনুধাবন করা এবং তাঁর চিন্তার ভিত্তিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকপরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আমাদের বৈপ্লবিক কর্তব্য নির্ধারণ করা৷ তাঁর প্রয়াণ দিবস পালনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এখানেই৷
কমরেড শিবদাস ঘোষের আত্মপ্রকাশ ঘটে স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ দিকে৷ সেদিন এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন পূরণ করার দায়িত্ববর্তেছিল তাঁর উপর৷ সেই অর্থে কমরেড শিবদাস ঘোষ একটা ঐতিহাসিক প্রয়োজনের সৃষ্টি৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসন–শোষণের অবসান ঘটাবার জন্য আসমুদ্রহিমাচলে প্রায় ৫০ বছর ধরে যে স্বাধীনতা আন্দোলন চলছিল তার শেষের দিকে লক্ষ করা গেল যে, ভারতের জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির সাথে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷ সেই সময়েই তিনি অনুভব করলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের যে মর্মবস্তু সেটা অপূরিত রেখেই দেশ রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা অর্জন করতে চলেছে৷ বাস্তব সত্যটা স্বাধীনতা সংগ্রামী কমরেড শিবদাস ঘোষ জেলে থাকা অবস্থাতেই অনুভব করেছিলেন৷ স্বাধীনতা অর্জনের অল্প কিছুদিন আগে স্বাধীনতা সংগ্রামী রাজনৈতিক বন্দিরা জেল থেকে বেরিয়ে আসেন৷ কমরেড শিবদাস ঘোষও জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর এই সত্যটা জনসাধারণের কাছে তুলে ধরার জন্য সংগ্রামের সূচনা করেন৷একক প্রচেষ্টায় এই কাজটা তিনি শুরু করেছিলেন৷ এরপর দেশ রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন হল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তখন আর রাষ্ট্র পরিচালনায় নেই৷ কিন্তু দেখা গেল সমস্ত প্রকারের শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার যে আশা–আকাঙক্ষা স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে জনসাধারণের মধ্যে গড়ে উঠেছিল, তা অপূরিতই থেকে গেল৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন–শোষণের পরিবর্তে জাতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির শাসন–শোষণই চেপে বসল৷ তখনই অগ্রগণ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং আরও কিছু চিন্তাশীল মানুষের মনে এই প্রশ্ন বারবার উঁকি দিয়েছে যে, আসমুদ্রহিমাচল এমন একটা দুর্বার, দুর্দান্ত স্বাধীনতা আন্দোলন, এত রক্তঝরানো সংগ্রাম, এত প্রাণদান, এত শহিদের মৃত্যুবরণ, লক্ষ লক্ষ ছাত্র–যুবক–শ্রমিক এত আত্মত্যাগ সত্ত্বেও অর্জিত এই স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে সর্বপ্রকার শোষণ দারিদ্র থেকে মুক্ত হওয়ার আশা আকাঙক্ষা পূরণ হল না কেন?
তিনি দেখালেন যে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে একই সাথে পরস্পরবিরোধী দু’টি ধারা প্রবহমান ছিল৷ একটা ছিল জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির নেতৃত্বে পরিচালিত আপসকামী ধারা৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের পরিবর্তে জাতীয় পুঁজিপতিরা যাতে দেশের জনসাধারণকে শাসন এবং শোষণ করার একচেটিয়া অধিকার লাভ করতে পারে যাতে সারা দেশে পুঁজিবাদী শোষণ–শাসন আরও সংহত করতে পারে৷ সেই উদ্দেশ্যেই জাতীয় কংগ্রেসকে সামনে রেখে পুঁজিপতি শ্রেণি এই আপসকামী ধারার নেতৃত্ব দিয়েছিল৷ অন্যটা ছিল আপসহীন ধারা৷ এই ধারার প্রবক্তারা আশা করেছিলেন, দেশের কোটি কোটি খেটে খাওয়া মানুষ, নিঃস্ব দরিদ্র মানুষ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শোষণে যারা সর্বস্বান্ত, দেশ স্বাধীন হওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁদের এই দুঃখ–দুর্দশার অবসান ঘটবে, ধনী–গরিবের বৈষম্য দূর হবে৷ সমস্ত প্রকার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক শোষণ থেকে ভারতের সাধারণ মানুষ মুক্ত হবে এই আকাঙক্ষা নিয়েই লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুবক, মহিলা, মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং তাদের এই সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এই স্বাধীনতা সংগ্রাম দুর্বার হয়ে উঠেছিল৷ মুখ্যত আপসহীন ধারার এই সংগ্রামের ধাক্কাতেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতবর্ষ ছেডে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়৷ এই সত্যের স্বীকৃতি ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে৷ এমনকী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূরাও এর স্বীকৃতি দিয়েছেন পরবর্তী সময়ে৷ বিভিন্ন সময় আমি এর উল্লেখ করেছি৷ আপসকামী ও আপসহীন এই দুই বিপরীতমুখী ধারা স্বাধীনতা আন্দোলনে কাজ করলেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা জাতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে, ষড়যন্ত্র করে কংগ্রেসের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যায়৷ এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে জনসাধারণ কী পেয়েছেন এবং কী পাননি এবং কেন পাননি তার ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা কমরেড শিবদাস ঘোষই দৃঢ়তার সাথে তুলে ধরলেন৷ তিনি ব্যাখ্যা করে এটাও দেখালেন যে, স্বাধীনতা আন্দোলনে দুটি দিকই যুগপৎভাবে কাজ করছে৷ তার একটি হচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসন ও শোষণের অবসান ঘটানো এবং অন্যটি হচ্ছে এই স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে সমস্ত ধরনের শোষণের অবসান ঘটানো৷ এই দু’টির একটি দিক অর্থাৎ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হলেও আসল দিকটি অর্থাৎ সমস্ত প্রকার শোষণ থেকে মুক্তির দিকটি অসম্পূর্ণ থেকে গেল৷ ফলে ভারতবর্ষ এক নতুন ঐতিহাসিক স্তরে প্রবেশ করল৷ তিনি দেখালেন, এই পরিস্থিতিতে সেই অসম্পূর্ণ দিক অর্থাৎ শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত পুঁজিপতি শ্রেণিকে বিপ্লবের আঘাতে উচ্ছেদ করতে হবে, অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে৷ কমরেড ঘোষ সেদিন আরও যে কথাটা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বললেন তা হল, এই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রয়োজন একটি প্রকৃত বিপ্লবী দল৷ আজকের দিনে প্রকৃত বিপ্লবী দল গড়ে উঠতে পারে একমাত্র মার্কসবাদ–লেনিনবাদের সর্বোন্নত উপলব্ধির ভিত্তিতে৷ এই বিপ্লবী দলটাই হবে প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি৷ এই কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলে তার নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিচালনা করেই, বিপ্লবের আঘাতে পুঁজিপতি শ্রেণিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে৷ ভোটের মাধ্যমে এই কাজ সম্ভব নয়৷ এই প্রয়োজনবোধ থেকেই এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর জন্ম৷
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নাম নিয়ে ১৯২৪ সালে যে পার্টিটি গড়ে উঠেছিল, কমরেড শিবদাস ঘোষ বিশ্লেষণ করে দেখালেন যে, সেটা নামে কমিউনিস্ট পার্টি হলেও প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি নয়৷ একথা তিনি বললেন এমন একটা সময়ে যখন ঐতিহাসিক কিছু কারণে জনসাধারণের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে অভিহিত এই দলটির বেশ কিছুটা প্রভাব রয়েছে৷ যার অন্যতম কারণ ছিল তখনকার সময়ে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের যে গৌরব, এই পার্টিটা তার সুফল ভোগ করেছিল৷ সেই পরিস্থিতিতে দাঁডিয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষ একা দৃঢ়ভাবে স্পষ্ট ঘোষণা করলেন যে, এই পার্টিটা প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে গড়েই উঠতে পারেনি৷ দায়িত্বজ্ঞানহীন, যুক্তিহীনভাবে তিনি কথাটা বলে দিলেন, তা নয়৷ অঙ্কশাস্ত্রের মতো এক এক করে নির্ভুল যুক্তি দিয়ে ঘটনাসমূহ উল্লেখ করে তার মূল কারণ তিনি তুলে ধরলেন৷ যে সমস্ত যুক্তি তিনি দেখালেন সেগুলো সেদিন কোনও ব্যক্তিই খণ্ডন করতে পারেননি, এমনকীযে পার্টি সম্পর্কে এই কথা বলা হল তারাও কমরেড ঘোষের এই বিশ্লেষণের সামনে দাঁড়াতে পারেনি৷ এ সম্পর্কে তর্ক–বিতর্ক, আলাপ–আলোচনার জন্য কমরেড শিবদাস ঘোষ সিপিআই নামক এই দলটির নেতাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন৷ বলেছিলেন, একসাথে খোলামেলা আলোচনা হোক, আপনারা বলুন, আমিও বলব৷ কিন্তু তাঁর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে এই পার্টির নেতারা সেদিন এগিয়ে আসেননি৷ লক্ষ করা গেল যে, কমরেড শিবদাস ঘোষের নির্ভুল বিশ্লেষণের সামনে এই দলের নেতারা সেদিন দাঁড়াতে পারলেন না, খোলামেলা আলাপ–আলোচনা, মত বিনিময়, মতবাদিক সংগ্রামের পথ তাঁরা এড়িয়ে চললেন৷ আমরা দেখেছি, চলার পথে সাময়িক পরাজয়, অসাফল্য, সাফল্য যাই ঘটুক না কেন, সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কমরেড শিবদাস ঘোষ ছিলেন সুদৃঢ়, অবিচল৷ এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি অল্প দিনের মধ্যেই এস ইউ সি আই (কমিডনিস্ট)–কে একটি প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে গড়ে তুলেছেন৷ আবার লেনিনীয় শিক্ষার ভিত্তিতে প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার এই সংগ্রাম পরিচালনার মধ্য দিয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষ বিপ্লবী দল গঠন সম্পর্কে, বিশেষ করে পুঁজিবাদের ক্ষয়িষ্ণু যুগে এর পদ্ধতি সংক্রান্ত মার্কসীয় উপলব্ধিকে আরও উন্নতকরলেন৷ নিঃসন্দেহে মার্কসবাদী জ্ঞানভাণ্ডারে এটা তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান৷
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিটি কেন প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি নয়, প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি গডে তোলার সঠিক পদ্ধতি কী, বুর্জোয়া পার্টিগুলোর মতো একটা সম্মেলন বা কনভেনশন আহ্বান করে দুই–তিন দিন ধরে কিছু আলাপ–আলোচনা করে একটা কমিটি গঠন করে দিলেই একটা প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি বা সর্বহারা শ্রেণির বিপ্লবী দল গড়ে উঠতে পারে না কেন, এ সম্পর্কে আরও বিশদে আলোচনার প্রয়োজন থাকলেও আজকের সীমিত সময়ে তা সম্ভব নয়৷ কিন্তু যে কথাটা আমি উল্লেখ করতে চাই তা হল– কমরেড শিবদাস ঘোষই দৃঢ়তার সাথে দেখালেন যে, একটা বিপ্লবী দল গড়ে তুলতে হলে তার কিছু পূর্বশর্ত আছে৷ সকলকেই এই পূর্বশর্তগুলি বাস্তবায়িত করতে হবে৷ এই ডদ্দেশ্যেই দল গঠনে যাঁরা এগিয়ে আসবেন তাঁদের সকলকেই প্রতিনিয়ত শ্রমিক–কৃষক–জনসাধারণের মধ্যে যেতে হবে, তাঁদের মধ্যে থাকতে হবে এবং তাঁদের ন্যায্য দাবি নিয়ে নিরন্তর গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ এই আন্দোলন সৃষ্টি করার মধ্য দিয়েই তাঁদের শ্রমিক–কৃষকদের অতি আপন ও বিশ্বস্ত হয়ে উঠতে হবে এবং এই পথেই তাঁদের নতুন সংগ্রামের চরিত্র কী সেটা বোঝাতে হবে৷ এই প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তিশালী করার পথে পরবর্তী পর্যায়ে শ্রেণিসংগ্রাম গডে তুলতে হবে৷ এগুলো দল গঠনের একেবারে প্রারম্ভিককাজ৷ এই সংগ্রাম করার মধ্য দিয়ে পরীক্ষিত হয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কিছু সংগ্রামী কমরেড জাত বিপ্লবী হিসাবে বেরিয়ে আসবেন, যাঁদের কাছে বিপ্লবই জীবন৷ যাঁরা জীবনের সমস্ত দিক ব্যাপ্ত করে কমিউনিস্ট চরিত্র অর্জন করার সংগ্রামে লিপ্ত৷ এই সর্বাত্মক সংগ্রামের মধ্য দিয়েই প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত নেতা এবং কর্মীরা চিহ্ণিত হবেন৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ আরও বলেছেন, পুঁজিবাদের এই ক্ষয়িষ্ণু যুগে যখন মানবতাবাদ নিঃশেষিত তখন তাঁদের সকলকেই ব্যক্তিস্বার্থ এবং সমাজস্বার্থের একীকরণ ঘটাবার নিরলস সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে৷ ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তিবোধের ঊর্ধ্বে ওঠার কঠিন সংগ্রাম চালাতে হবে এবং ব্যক্তিস্বার্থ ও সমাজস্বার্থকে একীভূত বলে গণ্য করার সংগ্রামে লিপ্ত হতে হবে৷ জীবনের খুঁটিনাটি সমস্ত দিক জড়িত করে বিপ্লবী দল গডে তোলার এই প্রারম্ভিক সংগ্রাম, একটা সর্বব্যাপক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালনার সাথে সাথে দেশের মাটিতে সঠিক বিপ্লবী তত্ত্বেরও জন্ম দিতে হবে৷ যেহেতু শ্রেণি বিভাজিত শোষণমূলক ব্যবস্থায় প্রতিটি চিন্তা–ভাবনার শ্রেণিচরিত্র রয়েছে, সেহেতু তাদের সকলকেই পুঁজিবাদী চিন্তা–ভাবনা থেকে মুক্ত থাকার সংগ্রাম চালাতে হবে৷ এই পথেই সংশ্লিষ্ট সকলকে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে৷ যেহেতু পুঁজিবাদী দল গঠনের পদ্ধতি এবং বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণির দল গঠনের পদ্ধতি এক হতে পারে না, তাই শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী দল গড়ে তোলার সঠিক পদ্ধতিও ডদ্ভাবন করতে হবে এবং তার ভিত্তিতেই বিপ্লবী দল গড়ে তোলার সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে৷ দৃঢ়তার সাথে তিনি বলেছেন, এ পথেই দলের অভ্যন্তরে ‘ইউনিফর্মিটিফ থিঙ্কিং, (সম চিন্তা) ‘ওয়ান প্রসেস অফ থিঙ্কিং’, (সম চিন্তা প্রক্রিয়া) ‘সিঙ্গলনেস অব পারপাস’ (সম উদ্দেশ্যবোধ), ‘ওয়াননেস ইন অ্যাপ্রোচ’, ‘আইডেন্টিক্যাল আউটলুক’ (একই দৃষ্টিভঙ্গি)– এ সবের প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷ বিপ্লবী দল গঠন সম্পর্কে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সে–তুং যে শিক্ষাগুলো দিয়ে গিয়েছেন সেগুলোকে আয়ত্ত করতে হবে৷ সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করার অপরিহার্যতা তিনি বারবার স্মরণ করিয়েছেন৷
ভারতবর্ষের মাটিতে কমরেড শিবদাস ঘোষ কীভাবে মাকর্সবাদ–লেনিনবাদকে বিশেষীকৃত করেছেন এ সম্পর্কে বহু কথা আলোচনা করার আছে, যা আজকের এই সভায় সম্ভব নয়৷ কিন্তু অন্য একটা দিক আমি আজকে উল্লেখ করতে চাই৷ শুরুতে কমরেড শিবদাস ঘোষও অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মতো একজন তেজস্বী সাহসী স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন৷ ছাত্রজীবনের শুরুতে স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসহীন ধারার বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির সাথে যুক্ত হয়েছিলেন৷ কিন্তু পরবর্তী সময়ে সত্য উপলব্ধি এবং সত্য প্রতিষ্ঠার অসাধারণ বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি জনসাধারণের মধ্যে একটি বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন৷এটা খুবই প্রণিধানযোগ্য যে একা শুরু করলেও কিছুদিনের পরই তিনি আর একা থাকেননি৷ সঠিক তত্ত্বের ভিত্তিতে সংগ্রাম করার মধ্য দিয়ে তিনি একজন একজন করে শত শত কর্মীর জন্ম দিলেন যাঁরা এই তত্ত্বের ভিত্তিতে বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হচ্ছিলেন৷
সংগ্রামের এই গতিপথে অতি সাহসী একজন সাধারণ স্বাধীনতা সংগ্রামী থেকে কমরেড শিবদাস ঘোষ অনন্যসাধারণ একজন মার্কসবাদী বিপ্লবী নেতায় রূপান্তরিত হলেন৷ এটা সম্ভব হয়েছিল কোনও পত্র–পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে নয়, কেবল সত্যের উপলব্ধি এবং তার ভিত্তিতে অবিরাম সংগ্রাম পরিচালনার মধ্য দিয়ে৷ দিনের শুরু থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত বিপ্লবী নেতা, কর্মী–সমর্থকদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, তাঁদের একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে গড়ে তুলেছেন৷ এই কঠোর ও কঠিন সংগ্রাম পরিচালনার মধ্য দিয়ে কমরেড ঘোষের বিকাশ কতটা উচ্চ স্তরে পৌঁছেছিল তা ভাষায় ব্যক্ত করা অসম্ভব৷ এক স্বল্পস্থায়ী জীবনে তিনি একজন মার্কসিস্ট অথরিটিতে পরিণত হয়েছিলেন৷
তাঁর কথাবার্তায় যে জ্ঞান প্রজ্ঞা বিচ্ছুরিত হয়েছিল তা মানুষকে সাধারণ জীবনযাপনের মন মানসিকতাকে পরিত্যাগ করে বিপ্লবী জীবনসংগ্রামকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল৷ কেবলমাত্র প্রত্যক্ষভাবে তাঁর সংস্পর্শ লাভ করা ব্যক্তিই নয়, পরোক্ষভাবেও যাঁরা তাঁর চিন্তার সংস্পর্শে এসেছেন, এমনকী তাঁর প্রকাশিত বইপত্র পড়েছেন তাঁরা প্রতিদিনই নতুন পথের সন্ধান পাচ্ছেন এবং উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন৷ এই পথেই কমরেড শিবদাস ঘোষ আজ জনসাধারণের সামনে অন্যতম মার্কসিস্ট অথরিটি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন৷ মার্কস–এঙ্গেলস–লেনিন-স্ট্যালিন-সে–তুঙ– এই মহান নেতাদের ঐতিহাসিক অবস্থান বোঝাতে আমরা এঁদের মার্কসিস্ট অথরিটি বলে আখ্যায়িত করি৷ কমরেড শিবদাস ঘোষও সেই স্তরেই উপনীত হয়েছেন৷
এমনই একজন অসাধারণ ব্যক্তি আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা৷ আমরা যারা ছোট বয়সে তাঁকে প্রত্যক্ষ করার, তাঁর আলাপ–আলোচনা শোনার সুযোগ পেয়েছি, তাদের কাছে সেই স্মৃতি অবিস্মরণীয়৷ তাঁকে দেখে তাঁর বহির্জগত এবং সমাজজীবন পরিবর্তনের অসাধারণ ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করে আমরা যখন অভিভূত, আপ্লুত, আমাদের সেই আবেগ আঁচ করে কোনও একটি বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে কমরেড শিবদাস ঘোষ একটি অসাধারণ সত্যোপলব্ধির অবতারণা করেছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন– এই যে আমাকে দেখছেন এ হচ্ছে দলের বাইরে এবং ভেতরে সংগ্রামের ফল৷ কত অপূর্ব এই সত্যোপলব্ধি আপনারা তা উপলব্ধির চেষ্টা করবেন৷
আজকের এই স্মরণসভায় এই কথাটাও আমি আপনাদের আরেকবার স্মরণ করাতে চাই যে, সমগ্র দেশে তথা সারা বিশ্বে বিপ্লবী আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত করার একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব আমাদের উপর অর্পিত হয়েছে৷ কমরেড ঘোষের শিক্ষাকে যথাযথভাবে নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করে তাঁর চিন্তার ভিত্তিতে দ্রুত বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলা এবং বিরামহীন গণসংগ্রাম গড়ে তোলা খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে৷ পুঁজিবাদী সমস্ত দল সম্মিলিতভাবে প্রতিদিন জনসাধারণের উপর যে অত্যাচার চালাচ্ছে, তা অবর্ণনীয়৷ পুঁজিবাদকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে তাদের অঙ্গুলিনির্দেশেই এই সমস্ত রাজনৈতিক দল জনসাধারণকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিদিন প্রতারণা করে চলেছে৷ মানুষের বেঁচে থাকার সমস্ত অবলম্বন পুঁজিবাদ আজকে নিঃশেষ করে দিয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে জনসাধারণকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে৷ বেঁচে থাকার কোনও পথ না পেয়ে মানুষ আত্মহত্যা করছে৷ অন্য দিকে নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, মনুষ্যত্ব সব কিছুকে ধ্বংস করে এরা মানুষকে অমানুষে পর্যবসিত করছে৷ কিন্তু কেন? কারণ ছাড়া তো কোনও ঘটনা ঘটে না৷ ১৮৪৮ সালেই মহান মার্কস সতর্কবাণী শুনিয়েছিলেন যে, পুঁজিবাদ কেবল উদ্বৃত্তমূল্য কেড়ে নিয়ে মানুষকে অর্থনৈতিক ভাবে শোষণ করছে তা–ই নয়, পুঁজিবাদ সমস্ত ধরনের মানবিক সম্পর্ককে টাকার সম্পর্কে ধঃপতিত করছে৷ আজকের বাস্তব পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদের এই জঘন্য চরিত্র কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে, কমরেড শিবদাস ঘোষ বারবার তা দেখিয়েছেন৷ তাই সঠিক পথে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বানও তিনি বারবার রেখেছেন৷ উন্নত নীতি–নৈতিকতার ভিত্তিতে সমস্ত বিপ্লবী কার্যকলাপ পরিচালনা করার অপরিসীম গুরুত্ব বুঝিয়ে বলেছেন৷
এই প্রসঙ্গে আর একটি উল্লেখযোগ্য কথাও আমি আপনাদের কাছে রাখতে চাই৷ রাজনীতিবিজ্ঞানের ছাত্ররা জানেন, বুর্জোয়া রাজনীতির অধঃপতন দেখে এক শ্রেণির বুর্জোয়া পণ্ডিতই একদিন বলেছিলেন যে,রাজনীতি হচ্ছে ধুরন্ধরদের শেষ আশ্রয়স্থল৷ কথাটা আজকের নয়, বহুদিন আগের৷ তখন পুঁজিবাদের আজকের মতো এতটা জঘন্য চেহারা ছিল না৷ তখনকার দিনেই এই পণ্ডিতরা পুঁজিবাদী রাজনীতির নোংরা দিকটা প্রত্যক্ষ করে এ কথা বলেছিলেন৷ কিন্তু কমরেড শিবদাস ঘোষ ভিন্ন মত পোষণ করলেন৷ তিনি মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করে বললেন, যে রাজনীতিকে দেখে একথা বলা হচ্ছে, তাবুর্জোয়া শ্রেণিররাজনীতি, নিকৃষ্ট রাজনীতি, যার কোনও আদর্শ নেই, সংস্কৃতি নেই, কেবল শোষণ করা, মুনাফা অর্জন করাই তার লক্ষ্য৷ সেজন্যই বুর্জোয়া রাজনীতি আজকে মানুষের নীতি–নৈতিকতা, মানবতাবোধ, মনুষ্যত্ববোধ সমস্ত মানবিক গুণাবলিকে ধ্বংস করতে চায় যাতে মানুষ পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করার দিকে ধাবিত না হয়৷
মহান লেনিনের শিক্ষা তুলে ধরে কমরেড ঘোষ গুরুত্ব সহকারে বলেছেন যে, রাজনীতি ও অর্থনীতি হচ্ছে একই মুদ্রার এপিঠ–ওপিঠ৷ রাজনীতি বাদ দিয়ে সমাজকে বোঝার কোনও ডপায় নাই৷ সমাজ যে অর্থনৈতিক নিয়মকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়ে চলেছে তার সাথেই অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে আছে রাজনীতি৷ ফলে অর্থনীতি ও তার উল্টো পিঠ রাজনীতি– এই দুই মিলেই সমস্ত মানবিক কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করছে৷ রাজনীতি খারাপবলে একজন ব্যক্তি প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পারেন, কিন্তু যে অর্থনৈতিক –রাজনৈতিকব্যবস্থা সমাজকে পরিচালনা করছে তার প্রভাব থেকেকারওরই দূরে থাকা সম্ভব নয়৷ রাজনীতি কোনও না কোনও ভাবে প্রত্যেকের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করছে৷ পুঁজিবাদী শোষণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেরক্ষণাবেক্ করার জন্যই এসেছে বুর্জোয়া রাজনীতি৷ এইবুর্জোয়ারাজনীতির রূপ দেখেবলা হচ্ছে রাজনীতি ধুরন্ধরদের শেষ আশ্রয়স্থল৷ কিন্তু রাজনীতি আদৌ তা নয়৷ শোষকের রাজনীতি এবং শোষিত জনসাধারণের রাজনীতি এক তো নয়ই, সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী৷ তিনি বললেন, জনগণের রাজনীতি হচ্ছে উচ্চহূদয়বৃত্তি এবং বিপ্লবী রাজনীতি উচ্চতর হূদয়বৃত্তি৷ মার্কসবাদ–লেনিনব চিন্তার ভিত্তিতে শ্রমিক শ্রেণির যে বিপ্লবী রাজনীতি সেটা অতি মহৎ৷ তাইবুর্জোয়া রাজনীতির যে জঘন্য রূপ বিভিন্ন দলের কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে ফুটে ডঠছে, যে বুর্জোয়া রাজনীতি আজ হত্যাকারীর জন্ম দিচ্ছে সেই নোংরা রাজনীতিকে পরাস্ত করতে মহৎ রাজনীতির চর্চা সর্বতোভাবে চালিয়ে যেতে হবে৷ এই মহৎ রাজনীতি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই আজীবন করে গেছেন কমরেড শিবদাস ঘোষ৷
মৃত্যুর কিছুদিন আগে খুব আবেগপূর্ণভাবে হূদয়স্পর্শী একটা কথা তিনি বলেছিলেন৷ বলেছিলেন, আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের একটা কমিউনিস্ট পার্টি গডে তোলার সংকল্প নিয়েই শুরু করেছিলাম৷ এই ‘ভিন্ন জাতের’ কথাটা লক্ষ করুন৷ দলের নেতা–কর্মীদের উচ্চ সংস্কৃতিগত মান প্রত্যাশা করেই তিনি এ কথাবলেছিলেন৷ বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনেও নেতা–কর্মীদের নীতি–নৈতিকতার প্রশ্নে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছিল৷ বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট নেতাদের সাথে কমরেড শিবদাস ঘোষের যখন সাক্ষাৎ হয়েছে, তখন কমিউনিস্ট আন্দোলনে উন্নত নীতি–নৈতিকতার গুরুত্বের দিকটি তিনি তুলে ধরেছেন৷ তাঁদের কেউ কেউ এতে কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, কমিউনিস্টদের আবার আলাদা করে নীতি–নৈতিকতার চর্চা করতে হবে কেন– এটাই ছিল এঁদের মানসিকতা৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ বললেন, এই ধারণা একেবারেই ঠিক নয়৷ কারণ নীতি–নৈতিকতা–মূল্যবোধ বাদ দিয়ে কোনও আদর্শ, কোনও বিপ্লবী কার্যকলাপের কথা ভাবাই যায় না৷ অতি অবশ্যই এই নীতি–নৈতিকতার ধারণা অনড়–চল–স্থির নয়৷ এগুলোর চরিত্রও পরিবর্তনশীল৷ তাই এথিকস, মরালিটি, প্রিন্সিপল, কালচার ইত্যাদির ধারণাও ক্রমাগত উন্নত করতে হবে৷ নীতি নেই, নৈতিকতা–সংস্কৃতি নেই, অথচ একটা কমিউনিস্ট পার্টি– এমনটা অকল্পনীয়৷ কমরেড ঘোষ আরও বললেন, কমিউনিস্ট আদর্শের মধ্যে আমি যদি উন্নত সংস্কৃতির সুর খুঁজে না পেতাম তাহলে এই পথে আমি আসতাম না৷ আপনারা নিশ্চয়ই কমরেড শিবদাস ঘোষের এই কথার গভীর তাৎপর্য বুঝতে পারছেন৷ প্রকৃত কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে অতি অবশ্যই প্রতি মুহূর্তে উচ্চতর নীতি–নৈতিকতা–সংস্কৃতিকে সামনে রেখেই কমিউনিজমের চর্চা করতে হবে৷ কমিডনিজমের আদর্শ এবং কমিউনিস্ট নীতি–নৈতিকতা এক এবং অভিন্ন বলেই বিবেচনা করতে হবে৷ শোষিত মানুষকে কমিউনিজমের মর্মার্থ যাঁরা বোঝাবেন তাঁদের জীবনসংগ্রাম ও সংস্কৃতিগত মান, নীতি–নৈতিকতার মান উন্নত থেকে ডন্নততর করতে হবে৷ কার্ল মার্কস বলেছিলেন, শ্রমিক শ্রেণিকে সমগ্র বিশ্বের শোষিত জনসাধারণের শোষণমুক্তির আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে হবে৷ তার জন্য দেশে দেশে প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে হবে৷ বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বেই এ কাজ সম্পন্ন হতে হবে৷ মার্কসবাদের মৌলিক সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন শ্রমিক মানেই বিপ্লবী নয়৷ শ্রমিকদের ভিতরেও বুর্জোয়া শ্রেণির চিন্তা–ভাবনার প্রভাব বিদ্যমান থাকে৷ তার বিরুদ্ধে সচেতন সংগ্রাম করে উন্নত সংস্কৃতিগত মান অর্জন করার পথেই একমাত্র বিপ্লবী শ্রমিক বেরিয়ে আসবে৷ এই প্রসঙ্গে মার্কসের একটা কথা প্রণিধানযোগ্য৷ মার্কস বলেছেন, অন্যকে পরিবর্তন করার আগে নিজেকে প্রথম পরিবর্তিত করতে হবে– বিফোর এডুকেটিং আদার্স, দি এডুকেটর্স হ্যাভ টু চেঞ্জ দেমসেলভস৷ এই কারণেই কমরেড শিবদাস ঘোষও এর উপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করেছেন৷ তাই প্রকৃত কমিউনিস্টদের প্রতিনিয়ত নিজেকে পরিবর্তন করেই অন্যকে পরিবর্তন করতে হবে এবং নিজেকে পরিবর্তন করার এই কাজ একদিন, দু’দিনের নয়, এই সংগ্রাম আমৃত্যু৷
পুঁজিবাদের এই ক্ষয়িষ্ণু যুগে পুঁজিপতিরা প্রতিনিয়ত পত্র–পত্রিকা, রেডিও–টেলিভিশন–চলচ্চিত্র– এইসব মিডিয়ার মাধ্যমে বুর্জোয়া সংস্কৃতি পরিবেশন করে চলেছে এবং এর মধ্য দিয়ে সকল স্তরের মানুষের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে চাইছে৷ সেই অবস্থায় কমিউনিস্ট চরিত্র গড়ে তুলতে হলে আজকের দিনে এক নতুন উন্নততর সংস্কৃতির, অর্থাৎ সর্বহারা সংস্কৃতির জন্ম দিতে হবে৷ শ্রমিক শ্রেণিকে এই ক্ষয়িষ্ণু বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হলে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক দাবি দাওয়ার ভিত্তিতেই আন্দোলন গড়ে তুললে চলবে না৷ শ্রমিক শ্রেণির ভিতরে যদি বুর্জোয়া মন মানসিকতার প্রভাব থাকে তা হলে তারা সমাজ বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে পারবে না৷ অজ্ঞাতসারে হলেও তারা বুর্জোয়া শ্রেণিরই দাসত্ব করতে থাকবে৷ তাই বিপ্লবের পরিপূরক যে শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, মহিলা আন্দোলন অর্থাৎ গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলো গড়ে উঠবে সেগুলো কেবল আর্থিক দাবির কিংবা রাজনৈতিক দাবির মধ্যেই আবদ্ধ রাখলে চলবে না৷ সেই আন্দোলনগুলো অতি অবশ্যই গড়ে উঠতে হবে উন্নত নীতি–নৈতিকতার আধারে৷ পুঁজিবাদের এই চূড়ান্ত ক্ষয়িষ্ণু যুগে যখন বুর্জোয়া মানবতাবাদের শেষটুকুও আজ আর অবশিষ্ট নেই, সেই সময় নীতি–নৈতিকতা–সাংস্কৃতিক মান সম্পর্কে এই হচ্ছে কমরেড শিবদাস ঘোষের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা৷ তাই শুধু ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেই নয়, সমগ্র বিশ্বেই আজ যদি প্রকৃত কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তুলতে হয় তা হলে কমরেড ঘোষের এই অসাধারণ অবদানকে সামনে রেখেই তা করতে হবে৷
উন্নত সংস্কৃতিগত মান অর্জনের সংগ্রাম পার্টির অভ্যন্তরে কী রূপ নেবে সে সম্পর্কেও কমরেড শিবদাস ঘোষ অমূল্য শিক্ষা রেখে গেছেন৷ তিনি দেখালেন যে, পুঁজিপতিশ্রেণির নেতৃত্বে রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্রকে উচ্ছেদ করে যখন পুঁজিপতিশ্রেণির শ্রেণি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় তখন সেই বিপ্লবগুলো হয়েছিল মানবতাবাদী আদর্শের উপর দাঁডিয়ে৷ কিন্তু বুর্জোয়া মানবতাবাদ আজকে নিঃশেষিত, তার আজ আর কোনও কার্যকরী ভূমিকা নেই৷ ফলে আজকের দিনে নীতি–আদর্শ–মনুষ্যত্বোধের ধারণাকে আরও উন্নত করতে হবে৷ কমিউনিস্ট নীতি–নৈতিকতা এবং সাংস্কৃতিক মানের জন্ম দিতে হবে৷ এই প্রসঙ্গেই তিনি বলেছিলেন, হোয়্যার হিউম্যানিজম এন্ডস, কমিউনিজম বিগিনস৷ মার্কস–এঙ্গেলস–লেনিন-স্ট্যলিন-মাও সে–তুং–এর বিপ্লবী শিক্ষার অনুসরণে তিনিও অতি গুরুত্ব সহকারে বলেছেন, কালচারাল রেভোলিউশন প্রিসিডস টেকনিক্যাল রেভোলিউশন৷ কিন্তু এই সংগ্রামের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে মারাত্মক বাধা হিসাবে যে সমস্যা সমগ্র বিশ্বেই দেখা দিয়েছে সেটা হচ্ছে বুর্জোয়া ব্যক্তিবাদ৷ ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধ্যান–ধারণার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ আজকে জঘন্য ব্যক্তিবাদের জন্ম দিচ্ছে৷ চূড়ান্ত পরিণামে ব্যক্তিবাদ ব্যক্তির সামাজিক বিচ্ছিন্নতার (সেল্ফ অ্যালিয়েনেশন) জন্ম দেয়৷ সমাজের পরিবর্তনের কাজটা একজন ব্যক্তি একা করতে পারেন না৷ তাই প্রয়োজন সমষ্টিগত প্রচেষ্টা৷ আজ জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যেমনটা লেনিন–স্ট্যালিন–মাও সে–তুঙ–এর নেতৃত্বে রাশিয়া ও চীনে বুর্জোয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছিল সেই পথে সেই অবস্থা সৃষ্টি করতে না পারলে পুঁজিবাদকে নির্মূল করা যাবে না, এমনকী তার কেশাগ্রও স্পর্শ করা যাবে না৷ তাই বিচ্ছিন্নতা নয়, প্রয়োজন ঐক্য সৃষ্টি করা৷ ফলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির যে ধারণা বুর্জোয়া ব্যক্তিবাদের জন্ম দিচ্ছে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির সেই ধারণাকেই নির্মূল করতে হবে৷ প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার নিজের মধ্যে ব্যক্তি সম্পত্তির পরিবর্তে সামাজিক সম্পত্তির ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷ উৎপাদন ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও উৎপাদনযন্ত্রে ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার তাত্ত্বিক দিকটি প্রতিদিন শোষিত জনসাধারণকে বোঝাতে হবে৷ বিপ্লবকে প্রতিহত করতে পুঁজিবাদ আজনানা ধরনের চক্রান্ত করে চলেছে৷ এই কারণেই পুঁজিবাদ বুর্জোয়া ব্যক্তিবাদকে নানাভাবে উৎসাহিত করে চলেছে, নতুন করে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণার জন্ম দিচ্ছে৷ যার পরিণামে আজকে লক্ষ করা যাচ্ছে মানুষের পরিবারগুলো পর্যন্ত তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে, মানবিক সম্পর্ক ভেঙে পড়ছে, পিতা–পুত্র, মা–ছেলের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ফাটল ধরছে৷ এই অবস্থায় পার্টির ভেতরে বাইরে বুর্জোয়া ব্যক্তিবাদের বিরুদ্ধে তীব্র ভাবগত সংগ্রাম পরিচালনা করেই তাকে নির্মূল করতে হবে৷ ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তিবোধ থেকে উদ্ভূত মানসিকতাই আজ কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভেতরে প্রধান অন্তরায়৷ আধুনিক শোধনবাদ যা বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের কোমর ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছে, তারও ভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তিবাদ৷ মহান স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেতরে এই আধুনিক সংশোধনবাদ মাথা চাডা দিয়ে ওঠে৷ সমাজতন্ত্র আরও উন্নত করব, আরও উচ্চতর রূপ দেব– এই ধরনের গালভরা বুলি আওড়ে আধুনিক সংশোধনবাদীরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে রাশিয়া, চীন ও পূর্ব ইডরোপের বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে প্রতিনিয়ত পুঁজিবাদী চিন্তা–ভাবনা–সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে এবং এরই চূড়ান্ত পরিণামে এই দেশগুলিতে প্রতি বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে এবং পুঁজিবাদ পুনঃস্থাপিত হয়েছে৷
আপনারা অনেকেই জানেন, ক্রুশ্চেভীয় আধুনিক শোধনবাদের আসল চরিত্র, তার পুঁজিবাদী স্বরূপ কমরেড শিবদাস ঘোষই সর্বপ্রথম বিশ্বের সামনে তুলে ধরলেন৷ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হচ্ছে আধুনিক শোধনবাদীরা এই জঘন্য কাজটা করতে পারল কী করে? মহান লেনিন, স্ট্যালিনের প্রতিষ্ঠা করা সোভিয়েত সমাজতন্ত্র, যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রমাগত অগ্রগতির মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্বকে প্রতিদিন চমকিত করেছিল, সমগ্র বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণিকে বিপ্লবের আদর্শে নাড়িয়ে দিয়েছিল তার এই পরিণাম হতে পারল কী করে?
কমরেড শিবদাস ঘোষ ১৯৪৮ সালেই বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের তৎকালীন অভ্যন্তরীণ সমস্যা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন যে, বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে দ্বান্দ্বিক চিন্তা প্রক্রিয়ার পরিবর্তে যান্ত্রিক চিন্তা প্রক্রিয়ার বিপদ দেখা দিয়েছে৷ একটি ঘটনার কথাও এখানে উল্লেখ করতে চাই সোভিয়েট ইডনিয়নে প্রতিবিপ্লব সংগঠিত হওয়ার কিছুদিন পর তদানীন্তন সি পি এস ইউ–র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নীনা আন্দ্রিয়েভা আমাদের আমন্ত্রণে ভারতে এসেছিলেন৷ তাঁর সাথে আমাদের বহু বিষয়ে মত বিনিময় হয়েছে৷ আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, আমাদের সর্বনাশটা ঘটল এই কারণে যে, যাকে তাকে পার্টির সদস্য পদ দেওয়া হয়েছে আর আমরা ভেবেছিলাম আমরা সব পেয়ে গেছি, আমাদের আর পাওয়ার কিছু নেই৷ অর্থাৎ আত্মসন্তুষ্টি আমাদেরকে পেয়ে বসল৷ সঠিকভাবেই উনি বলেছেন যে এই আত্মসন্তুষ্টিও সর্বনাশ ঘনীভূত করার ক্ষেত্রে একটা কারণ হিসাবে কাজ করেছে৷ কিন্তু প্রশ্ন হল এই আত্মসন্তুষ্টির জন্ম হতে পারল কেন? এটা হতে পারল এই কারণেই যে, রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা–কর্মীদের চিন্তা–চেতনার মান যেভাবে ক্রমাগত উন্নত করার দরকার ছিল, তা না হয়ে আপেক্ষিক ভাবে নিম্নগামী হতে শুরু করে৷ মৃত্যুর এক বছর আগে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসে মহান নেতা কমরেড স্ট্যালিনও এই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ বার বার স্মরণ করিয়েছেন যে, চিন্তা–চেতনার মান এক জায়গায় বসে থাকতে পারে না, সমাজের নতুন প্রয়োজন পূরণ করতে জ্ঞান–বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের ভিত্তিতে আমাদের মার্কসবাদীদের কমিউনিস্টদের চিন্তা–চেতনার মানকে উন্নততর স্তরে নিয়ে যেতে হবে, উন্নত ধ্যান–ধারণা এবং উপলব্ধির জন্ম দিতে হবে৷ এই সংগ্রাম অন্তহীন৷ এখানে শিথিলতা এলেই বিপদ দেখা দেবে৷ আপেক্ষিক অর্থে কমিউনিস্ট চেতনার এই নিম্নমানের সুযোগ নিয়েই আধুনিক সংশোধনবাদীরা জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে সমাজতন্ত্রের ভেতর পুঁজিবাদী চিন্তা–ভাবনাকে উস্কে দিতে পারল৷ ফলে প্রতিদিন সোভিয়েত ইডনিয়নে কমিউনিস্ট চিন্তার পরিবর্তে বুর্জোয়া চিন্তা, পুঁজিবাদী চিন্তা, ব্যক্তিগত সম্পত্তির চিন্তা, ব্যক্তিবাদী চিন্তা প্রভৃতি সর্বনাশা চিন্তা–ভাবনা জনসাধারণের মধ্যে শেকড় গাড়তে শুরু করল৷ সোভিয়েত ইউনিয়নে আধুনিক সংশোধনবাদের এই বিপদ সম্পর্কে কমরেড শিবদাস ঘোষ ১৯৫৬ সালেই সোভিয়েত ইডনিয়ন সহ বিশ্বের সকল কমিউনিস্টদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন৷ স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর তাদের বিংশতিতম কংগ্রেসে শুরু হয় এই সংশোধনবাদী প্রক্রিয়া৷
কমিউনিস্ট নামধারী ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে আরম্ভ হয় কমিডনিজম, সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়ে কমিউনিজম বিরোধী কর্মকাণ্ড৷ আমরা সকলেই জানি, এই বিংশতিতম কংগ্রেসের পর এক সভায় কমরেড শিবদাস ঘোষ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন, সি পি এস ইউ–র বিংশতিতম কংগ্রেস আধুনিক সংশোধবাদের সিংহদুয়ার খুলে দিয়েছে৷ চীন বিপ্লবের ক্ষেত্রেও কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছিলেন যে, তীব্র ভাবগত সংগ্রাম পরিচালনা করে যদি এই আধুনিক শোধনবাদকে প্রতিহত করতে না পারা যায় তা হলে সেটা শুধু আধুনিক শোধনবাদ হয়েই থাকবে না, পুঁজিবাদে অধঃপতিত হবে৷ চীনের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হল৷ এই কারণেই বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে আধুনিক সংশোধনবাদের বিপদ সম্পর্কে কমরেড শিবদাস ঘোষের হুঁশিয়ারি এবং তাকে প্রতিহত করার উপায় সম্পর্কে তাঁর অমূল্য শিক্ষা বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য এক দিকনির্দেশ৷
তাই আজকের দিনে যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে হলে কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা যা মার্কসবাদ–লেনিনবাদের আরও উন্নততর উপলব্ধি তাকে ভিত্তি করেই গড়ে তুলতে হবে৷ লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সে–তুঙ মার্কসবাদকে ভিত্তি করেই বিপ্লব সম্পন্ন করেছেন৷ তাই এই দার্শনিকদের শিক্ষাগুলো আমাদের প্রতিনিয়ত চর্চা করতে হবে এবং তার অপরিহার্য অংশ হিসাবে কমরেড শিবদাস ঘোষের যে সমস্ত অবদান মার্কসবাদ–লেনিনবাদের জ্ঞান–ভান্ডারে সংযোজিত হয়েছে সেগুলো আয়ত্ত করার সংগ্রাম করতে হবে৷ কমিউনিস্ট চরিত্র অর্জনের এবং আমৃত্যু এই সংগ্রামে অবিচল থাকার আরেকটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছেন, গভীর এবং প্রখর তত্ত্বজ্ঞান ব্যতিরেকে বিপ্লবী জীবন ধারণ অসম্ভব৷ এ তত্ত্বজ্ঞান যেমন তেমন ভাবে আয়ত্ত করা যাবে– এ রকম নয়৷ এই তত্ত্বজ্ঞান প্রতিদিন নিত্য নতুন রূপে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে৷ মার্কসবাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে, থিয়োরি ইজ টু গাইড প্র্যাকটিস, প্র্যাকটিস ইজ টু ফারদার এনরিচ থিয়োরি৷ অর্থাৎ তত্ত্ব প্রয়োগকে পরিচালনা করবে এবং প্রয়োগের মধ্য দিয়েই তত্ত্বজ্ঞান আরও প্রখর হয়ে ডঠবে৷প্রতিদিন জনগণের মধ্যে গিয়ে তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটাতে হবে এবং তার মধ্য দিয়েই পরীক্ষিত হবে যে আমার তত্ত্বজ্ঞান সঠিকরূপে গড়ে উঠেছে কি না৷ কমরেড শিবদাস ঘোষের আরও বহু মূল্যবান শিক্ষা রয়েছে যার সবটা আজকের এই সভায় আলোচনা করা গেল না৷ আপনাদের, আমাদের সকলকে তাই প্রতিনিয়ত সেইগুলি অধ্যয়ন করতে হবে, অনুসরণ করতে হবে৷ তাঁর স্মরণসভায় এটাই হবে আমাদের অঙ্গীকার৷ (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
(৭১ বর্ষ ১০ সংখ্যা ৫ -১১ অক্টোবর, ২০১৮)