70 year 27 Issue, 23 Feb 2018
দিনটি ছিল ১৮৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি৷ ওই দিন ‘ম্যানিফেস্টো অব দি কমিউনিস্ট পার্টি’ বা কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহার প্রকাশ মানবজাতির ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা৷ ২৩ পৃষ্ঠার ছোট্ট এই পুস্তিকাটিতে মহান দার্শনিক মার্কস ও এঙ্গেলস উপস্থিত করেছেন এমন একটি ঘোষণা যা মানবসভ্যতার গতিপথ কোন দিকে তা সর্বপ্রথম বিজ্ঞানসম্মতভাবে নির্দেশ করে দেয়৷ কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো হচ্ছে বৈজ্ঞানিক কমিউনিজমের প্রথম কর্মসূচিগত দলিল৷ ১৮৪৩ সাল থেকে ১৮৪৭ সালের মধ্যে তাঁরা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানে ও বাস্তব অভিজ্ঞতায় যা কিছু আয়ত্ত করেছেন, সমগ্র শ্রমিক শ্রেণির অভিজ্ঞতা সহ সমস্তই সূত্রবদ্ধ করেছেন এই ম্যানিফেস্টোতে৷ ইস্তাহারে তাঁরা উপস্থিত করেছেন তাঁদের তত্ত্বের ভিত্তি– দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, অর্থনীতি বিজ্ঞান, শ্রেণি সংগ্রামের শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারণার নির্যাস৷ কমিউনিজম সম্পর্কে মিথ্যা ও কুৎসা, রূপকথা ও কল্পকাহিনীর বিরোধিতা করে তাঁরা সাহসের সাথে ও খোলাখুলি ঘোষণা করেছেন শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামের গতিমুখ ও লক্ষ্য৷ কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীরা যেখানে শ্রমিক শ্রেণিকে মনে করত সমাজের ক্ষত, সেখানে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো শ্রমিক শ্রেণির মধ্যেই দেখাল সেই অমোঘ শক্তির অবস্থান, যা শোষণ, নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক বুর্জোয়া ব্যবস্থা উচ্ছেদ করার ক্ষমতা রাখে৷
বিশ্বের প্রথম কমিউনিস্ট সংগঠন কমিউনিস্ট লিগ–এর দ্বিতীয় কংগ্রেসে গৃহীত সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো৷ কমিউনিস্ট লিগ ছিল ১৮৪০–এর দশকের শুরুতে গঠিত ‘লিগ অফ জাস্ট’–এর পরিবর্তিত রূপ৷ লিগের কর্মকর্তারা নানা ধরনের কাল্পনিক সাম্যের চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন৷ মার্কস এবং এঙ্গেলসের জন্যই এই সংগঠনের মধ্যে বৈজ্ঞানিক কমিউনিজমের চিন্তার প্রভাব পড়ে৷ এই সংগঠনের নেতারা মার্কস–এঙ্গেলসের চিন্তার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নেন এবং তাঁদের পরামর্শেই সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে কমিউনিস্ট লিগ করা হয়৷ কমিউনিস্ট লিগের দ্বিতীয় কংগ্রেসে মার্কস যে প্রস্তাব রাখেন সেটাই সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় এবং কংগ্রেস সংগঠনের ইস্তাহার বা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য লেখার জন্য মার্কস ও এঙ্গেলসকেই দায়িত্ব দেয়৷ বৈজ্ঞানিক কমিউনিজমের প্রথম কর্মসূচিগত এই দলিলটি মার্কস ও এঙ্গেলসের যৌথ সৃষ্টি৷ তবু আমরা বৈজ্ঞানিক কমিউনিজমের তাত্ত্বিক রূপকে ‘মার্কসবাদ’ হিসাবে বলি কেন? এর উত্তর দিয়েছেন এঙ্গেলস ম্যানিফেস্টোর ১৮৮৮ সালের ইংরাজি সংস্করণের মুখবন্ধে৷ তিনি বলেছেন, ‘‘ম্যানিফেস্টো আমাদের যৌথ সৃষ্টি৷ কিন্তু আমাকে স্বীকার করতেই হবে মূল প্রস্তাবনাটি যা এই রচনার মর্মবস্তু গঠন করেছে তা মার্কসেরই৷… আমি এ বিষয়ে স্বাধীন ভাবে যতটা অগ্রসর হতে পেরেছিলাম তা আমার ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা’ রচনাতেই সবচেয়ে ভালো ভাবে প্রতিভাত৷ কিন্তু ১৮৪৫ সালের বসন্তে ব্রাসেলসে আবার যখন মার্কসের সঙ্গে দেখা করলাম দেখলাম তিনি ইতিমধ্যে এটি প্রস্তুত করে ফেলেছেন৷ তিনি একেবারে পরিষ্কার ভাবে বিষয়টি আমার কাছে রাখলেন যেমনটি আমি এখানে উপস্থিত করেছি৷’’
মার্কসের এই প্রস্তাবটি ছিল এইরকম– প্রত্যেকটি ঐতিহাসিক পর্বে উৎপাদন ও বন্টনের পদ্ধতি এবং তার থেকে অবশ্যম্ভাবীরূপে উৎসারিত সমাজ সংগঠনগুলো তৈরি করে সমাজের ভিত্তি, যার উপর গড়ে ওঠে সেই যুগের রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক বিকাশের ইতিহাস; তাই মানবসমাজের ইতিহাস হল শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস (আদিম সাম্যবাদী সমাজের ভাঙনের পর)৷ শ্রেণি সংগ্রামের এই ইতিহাস আজকে এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছে যে, আজকের দিনের শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণি প্রোলেতারিয়েত সমগ্র সমাজকে শোষণ, নিপীড়ন ও শ্রেণি বৈষম্য থেকে মুক্ত না করে নিজের মুক্তি আনতে পারে না৷
এই মৌলিক চিন্তার প্রকাশ আমরা ম্যানিফেস্টোর শুরু থেকেই দেখি৷ প্রথম অধ্যায়েই রয়েছে শ্রেণি সংগ্রামের ভূমিকা৷ এখানে এই গ্রন্থের লেখকরা দেখালেন – গোড়ার দিকে সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পুঁজিবাদ সমাজের পরিবর্তন করেছিল বৈপ্লবিক পদ্ধতিতে৷ শুরুতে পুঁজিবাদ ছিল প্রগতিশীল, কিন্তু এখন অনিবার্যভাবেই পুঁজিবাদ হতে চলেছে সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে অধিক থেকে অধিকতর মাত্রায় একটি অন্তরায়৷ তার সুনিশ্চিত প্রমাণ – অর্থনৈতিক সংকট ও যুদ্ধ, যাতে উৎপাদনের শক্তিগুলি ব্যাপকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে৷
এরপর তাঁরা বিশ্লেষণ করে দেখালেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মজুরি দাসত্বের মূল কথা এবং বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে প্রোলেতারিয়েতের সংগ্রামের পৃথক পৃথক পর্বগুলো৷ তাঁরা দেখালেন পুঁজিবাদী শিল্পের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অনিবার্যভাবেই প্রলেতারিয়েতের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে এবং প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়াদের মধ্যে বিরোধিতা ও শ্রেণি সংগ্রাম তীব্র হয়৷ বুর্জোয়াদের উচ্ছেদ করবে যে শ্রেণি সেই আধুনিক শ্রমিক শ্রেণি বা প্রলেতারিয়েতকে সৃষ্টি করেছে বুর্জোয়ারাই৷ প্রলেতারিয়েত নিজেদের সংগঠিত করে শ্রেণি সংগ্রামে৷ তারা রাজনৈতিকভাবে বিকশিত হয় এবং তাদের বৈপ্লবিক ঐক্যের মধ্যে যে সম্ভাবনা ও শক্তি নিহিত রয়েছে সে সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে৷ পরিশেষে শ্রেণি সংগ্রাম বিকশিত হয়ে পরিণতি লাভ করে গৃহযুদ্ধে– পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে৷ যে গৃহযুদ্ধ ফেটে পড়ে প্রকাশ্য বিপ্লবে এবং বুর্জোয়াদের উচ্ছেদ সাধনের মধ্য দিয়ে প্রলেতারিয়েতের শাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয়৷
ইস্তাহারে মার্কস ও এঙ্গেলস শ্রমিক শ্রেণিকে সুনির্দিষ্ট ভাবে দেখালেন যে, পুঁজিবাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী৷ শ্রমিক শ্রেণির কর্তব্য পুঁজির বিরোধিতা ও বুর্জোয়াদের উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে বৈপ্লবিক সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়া৷ শ্রমিক শ্রেণিকে তার নিজ শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোন উপায় ও পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে– তার পথনির্দেশ দিলেন তাঁরা৷
তাঁরা দেখালেন যে, শ্রমিক শ্রেণির দ্বারা সংঘটিত বিপ্লবের ‘‘প্রথম পদক্ষেপটি হবে শাসকশ্রেণির অবস্থানে প্রলেতারিয়েতকে তুলে আনা,’’ অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা৷ সাথে সাথে তাঁরা ‘‘শাসকশ্রেণির অবস্থানে প্রলেতারিয়েতকে তুলে আনার প্রকৃত গণতান্ত্রিক চরিত্রের উপর জোর দিয়ে বললেন যে এ হচ্ছে ‘‘গণতন্ত্রের যুদ্ধ জয়, ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু শোষকদের উপর শ্রমজীবী জনসাধারণের শাসন কায়েম৷’’ এ প্রসঙ্গে পরবর্তীকালে লেনিন বলেছিলেন, এভাবেই মার্কস ও এঙ্গেলস রূপায়িত করেছেন রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসবাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ধারণা, – ‘প্রলেতারিয় একনায়কত্বের’ ধারণা৷
কিন্তু শ্রমিকশ্রেণি কোন লক্ষ্য পূরণের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করবে? ইস্তাহার ঘোষণা করল, ‘‘প্রলেতারিয়েত তার রাজনৈতিক আধিপত্য ব্যবহার করবে বুর্জোয়াদের হাত থেকে পুঁজি ছিনিয়ে নিতে– রাষ্ট্রের হাতে, অর্থাৎ শাসক শ্রেণি হিসাবে সংগঠিত প্রলেতারিয়েতের হাতে উৎপাদনের সকল হাতিয়ার কেন্দ্রীভূত করতে, সমগ্র উৎপাদন শক্তি যতটা সম্ভব দ্রুত বাড়িয়ে তুলতে৷’’
সাথে সাথে শ্রমিক শ্রেণিকে সতর্ক করে দিয়ে তাঁরা বললেন, অর্থনৈতিক রূপান্তরের পরে অবশ্যই সমাজের সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শগত জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন চাই৷ তাঁরা লিখলেন, ‘‘কমিউনিস্ট বিপ্লব হল চিরাচরিত সম্পত্তি সম্পর্কের সঙ্গে একেবারে আমূল বিচ্ছেদ; এই বিপ্লবের বিকাশে চিরাচরিত ধারণার সঙ্গেও একেবারে আমূল একটা বিচ্ছেদ নিহিত, তাতে আর আশ্চর্য কী৷’’
এইভাবে কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহার শ্রমিক শ্রেণির সামনে রেখেছে সমাজের বৈষয়িক ও চিন্তাগত জীবনের পরিবর্তন সাধন করার ও সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার মহান লক্ষ্য৷ মার্কস ও এঙ্গেলস বললেন, ‘‘শ্রেণি ও শ্রেণিবিরোধ সংবলিত পুরানো বুর্জোয়া সমাজের স্থান নেবে এমন এক সমাজ যার মধ্যে প্রত্যেক মানুষেরই স্বাধীন বিকাশ হবে সকলের স্বাধীন বিকাশের শর্ত৷’’ সমাজতন্ত্র মানুষের সামনে তুলে ধরে এক নতুন যুগ, যেখানে মানুষ এই প্রথম হয়ে ওঠে প্রকৃত অর্থেই মানবিক৷
ইস্তাহারে মার্কস ও এঙ্গেলস তুলে ধরলেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মূলনীতি৷ যদি শ্রমিক শ্রেণিকে ইতিহাস ও জাতির প্রতি নিজ দায়িত্ব পালন করতে হয়, তাহলে তার চাই মতাদর্শগত দিক থেকে আলোকপ্রাপ্ত সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত একটি পার্টি৷ এই পার্টি শ্রমিক শ্রেণিরই অংশ, কারণ কমিউনিস্টদের ‘‘সমগ্রভাবে প্রোলেতারিয়েতের স্বার্থ থেকে বিচ্ছিন্ন স্বতন্ত্র কোনও স্বার্থ নেই৷’’ কিন্তু পার্টি অবশ্যই তার অন্তর্ভুক্ত সমাবেশে ঐক্যবদ্ধ করবে শ্রমিক শ্রেণির সেরা উপাদান ও গুণাবলী৷ পার্টি হচ্ছে প্রোলেতারীয় জনতার সংগঠন ও সচেতন অগ্রবাহিনী৷ পার্টি থাকে সংগ্রামের পুরোভাগে৷ পার্টি শ্রেণিকে নেতৃত্ব দেয়, শ্রমিকদের বিপ্লবী পার্টি এই কাজটি করতে পারে কারণ এই পার্টির আছে ‘‘শ্রমিক শ্রেণির অধিকাংশের তুলনায় এই সুবিধা যে, শ্রমিক আন্দোলনের এগিয়ে যাওয়ার পথ, শর্ত এবং শেষ সাধারণ ফলাফল সম্বন্ধে তার স্বচ্ছ বোধ রয়েছে৷’’
তাঁরা আরও দেখালেন, প্রোলেতারিয়েতকে সাফল্যের সঙ্গে চালনা করা যদি শ্রমিক শ্রেণির পার্টির অভিপ্রায় হয়, তাহলে পার্টি কখনও সংকীর্ণতাকে আশ্রয় করে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে না, পার্টি থাকবে জনগণের সঙ্গে গভীর সম্পর্কে সম্পর্কিত, পার্টির ভিত্তি হবে জনগণ, পার্টি শিক্ষা নেবে জনগণের অভিজ্ঞতা থেকে৷ সাথে সাথে পার্টিকে অবশ্যই বুর্জোয়া মতাদর্শের বিরুদ্ধে, শ্রমিক শ্রেণির উপরে বুর্জোয়া মতাদর্শের প্রভাবের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে৷ এইজন্যই ইস্তাহারে প্রজ্ঞা ও শ্লেষের সাথে বিভিন্ন প্রকারের বুর্জোয়া মতাদর্শ এবং নানা ধরণের অবৈজ্ঞানিক ও কাল্পনিক সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট ‘তত্ত্ব’ ও ‘ব্যবস্থা’র সমালোচনা করা হয়েছে৷
শ্রমিক বিপ্লবের আন্তর্জাতিক চরিত্রও তাঁরা দেখালেন৷ ইস্তাহারে তাঁরা দেখালেন যে, কমিউনিস্টরা ‘‘বিভিন্ন দেশের প্রোলেতারিয়েতের জাতীয় সংগ্রামে … জাতি নির্বিশেষে সারা প্রোলেতারিয়েতের সাধারণ স্বার্থের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তাকেই সামনে টেনে আনে৷’’ শ্রমিক অন্দোলনের ঐক্য রক্ষা করা এবং একটি একক দেশের শ্রমিকদের কর্তব্যের সঙ্গে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে একীভূত করার প্রয়োজনের উপর তাঁরা বিশেষ জোর দিলেন৷
পরিশেষে তাঁরা আসন্ন বৈপ্লবিক সংগ্রামে (১৮৪৮ সালের বিপ্লব) জার্মান শ্রমিক শ্রেণিকে দিলেন অভ্রান্ত গাইড লাইন –‘‘জার্মানিতে বুর্জোয়ারা যখন বিপ্লবী অভিযান করে তখনই কমিউনিস্টরা তাদের সাথে একসঙ্গে লড়ে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র, সামন্ত জমিদারতন্ত্র ও পেটি বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে৷ কিন্তু বুর্জোয়া ও প্রোলেতারিয়েতের মধ্যে যে বৈরি ও বিরোধিতা বর্তমান তাকে যথাসম্ভব স্পষ্টভাবে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে সঞ্চার করার দায়িত্ব থেকে তারা মুহূর্তের জন্যও বিরত হয় না… যাতে, জার্মানিতে প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণিগুলির পতনের পর বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধেই লড়াই শুরু হতে পারে৷’’
ইস্তাহারের প্রতিটি লাইন ছিল খোলাখুলি পক্ষপাতিত্ব ও বিপ্লবী আবেগে উজ্জীবিত৷ অবশ্যই এই পক্ষপাতিত্ব ছিল শ্রমিক শ্রেণির প্রতি, যে শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির পথের সন্ধান শুরু করেছিলেন মার্কস ও তাঁর ঘনিষ্ঠতম সহযোদ্ধা এঙ্গেলস চল্লিশের দশকের গোড়া থেকে৷ এই পথ সন্ধানের প্রক্রিয়াতেই দর্শন, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, ইতিহাস তত্ত্ব, সাথে সাথে সমাজতন্ত্রবাদ ও কমিউনিজমের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানের সর্বশেষ জানার বিষয়গুলি তাঁরা আয়ত্ত করেছিলেন৷ এই সমস্ত ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রসর ধারণাগুলিকে তাঁরা বিশ্লেষণ করেছিলেন ইতিহাস ও সমকালীন সামাজিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে৷ আবিষ্কারের এই সম্মুখগামী প্রক্রিয়ায় তাঁরা যথাযথ বৈজ্ঞানিক প্রমাণের মধ্য দিয়ে বৈপ্লবিক তত্ত্বকে উন্নীত করেছিলেন সম্পূর্ণ নতুন স্তরে, গড়ে তুলেছিলেন বৈজ্ঞানিক কমিউনিজমের তত্ত্বগত ভিত্তি এবং সর্বহারা বিপ্লবের রণকৌশল ও কর্মসূচিগত রূপরেখা৷ তারই প্রকাশ ঘটেছে কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহারে৷
এই ছোট রচনাটি প্রকাশের সাথে সাথে গোটা ইউরোপে তার প্রভাব পড়তে থাকে৷ সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম সম্পর্কে নানা ধরনের বিভ্রান্তির মধ্য থেকে সঠিক রাস্তা দেখালো ইস্তাহার৷ শোষণ মুক্তির স্বপ্ন দেখা মানুষগুলি সঠিক পথের সন্ধান পেলেন৷ যে কারণে ইস্তাহার পড়া এবং এর মধ্যে নিহিত বৈপ্লবিক চিন্তাকে অনুধাবন করার জন্য একটা প্রবল আগ্রহ তৈরি হল৷ কয়েক বছরের মধ্যেই ইউরোপের প্রায় সমস্ত প্রধান ভাষায় এটা অনুদিত হয়ে গেল৷ যত দিন গেছে ততই বেড়েছে এর প্রভাব৷ তাই এঙ্গেলস বলেছিলেন, ‘‘আধুনিক শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের বেশিরভাগ অংশ ম্যানিফেস্টোর ইতিহাসের মধ্যে প্রতিফলিত৷ বর্তমানে সন্দেহাতীত ভাবে এটি সর্বাধিক প্রচারিত, সমস্ত সমাজতান্ত্রিক সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক৷ সাইবেরিয়া থেকে ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষের সাধারণ মঞ্চ এই ইস্তাহার’’৷
ম্যানিফেস্টো আজও একই ভাবে শ্রমিকশ্রেণিকে প্রভাবিত করে চলেছে৷ যদিও এর মাঝখানে বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলন সংকটে আচ্ছন্ন হয়েছে, পতন হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপ এবং চিনের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের, ভেঙে গেছে শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক শিবির৷ বিজয়োল্লাসে মত্ত পুঁজিবাদ–সাম্রাজ্যবাদের রক্ষাকর্তারা, তবু ম্লান হয়নি ম্যানিফেস্টোর উজ্জ্বল ভূমিকা৷ পুঁজিবাদ–সাম্রাজ্যবাদের সংকট আজ এতটাই গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী যে, একটা দিনের জন্য তো দূরের কথা, একটা মুহূর্তের জন্যও স্বস্তিতে দিন কাটাতে পারছে না কোনও মানুষ৷ বেকারি, ছাঁটাই, মূল্যবৃদ্ধি ও সামাজিক অবক্ষয়ের ভারে ন্যুব্জ শ্রমিক–কৃষক–মেহনতি জনসাধারণ আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছে এশিয়া–আফ্রিকা থেকে শুরু করে ইউরোপ–আমেরিকার নগরে বন্দরে, প্রান্ত প্রত্যন্তে৷ আদর্শগত বিভ্রান্তি বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করে দিয়েছে, শক্তি দিয়ে পথ দেখাতে পারে কমিউনিস্ট ইস্তাহার৷ এর গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা তাই অম্লান৷ (ক্রমশ)