(বিশ্ব সর্বহারা শ্রেণির পথপ্রদর্শক, মহান নেতা কার্ল মার্ক্সের জীবনাবসান ঘটে ১৮৮৩-র ১৪ মার্চ। এই দিনটি আমরা মার্ক্স স্মরণ দিবস হিসেবে উদযাপন করি তাঁর বৈপ্লবিক শিক্ষাগুলিকে বিশেষভাবে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে। এই উদ্দেশ্যেই এ বার মার্ক্সের ১৪৩তম স্মরণ দিবস উপলক্ষে ‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’ থেকে কিছু নির্বাচিত অংশ প্রকাশ করা হল।)
বুর্জোয়া বনাম প্রলেতারিয়েত
‘‘এ পর্যন্ত প্রচলিত সমস্ত সমাজের ইতিহাস (অর্থাৎ সমস্ত লিখিত ইতিহাস) হল শ্রেণি-সংগ্রামের ইতিহাস।
স্বাধীন নাগরিক আর দাস, প্যাট্রিশিয়ান আর প্লিবিয়ান, সামন্তপ্রভু আর ভূমিদাস, গিল্ড-কর্তা আর জার্নিম্যান, এক কথায় অত্যাচারী আর অত্যাচারিতরা সর্বদাই পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে থেকেছে, কখনও প্রকাশ্যে কখনও বা গোপনে বিরামহীন লড়াই চালিয়েছে, আর সে লড়াই প্রতিবারই শেষ হয়েছে হয় গোটা সমাজের বৈপ্লবিক পুনর্গঠনে, নয় তো দ্বন্দ্বরত শ্রেণিগুলির সকলের ধ্বংসের মধ্যে।
ইতিহাসের গোড়ার যুগে আমরা সর্বত্রই প্রায় দেখতে পাই সমাজের একটা জটিল ধরনের বিন্যাস, যাতে ছিল বিভিন্ন বর্গ, ছিল সামাজিক পদ-মর্যাদার নানান ধাপ। প্রাচীন রোমে ছিল প্যাট্রিশিয়ান, নাইট, প্লিবিয়ান আর দাসেরা। মধ্যযুগে ছিল সামন্তপ্রভু, উপ-সামন্ত, গিল্ডকর্তা, জার্নিম্যান, শিক্ষার্থী আর ভূমিদাসরা। এই সমস্ত শ্রেণির প্রায় প্রত্যেকটার মধ্যেই আবার ছিল নানা উপস্তরের ধাপ।
সামন্ততান্ত্রিক সমাজের ধ্বংসাবশেষের ভিতর থেকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা আধুনিক বুর্জোয়া সমাজ শ্রেণি-শত্রুতার অবসান ঘটায়নি। এ শুধু সৃষ্টি করেছে নতুন নতুন শ্রেণি, অত্যাচারের নতুন নতুন অবস্থা, পুরনোর বদলে নতুন নতুন ধরনের সংগ্রাম।
আমাদের যুগ– অর্থাৎ বুর্জোয়া যুগের কিন্তু এই নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যটি রয়েছে– এটা শ্রেণি-শত্রুতাকে সরল করে দিয়েছে। গোটা সমাজ উত্তরোত্তর ভাগ হয়ে পড়ছে সরাসরি পরস্পর সম্মুখীন দুটো বিশাল শত্রুশিবিরে– বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েত। …
উৎপাদনের যন্ত্রপাতিতে (ইনস্ট্রুমেন্টস) অবিরাম বৈপ্লবিক পরিবর্তন না ঘটিয়ে আর তার ফলে উৎপাদন সম্পর্ক এবং সেই সঙ্গে সমাজের গোটা সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন না ঘটিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণি টিকে থাকতে পারে না। পক্ষান্তরে, অতীতে শিল্পক্ষেত্রে সমস্ত শ্রেণির টিকে থাকার প্রথম শর্তই ছিল, পুরনো উৎপাদন পদ্ধতিকে অপরিবর্তিত রূপে জিইয়ে রাখা। আগের সমস্ত যুগের সঙ্গে বুর্জোয়া যুগের পার্থক্য এই যে, এ যুগে উৎপাদনের ক্ষেত্রে অবিরাম বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটছে, সমস্ত সামাজিক সম্পর্কে অনবরত রদবদল ঘটছে, অনিশ্চয়তা আর উত্তেজনা এ যুগে হয়েছে চিরস্থায়ী। সমস্ত অনড, জমাট-বাঁধা সম্পর্ক আর তার আনুষঙ্গিক সনাতন, শ্রদ্ধামণ্ডিত কুসংস্কার আর মতামত পাকাপোক্ত ভাবে দানা বাঁধার আগেই সেকেলে, অচল হয়ে পড়ছে। যা কিছু পাকাপোক্ত তা-ই মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে, যা কিছু পূতপবিত্র তা-ই হয়ে পড়ছে অশ্রদ্ধার বস্তু, অবশেষে মানুষ বাধ্য হচ্ছে তার জীবনের আসল অবস্থা এবং অপরের সঙ্গে তার সম্পর্কটা সাদা চোখে দেখতে।
নিজেদের তৈরি মালের অবিরাম ক্রমবর্ধমান বাজারের তাগিদ বুর্জোয়াদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত। সর্বত্র এদের ঢুঁ মারতে হচ্ছে, সর্বত্র গিয়ে শেকড় গেড়ে বসতে হচ্ছে, সর্বত্র স্থাপন করতে হচ্ছে যোগসূত্র।
বিশ্ববাজারকে কাজে লাগাতে গিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণি প্রত্যেক দেশে উৎপাদন আর ভোগকে একটা বিশ্বজনীন চরিত্র দিয়েছে। যে জাতীয় ভিত্তিভূমির ওপর শিল্প দাঁড়িয়ে ছিল সেই ভিত্তিভূমি শিল্পের পায়ের তলা থেকে সরিয়ে নিয়ে এরা বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে প্রতিক্রিয়াশীলদের। সমস্ত সাবেকি জাতীয় শিল্পকে এরা হয় ধবংস করেছে, নয়ত সেগুলি প্রতিদিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ওই সব শিল্পকে স্থানচ্যুত করছে এমন সব নতুন নতুন শিল্প যার প্রচলন সমস্ত সভ্য জাতির পক্ষেই হয়ে দাঁড়িয়েছে মরণ-বাঁচনের প্রশ্ন। সে সব শিল্পে আর দেশজ কাঁচামালে কাজ চলে না, চলে দূরতম অঞ্চল থেকে আনা কাঁচামালে। সে সব শিল্পে উৎপন্ন জিনিস শুধু মাত্র স্বদেশেই নয়, দুনিয়ার প্রতিটি অঞ্চলে ব্যবহৃত হয়। দেশের মধ্যে তৈরি উৎপাদনে যে সব চাহিদা মিটত সেইসব পুরনো চাহিদার বদলে দেখা দিচ্ছে নতুন নতুন চাহিদা, যা মেটাবার জন্যে দরকার হয় দূর দূর দেশ আর আবহাওয়া থেকে আনা উৎপন্ন দ্রব্য। আগেকার স্থানীয় আর জাতীয় বিচ্ছিন্নতা আর আত্মনির্ভরতার জায়গায় দেখা দিয়েছে সর্বব্যাপী আদান-প্রদান, জাতি সমূহের বিশ্বব্যাপী পরস্পর নির্ভরতা। যেমন বৈষয়িক উৎপাদনের ক্ষেত্রে, ঠিক তেমন ব্যাপারই ঘটেছে মানসিক-উৎপাদনের ক্ষেত্রেও। এক একটা জাতির মানসিক সৃষ্টি পরিণত হচ্ছে সকলের সম্পত্তিতে। জাতিগত একদেশদর্শিতা আর সংকীর্ণচিত্ততা ক্রমশ আরও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অসংখ্য জাতীয় আর স্থানীয় সাহিত্য থেকে জন্ম নিচ্ছে বিশ্বসাহিত্য।
উৎপাদনের সমস্ত যন্ত্রপাতিতে দ্রুত উন্নতি ঘটিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপুল বিকাশসাধন করে বুর্জোয়া শ্রেণি সমস্ত জাতিকে, এমনকি সব চেয়ে বর্বর জাতিকেও সভ্যতার স্তরে টেনে আনছে। যে ভারী কামান দেগে তারা সমস্ত চৈনিক প্রাচীর চূর্ণবিচূর্ণ করেছে, বর্বর জাতিদের তীব্র বিজাতি-বিদ্বেষকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করছে তা হল তাদের উৎপন্ন পণ্যের সস্তা দর। সমস্ত জাতিকে এরা বাধ্য করছে বুর্জোয়া উৎপাদন পদ্ধতি গ্রহণ করতে। অন্যথা তাদের অবলুপ্তির আশঙ্কা থাকে। এরা যাকে বলে সভ্যতা– তা গ্রহণ করতে সমস্ত জাতিকে বাধ্য করছে, অর্থাৎ বাধ্য করছে তাদেরও বুর্জোয়া বনতে। এক কথায় বলা যায় এরা নিজেদের ছাঁচে দুনিয়াকে ঢেলে সাজাচ্ছে।
বুর্জোয়া শ্রেণি গ্রামকে শহরের কর্তৃত্বাধীনে এনেছে। এরা সৃষ্টি করেছে বিরাট বড় বড় শহর। গ্রামের জনসংখ্যার তুলনায় শহরের জনসংখ্যা বিপুল ভাবে বাড়িয়েছে আর এইভাবে জনসংখ্যার একটা উল্লেখযোগ্য অংশকে উদ্ধার করেছে গ্রাম্যজীবনের মূঢ়তা থেকে। এরা যেমন গ্রামকে শহরের ওপর নির্ভরশীল করেছে তেমনি বর্বর আর আধা-বর্বর দেশকে সভ্য দেশের ওপর, কৃষক-প্রধান জাতিকে বুর্জোয়া-প্রধান জাতির ওপর, প্রাচ্যকে পাশ্চাত্যের ওপর নির্ভরশীল করেছে।
জনসমষ্টি, উৎপাদনের উপাদান আর সম্পত্তির বিক্ষিপ্ত অবস্থাটা বুর্জোয়া শ্রেণি উত্তরোত্তর বেশি বেশি করে ঘুচিয়ে দেয়। এরা জনসমষ্টিকে পুঞ্জীভূত করেছে, উৎপাদনের উপাদানকে কেন্দ্রীভূত করেছে, মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পত্তি জড়ো করেছে। এর অনিবার্য ফল হিসাবে দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক কেন্দ্রীভবন। এর ফলে পৃথক স্বার্থ, পৃথক আইনকানুন, পৃথক সরকার এবং পৃথক কর ব্যবস্থা সম্বলিত স্বাধীন বা শিথিল ভাবে সংযুক্ত প্রদেশগুলি মিলে মিশে গিয়ে একই সরকার, একই জাতীয় শ্রেণিস্বার্থ, একই সীমান্ত এবং একই বহিঃশুল্ক ব্যবস্থা সম্বলিত একটা জাতিতে পরিণত হয়।
বুর্জোয়া শ্রেণির আধিপত্যের বয়স একশো বছরও এখনও পূর্ণ হয়নি, কিন্তু এর মধ্যেই তারা উত্তরোত্তর এমন বিপুল এবং অতিকায় উৎপাদনশক্তি সৃষ্টি করেছে যা আগেকার সমস্ত যুগের মিলিত উৎপাদনশক্তির চেয়েও অনেক বেশি। প্রকৃতির শক্তিকে মানুষের আর যন্ত্রপাতির বশে আনা, শিল্প আর কৃষিতে রসায়নের প্রয়োগ, বাষ্পীয় নৌ-চলাচল ব্যবস্থা, রেলওয়ে ও বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ প্রবর্তন, এক একটা গোটা মহাদেশ চাষ-বাসের উপযোগী করে তোলা, নদীর গতি পরিবর্তন করা, মাটি ফুঁড়ে ভেলকিবাজির মতো জনসমষ্টির আবির্ভাব ঘটানো– সামাজিক শ্রমের কোলে যে এমন উৎপাদনশক্তি ঘুমিয়ে আছে এ কথা অতীতের কোনও শতাব্দী কি ভাবতে পর্যন্ত পেরেছিল?
তাই আমরা দেখছি, যে উৎপাদন আর বিনিময়ের উপকরণের বনিয়াদের উপর বুর্জোয়া শ্রেণি নিজেকে গড়ে তুলেছিল, তার উৎপত্তি সামন্ততান্ত্রিক সমাজে। উৎপাদন আর বিনিময়ের এই সমস্ত উপকরণ বিকাশের একটা বিশেষ পর্যায়ে পৌঁছে, যে নিয়মে সামন্ততান্ত্রিক সমাজে উৎপাদন ও বিনিময় হত, ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প আর কৃষির যে সামন্ততান্ত্রিক সংগঠন– এক কথায় সম্পত্তির যে সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল তা ইতিমধ্যে বিকশিত উৎপাদনশক্তির সঙ্গে আর খাপ খাচ্ছিল না। সেগুলি হয়ে দাঁড়িয়েছিল শৃঙ্খল বিশেষ। সে-শৃঙ্খল ভেঙে ফেলার দরকার হয়ে পড়ল। সে-শৃঙ্খল টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলা হল। তাদের জায়গায় আবির্ভাব ঘটল অবাধ প্রতিযোগিতার। আর সেই সঙ্গে এল তাদের উপযোগী সামাজিক আর রাজনৈতিক বিধি-বিধান এবং বুর্জোয়া শ্রেণির অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব।
আজ আমাদের চোখের সামনে অনুরূপ একটা বিকাশধারা চলেছে। আধুনিক বুর্জোয়া সমাজ নিজের উৎপাদন, বিনিময় আর সম্পত্তি-সম্পর্কের ভিত্তিতে ভোজবাজির মতো এক বিপুল উৎপাদন আর বিনিময়ের উপাদান গড়ে তুলেছে– কিন্তু এ সমাজের অবস্থা সেই যাদুকরের মতো যে মন্ত্রবলে পাতালপুরীর শক্তিগুলিকে জাগিয়ে তুলে সেগুলি আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বিগত বহু দশক ধরে শিল্প আর বাণিজ্যের ইতিহাস হল আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আধুনিক উৎপাদন শক্তির বিদ্রোহের ইতিহাস, বুর্জোয়া শ্রেণি আর তার আধিপত্যের শর্ত যে সম্পত্তি-সম্পর্ক, তার বিরুদ্ধে উৎপাদনশক্তির বিদ্রোহের ইতিহাস। যে সব বাণিজ্য-সংকট পালা করে বারে বারে এসে গোটা বুর্জোয়া সমাজের অস্তিত্বটাকেই উত্তরোত্তর বেশি বেশি করে বিপন্ন করে তোলে তার উল্লেখ করলেই যথেষ্ট হবে। এইসব সংকটের সময় বর্তমান উৎপন্ন দ্রব্যের একটা বড় অংশই শুধু নয়, অতীতে সৃষ্ট উৎপাদন শক্তিসমূহের বড় অংশও বারে বারে ধবংস হয়ে যায়। এই সব সংকটের সময় একটা মহামারী দেখা যায় যা অতীতের যুগে অসম্ভব কাণ্ড বলে মনে হত তা হল অতি উৎপাদনের মহামারী। সমাজ যেন অকস্মাৎ ফিরে যায় একটা সাময়িক বর্বরতার মধ্যে। মনে হয় যেন একটা দুর্ভিক্ষ, একটা সর্বব্যাপী ধবংসাত্মক যুদ্ধ জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সব কিছুর জোগান বন্ধ করে দিয়েছে। শ্রমশিল্প আর বাণিজ্য যেন ধবংস হয়ে গেছে। কিন্তু কেন? কারণ সভ্যতা গড়ে উঠেছে বড় বেশি, জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি হয়েছে অতিরিক্ত, শিল্প সৃষ্টি হয়েছে অত্যধিক, বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে অতিমাত্রায়। সমাজের হাতে যে উৎপাদনশক্তি রয়েছে তা বুর্জোয়া সম্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় অবস্থার আর বিকাশ সাধন করতে পারছে না। পক্ষান্তরে, সেগুলি এই অবস্থার পক্ষে অতিরিক্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, এই অবস্থার দ্বারা শৃঙ্খলিত হচ্ছে, আর যখনই সেই শৃঙ্খল তারা ছিঁড়ে ফেলতে যাচ্ছে তখনই গোটা বুর্জোয়া সমাজে তারা আনছে বিশৃঙ্খলা, বুর্জোয়া সম্পত্তির অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলছে। বুর্জোয়া সমাজের পরিবেশে যে সম্পদ সৃষ্টি হয় তাকে কাজে লাগানোর পক্ষে ওই পরিবেশ অতি সংকীর্ণ। বুর্জোয়া শ্রেণি এই সংকট কাটিয়ে ওঠে কী ভাবে? একদিকে উৎপাদনশক্তির বিপুল অংশ তারা বাধ্যতামূলক ভাবে ধবংস করে ফেলে। অন্য দিকে নতুন বাজার দখল করে আর পুরনো বাজারকে আরও বেশি করে শোষণ করে। অর্থাৎ আরও ব্যাপক আরও ধবংসাত্মক সংকটের পথ পরিষ্কার করে দেয় এবং সংকটরোধের উপায় হ্রাস করে।
যেসব অস্ত্র ব্যবহার করে বুর্জোয়া শ্রেণি সামন্ততন্ত্রকে ধূলিসাৎ করেছিল সেইসব অস্ত্র এখন তারই বিরুদ্ধে উদ্যত হয়েছে।
কিন্তু বুর্জোয়া শ্রেণি নিজের মৃত্যুর অস্ত্র যে শুধু নিজে বানিয়েছে তা নয়, যে মানুষ এই অস্ত্র চালাবে সেই আধুনিক শ্রমিক শ্রেণিকে– প্রলেতারিয়েতকেও সে সৃষ্টি করেছে।
যে অনুপাতে বুর্জোয়া শ্রেণি অর্থাৎ পুঁজি বাড়তে থাকে ঠিক সেই অনুপাতে বাড়তে থাকে প্রলেতারিয়েত অর্থাৎ আধুনিক শ্রমিক শ্রেণি। শ্রমজীবী এই মানুষেরা যতক্ষণ কাজ পায় ততক্ষণই শুধু বাঁচতে পারে, আর ততক্ষণই তারা কাজ পায় যতক্ষণ তাদের শ্রমে পুঁজির পরিমাণ বাড়ে।
এই সব শ্রমিকেরা একটু একটু করে খেপে খেপে নিজেদের বেচতে বাধ্য হয়। অন্যান্য বাণিজ্য সামগ্রীর মতোই এরাও একটা পণ্য। কাজেই প্রতিযোগিতার সমস্ত অনিশ্চয়তা এবং বাজারের সমস্ত উত্থানপতনের ধাক্কা এসে পড়ে এদের উপর।
বুর্জোয়া শ্রেণির অস্তিত্ব আর আধিপত্যের অবশ্যপ্রয়োজনীয় শর্ত হল পুঁজি সৃষ্টি এবং বৃদ্ধি। পুঁজির শর্ত হল মজুরি-শ্রম। মজুরি-শ্রম সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করে শ্রমিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতার ওপর। শিল্পের অগ্রগতি বুর্জোয়া শ্রেণি না ভেবেচিন্তেই বাড়িয়ে চলে। এই অগ্রগতির ফলে প্রতিযোগিতার কারণে শ্রমিকদের মধ্যেকার বিচ্ছিন্নতার জায়গায় দেখা দেয় সমিতিতে জোটবদ্ধ হওয়ার দরুন তাদের বিপ্লবী সংহতি। সুতরাং যে বনিয়াদের ওপর দাঁড়িয়ে বুর্জোয়া শ্রেণি উৎপাদন করে এবং উৎপন্ন দ্রব্য ভোগদখল করে, আধুনিক শিল্পের বিকাশ সেই বনিয়াদটাই তার পায়ের তলা থেকে কেটে ফেলে দিচ্ছে। বুর্জোয়া শ্রেণি তাই সর্বোপরি সৃষ্টি করছে তার কবর-খনকদের। বুর্জোয়াদের পতন এবং প্রলেতারিয়েতদের জয়লাভ– দুই-ই সমান অবশ্যম্ভাবী।
প্রলেতারিয়েত এবং কমিউনিস্ট
সমগ্র ভাবে প্রলেতারিয়েতদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্পর্ক কী?
শ্রমিক শ্রেণির অন্যান্য পার্টির প্রতিপক্ষ হিসেবে কমিউনিস্টরা কোনও পৃথক পার্টি গড়ে না। প্রলেতারিয়েতের সমগ্র স্বার্থের থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র কোনও স্বার্থ তাদের নেই।
প্রলেতারিয়ান আন্দোলনকে রূপ দেওয়ার এবং গড়ে তোলার জন্য তারা নিজেদের কোনও সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীগত নীতি খাড়া করে না।
শ্রমিক শ্রেণির অন্যান্য পার্টির সঙ্গে কমিউনিস্টদের তফাৎ শুধু এই–
(১) বিভিন্ন দেশের প্রলেতারিয়েতদের জাতীয় সংগ্রামে তারা জাতি-নির্বিশেষে সমস্ত প্রলেতারিয়েতের সাধারণ স্বার্থটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং সেটাকে সামনে তুলে ধরে।
(২) বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামকে যে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে বিকাশ লাভ করতে হয় তাতে তারা সব সময় এবং সর্বত্র আন্দোলনের সামগ্রিক স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে।
সুতরাং, একদিকে কমিউনিস্টরা বাস্তবে প্রতিটি দেশের শ্রমিক শ্রেণির পার্টিগুলির সবচেয়ে অগ্রসর আর দৃঢ়চেতা অংশ, সেই অংশ যারা অন্য সবাইকে ঠেলে এগিয়ে নিয়ে যায়। অন্য দিকে তত্তে্বর দিক দিয়ে প্রলেতারিয়েতের বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের তুলনায় তাদের এই সুবিধা রয়েছে যে, প্রলেতারিয়ান আন্দোলনের অগ্রগতির ধারা, তার শর্ত, তার চূড়ান্ত সাধারণ ফলাফল সম্বন্ধে তাদের সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে।
অন্যান্য সমস্ত প্রলেতারিয়ান পার্টি আর কমিউনিস্টদের আশু লক্ষ্য একই– প্রলেতারিয়েতদের একটা শ্রেণি হিসেবে সংগঠিত করা, বুর্জোয়াদের আধিপত্য উচ্ছেদ করা, প্রলেতারিয়েত কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা।
কমিউনিস্টদের তত্ত্বগত সিদ্ধান্তগুলি অমুক-তমুক কোনও ভাবী বিশ্বজোড়া সংস্কারকের দ্বারা কল্পিত বা আবিষ্কৃত কোনও ধ্যানধারণা বা নীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি।
যে শ্রেণিসংগ্রাম, যে ঐতিহাসিক আন্দোলন বর্তমানে আমাদের চোখের সামনে ঘটছে, তা থেকে উদ্ভূত প্রকৃত সম্পর্কই শুধু এই তত্ত্ব সাধারণভাবে প্রকাশ করছে। প্রচলিত মালিকানা সম্পর্কের অবসান ঘটানো মোটেই একমাত্র কমিউনিজমেরই বৈশিষ্ট্য নয়।
ঐতিহাসিক অবস্থার রদবদলের ফলে অতীতের সমস্ত মালিকানা সম্পর্কের ঐতিহাসিক রদবদল ক্রমাগত ঘটেছে।
যেমন ফরাসি বিপ্লব সামন্ততান্ত্রিক মালিকানার উচ্ছেদ ঘটিয়েছিল বুর্জোয়া মালিকানার অনুকূলে।
সাধারণভাবে মালিকানার উচ্ছেদ ঘটানো কমিউনিজমের কোনও বৈশিষ্ট্য নয়। কমিউনিজমের বৈশিষ্ট্য হল বুর্জোয়া মালিকানার উচ্ছেদ ঘটানো। কিন্তু শ্রেণি-শত্রুতার ওপর প্রতিষ্ঠিত, স্বল্প সংখ্যক লোকের দ্বারা বহুসংখ্যক লোকের শোষণের ওপর প্রতিষ্ঠিত উৎপাদন ও উৎপন্ন দ্রব্য ভোগদখলের ব্যবস্থার চূড়ান্ত এবং পূর্ণতম প্রকাশ হল আধুনিক বুর্জোয়া ব্যক্তিগত মালিকানা।
এই অর্থে কমিউনিস্টদের তত্ত্বকে সংক্ষেপে এই একটি মাত্র বাক্যে প্রকাশ করা চলে। ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ। …
কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ করা হয় যে তারা দেশ আর জাতিসত্তা বিলোপ করতে চায়।
মেহনতি মানুষের কোনও দেশ নেই। তাদের যা নেই তা আমরা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারি না। প্রলেতারিয়েতকে প্রথমে রাজনৈতিক প্রাধান্য অর্জন করতে হবে, জাতির মধ্যে পরিচালক শ্রেণি হয়ে উঠতে হবে, নিজেকে জাতি হয়ে উঠতে হবে, সেই হিসেবে তখন সে নিজেই হবে জাতি– যদিও কথাটার বুর্জোয়া অর্থে নয়। … যে পরিমাণে একজন ব্যক্তির উপর অন্য একজন ব্যক্তির শোষণ শেষ হবে সেই পরিমাণেই এক জাতির ওপর আর এক জাতির শোষণও শেষ হবে। যে পরিমাণে জাতির মধ্যে শ্রেণি-শত্রুতার বিলোপ ঘটবে সেই পরিমাণে এক জাতির সঙ্গে অন্য জাতির শত্রুতার বিলোপ ঘটবে।…
কমিউনিস্ট বিপ্লব হল চিরাচরিত মালিকানা সম্পর্কের সঙ্গে একেবারে আমূল বিচ্ছেদ। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, এই বিপ্লবের বিকাশের ফলে চিরাচরিত ধ্যানধারণার সঙ্গেও একেবারে আমূল বিচ্ছেদ ঘটে।
কমিউনিজমের বিরুদ্ধে বুর্জোয়াদের আপত্তির প্রসঙ্গ এখানে শেষ করা যাক। উপরে আমরা দেখেছি, শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবের প্রথম ধাপ হল প্রলেতারিয়েতকে শাসক শ্রেণির পর্যায়ে উন্নীত করা, গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ে জয়লাভ করা। বুর্জোয়াদের হাত থেকে সমস্ত পুঁজি ক্রমে ক্রমে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য, রাষ্ট্র অর্থাৎ শাসক শ্রেণি হিসাবে সংগঠিত প্রলেতারিয়েতের হাতে উৎপাদনের সমস্ত উপকরণ কেন্দ্রীভূত করার জন্য, যত দ্রুতগতিতে সম্ভব সমগ্র উৎপাদন-শক্তিকে বৃদ্ধি করার জন্য প্রলেতারিয়েত তার রাজনৈতিক আধিপত্যকে কাজে লাগাবে।…
বিকাশের গতিপথে যখন শ্রেণিবৈষম্য দূর হয়ে যাবে এবং যখন সমস্ত উৎপাদন গোটা জাতির এক বিশাল সমিতির হাতে কেন্দ্রীভূত হবে তখন সর্বসাধারণের ক্ষমতার রাজনৈতিক চরিত্র আর থাকবে না। সঠিক ভাবে বলতে গেলে, রাজনৈতিক ক্ষমতা হল এক শ্রেণির ওপর নির্যাতন চালাবার জন্য অন্য শ্রেণির সংগঠিত ক্ষমতা মাত্র। বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে লড়াই চালাবার সময় অবস্থার চাপে যদি প্রলেতারিয়েত নিজেকে একটা শ্রেণি হিসাবে সংগঠিত করে থাকতে বাধ্য হয়, যদি বিপ্লবের ফলে প্রলেতারিয়েত নিজেকে শাসক শ্রেণিতে পরিণত করে এবং তার ফলে যদি উৎপাদনের পুরনো ব্যবস্থা বলপ্রয়োগে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে তবে সেই ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণিশত্রুতার অস্তিত্বের তথা সাধারণ ভাবে সমস্ত শ্রেণির অস্তিত্বের প্রয়োজনীয় অবস্থা তারা ঝেঁটিয়ে বিদায় করবে। আর তার ফলে শ্রেণি হিসাবে নিজের আধিপত্যের তারা অবসান ঘটাবে।
বিভিন্ন শ্রেণি এবং শ্রেণিশত্রুতার অস্তিত্ব সম্বলিত পুরনো বুর্জোয়া সমাজের স্থান নেবে এমন একটা সমাজ যেখানে প্রত্যেকের অবাধ বিকাশই হবে সকলের অবাধ বিকাশের শর্ত।…”