৪ জুন হাওড়ার শরৎসদনে অনুষ্ঠিত স্মরণসভায় সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের ভাষণ প্রকাশ করা হল৷
প্রিয় কমরেড হারানোর গভীর বেদনায় ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমাকে কিছু বলতে হচ্ছে৷কাজটা খুব কঠিন৷ বিশেষত আমরা যারা বয়োজ্যেষ্ঠ, তারা যখন কনিষ্ঠ কমরেডদের মৃত্যুজনিত বেদনার সম্মুখীন হই সেটা হয়ে দাঁড়ায় আরও দুঃসহ৷তবে আমি ঠিক করেছি, আমার আবেগ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও সংযত করে আপনাদের কাছে কিছু বলার চেষ্টা করব৷
আপনারা জানেন, আমাদের দলটা নিছক একটা দল নয়৷মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ সম্পূর্ণ ভিন্ন লক্ষ্য, ভিন্ন পদ্ধতিতে মার্কসবাদ–লেনিনব আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং উচ্চতর বিপ্লবী সংস্কৃতির আধারে এই দলটিকে গড়ে তুলেছিলেন একদল সম্পূর্ণ নতুন মানুষ তৈরি করার জন্য৷ আজকের দিনের সর্বাত্মক অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে তিনি আমাদের মনুষ্যত্ব অর্জনের নতুন পথ দেখিয়েছেন৷ তাঁর শিক্ষায় আমাদের যে কাজ, সেই কাজ উচ্চতর হৃদয়বৃত্তির কাজ, ভালবাসার কাজ৷ জনগণের প্রতি ভালবাসা থেকেই, শোষিত জনগণের মুক্তির স্বার্থেই আমাদের দলের বিপ্লবী আন্দোলন৷ আজ যখন সামাজিক মূল্যবোধের প্রবল সংকটে পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন ভেঙে পড়ছে, প্রেম–ভালবাসা ধূলিসাৎ হচ্ছে সেখানে আমাদের গোটা দলটাই একটা পরিবারের মতোই একটা উন্নত ধরনের সর্বহারা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নতুন ধরনের ভালবাসার সম্পর্কে সকলেই সম্পর্কিত হয়ে গড়ে উঠছে৷ এই পরিবারের কোনও কনিষ্ঠ সদস্য, যাঁর বিপ্লবী আন্দোলনে আরও অনেক দেওয়ার ছিল, তাঁকে যখন হারাই, সেটা আরও বেদনাদায়ক হয়৷
আমি জানি প্রয়াত কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্যকে নামে আপনারা সকলেই জানেন৷ তিনি কোন দায়িত্বে ও কোন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তাও আপনারা জানেন৷ কিন্তু মুষ্টিমেয় কিছু নেতা এবং কর্মী ছাড়া বাকি অনেকের সাথেই তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচয়ের সুযোগ হয়নি৷ এ দায়িত্ব আমার৷ আজ খুবই দুঃখ হচ্ছে৷ শিবপুর পার্টি সেন্টারে তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রথম শুনে একজন জুনিয়র কমরেড সুস্মিতা তাঁর মৃত্যুর পর আমাকে প্রশ্ণ করেছিলেন, কেন প্রণতিদিকে অন্যত্র আলোচনার জন্য পাঠালেন না, এত সুন্দর সহজ সরলভাবে বুঝিয়ে দেন যে অন্তর স্পর্শ করে এই আক্ষেপ আমারও৷ আমি সবে ভাবছিলাম, বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রাজ্যে তাঁকে পাঠাব৷ সবাই এই চরিত্র জানবে, চিনবে, বুঝবে৷ তখনই ওঁর এই ভয়ঙ্কর অসুখ ধরা পড়ে৷ ফলে আর সুযোগ পেলাম না৷ এখন ভাবছি আরও আগে কেন এই উদ্যোগ নিলাম না৷
আপনাদের অনেকের কাছেই যে অপরিচিত প্রণতি ভট্টাচার্য, তাঁকে কিছুটা পরিচিত করার জন্যই আজ আমি কিছু কথা বলব৷ শোক প্রস্তাবে যে সব বক্তব্য উল্লিখিত হয়েছে, বাংলাদেশের বিপ্লবী নেতা কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর মর্মস্পর্শী বক্তব্যে যে সব কথা পরিস্ফুট হয়েছে সেগুলির সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত৷ আমি যা কিছু বলব, তাঁর সম্পর্কে আমার যে ধারণা গড়ে উঠেছে, আবার যারা তাঁকে চিনত, জানত তাদের থেকেও আমি বক্তব্য সংগ্রহ করেছি, আমার ধারণা ঠিক কি না যাচাই করে নিয়েছি এবং তাঁর সম্পর্কে জানা ছিল না এমন কিছু নতুন তথ্যও আমি পেয়েছি৷ সবটা বলতে পারব কি না আমি জানি না৷ আমি চেষ্টা করব৷ এটাও বলা দরকার, পুরুলিয়া জেলায় আমি খুব কম যেতাম, ছাত্রদের মিটিংয়ে অনেকের মধ্যে তাঁকে দেখতাম৷ কিন্তু কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্যকে জানতে বুঝতে আমারও সময় লেগেছে৷ আমার পূর্ববর্তী নেতারা, যাঁরা নিয়মিত যেতেন তাঁরা ওঁকে ভালবাসতেন, স্নেহ করতেন৷ হয়ত তখনও তাঁর গুণাবলি পরিস্ফুট হয়নি বা তাঁদের কাছে প্রতিভাত হয়নি৷
কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্যের শৈশব, কৈশোর, যৌবন পশ্চিমবাংলার একটা অন্য পরিবেশে অতিবাহিত হয়েছে৷ তখনও বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট মুভমেন্টের প্রভাব ছিল, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের জোয়ারও ছিল, পশ্চিমবাংলাতেও বামপন্থার প্রভাব ছিল৷ এটা ১৯৬৬–৬৭–৬৮ সালের কথা আমি বলছি৷ কমরেড রণজিৎদা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, সবচেয়ে অনুন্নত জেলা পুরুলিয়ার কাশীপুরে অনুন্নত এবং অপরিচিত আহাত্তর গ্রামের গরিব পরিবারে তাঁর জন্ম৷ যে ভাবেই হোক, এই পরিবারে নবজাগরণের প্রভাব, স্বদেশি আন্দোলনের প্রভাব এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রভাব ছিল৷ বাবা–মায়ের প্রতি প্রণতি ভট্টাচার্য খুব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন৷ তাঁরা উন্নত রুচিসম্পন্ন ছিলেন৷ বাড়িতে সাহিত্য চর্চা এবং সঙ্গীতের পরিবেশ ছিল৷ এই পরিবেশেই তাঁর মনন গড়ে উঠেছিল৷ পুরুলিয়ায় পার্টি সংগঠন গড়ে তোলেন প্রয়াত নেতা কমরেড প্রীতীশ চন্দ৷ একদিকে আদ্রাতে রেলের মাধ্যমে যোগাযোগ বের করেছিলেন, অন্য দিকে আড়ষা–বাঘমুণ্ডিতেও তিনি সংগঠন গড়ে তুলেছেন৷ পুরুলিয়া জেলার পূর্বতন সম্পাদক কমরেড নির্মল মণ্ডলের মাধ্যমেই কমরেড প্রীতীশ চন্দের সান্নিধ্য পান কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য৷ আমার সাথে তাঁর প্রথম পরিচয় হয় ১৯৬৮ সালে৷ আমি ডিএসও–র একটা ছাত্র বৈঠক উপলক্ষে তখন মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে গিয়েছিলাম৷ কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য সেই বৈঠকে কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে আসেন৷ দারিদ্র্যের জন্যই তাঁকে এখানে দিদির বাড়িতে পড়তে পাঠানো হয়৷ তাঁর চোখমুখের মধ্যে একটা নিষ্ঠার ছাপ, কিছু করার একটা মানসিকতা আমি লক্ষ করেছিলাম, এর চেয়ে বেশি কিছু বুঝিনি৷ সে সময়ে জিয়াগঞ্জে পার্টি সংগঠন খুবই দুর্বল ছিল৷ তৎকালীন মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক প্রয়াত কমরেড প্রাণগৌর বসাককে আমি বলেছিলাম যে এঁকে একটু যত্ন করুন৷ কারণ স্থানীয় নেতৃত্ব এটা পারবে না৷ তারপর কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য পুরুলিয়া চলে আসেন৷ ছাত্রদের প্রোগ্রামে মাঝে মাঝে আমি তাঁকে দেখেছি৷ আমার যাতায়াত খুব কম ছিল৷ তখন প্রয়াত কমরেড সুকোমল দাশগুপ্ত পুরুলিয়া জেলা দেখতেন৷ কমরেড রণজিৎ ধরও মাঝেমাঝে যেতেন৷ পরে প্রয়াত কমরেড আশুতোষ ব্যানার্জীও যেতেন৷ কিন্তু যেটা তাঁর বৈশিষ্ট্যের দিক, সবাই তাঁকে খুব একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবেই দেখত, স্নেহ করত, ভালবাসত৷ সাধারণত একদল কমরেড নেতাদের কাছাকাছি আসে, কথাবার্তা বলে, ঘনিষ্ঠতা চায়৷ কিন্তু কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য মিটিংয়ে আসতেন, শুনতেন, একাগ্রভাবেই শুনতেন, নিষ্ঠার সাথে কাজও করতেন৷ কিন্তু নেতাদের খুব কাছাকাছি আসা, ঘনিষ্ঠ হওয়া– এটা তাঁর অভ্যাসে ছিল না৷ বোধহয় এই কারণেই তৎকালীন নেতাদের দৃষ্টিতে তাঁর বৈশিষ্ট্যগুলো ধরা পড়েনি৷ এরপর আমি যখন রাজ্য সম্পাদক নির্বাচিত হই, কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য তখন পুরুলিয়া জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন৷ আর আমি আগে যতটা জেলায় জেলায় ঘুরতাম, কমরেডরা জানেন, রাজ্য সম্পাদক থাকাকালীন আমি সেইভাবে ঘুরিনি৷ কমরেড নীহার মুখার্জী সাধারণ সম্পাদক হওয়া থেকেই অসুস্থ ছিলেন, আর তখন একটানা আন্দোলন চলছে পশ্চিমবাংলায়, সিপিএমের আক্রমণে বহু কমরেড নিহত হচ্ছেন, শহিদ হচ্ছেন৷ এর মধ্যেই আমি অনেকখানি কলকাতাকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছিলাম৷ ২০০২–০৩ সালে আমি পুরুলিয়া জেলার সাংগঠনিক সমস্যা নিয়ে জেলা কমিটির মিটিংয়ে উপস্থিত হয়ে এই প্রথম লক্ষ করি তাঁর সাংগঠনিক বাস্তব বুদ্ধি, জুনিয়ার কমরেডদের সম্পর্কে কনসার্ন, সিনিয়ার কমরেডদের সাথে মতপার্থক্য প্রকাশে একদিকে যুক্তিপূর্ণ বলিষ্ঠতা, অন্য দিকে নম্রতা৷ এই বৈঠকে আমি এসব লক্ষ করে প্রথম আকৃষ্ট হই৷ তাঁর সম্পর্কে একটা প্রত্যাশাও গড়ে ওঠে৷ এরপর পুরুলিয়ার সংগঠনে নানা সমস্যা চলছিল৷ তৎকালীন জেলা সম্পাদক অসুস্থ ছিলেন৷ কী করা যায় আমরা নেতারা ভাবছি৷ এই সময়ে ২০০৬ সালে আমি প্রস্তাব রাখি, প্রণতি ভট্টাচার্যকে জেলার দায়িত্ব দিন৷ আমাদের নেতৃস্থানীয় সিনিয়ার কমরেডরা ওঁকে খুব ভালবাসতেন, স্নেহ করতেন৷ কিন্তু তাঁদের মধ্যে প্রশ্ন ছিল, অন্য সিনিয়াররা, যাঁদের অধীনে উনি কাজ করতেন, জুনিয়ার হয়ে তাঁদের নেতা হিসাবে এ দায়িত্ব পালন করতে পারবেন কি না৷ শেষপর্যন্ত তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শ্রদ্ধেয় কমরেড নীহার মুখার্জীর মতামত নিই৷ সব শুনে তিনি সম্মতি জ্ঞাপন করেন৷ এর পর জেলা সম্পাদক হিসাবে সিনিয়ার–জুনিয়ার সকলকেই জয় করে যে দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন তা খুবই উল্লেখযোগ্য এবং প্রশংসনীয়৷ এর আগে পুরুলিয়া জেলায় কাজকর্মে দুই প্রান্তের মধ্যে কোনও সংযোগ ছিল না৷ কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য সম্পাদক থাকাকালীন প্রথম দুইটি প্রান্তকে যুক্ত করে একটা ঐক্যবদ্ধ জেলা কমিটির নেতৃত্বে সংগঠন পরিচালিত হতে থাকে৷ এর আগে জেলার কর্মীদের মধ্যে খোঁজখবর নেওয়ার, স্নেহ ভালবাসা পাওয়ার অভাববোধ ছিল৷ এই তারা একজন সম্পাদককে পেল যিনি কর্মীদের সুখদুঃখের সাথী, যিনি ভালবাসা মমতা দিয়ে জয় করে সমগ্র জেলার কর্মীদের মাতৃস্থানীয় হয়ে গিয়েছিলেন৷ বড় যাঁরা ছিলেন, যাঁদের নেতৃত্বে একদিন কাজ করতেন তাঁরাও কিন্তু নির্দ্বিধায় তাঁকে গ্রহণ করেছিলেন৷ তাঁকে সস্নেহে আস্থার চোখে দেখতেন৷ শুনেছি জেলা কমিটির মিটিং পরিচালনায় সদস্যদের মধ্যে যারা পুত্রবৎ তাদের সহকর্মীর মর্যাদা দিয়ে এবং বড়দের সাথে ছোট বোনের মতো আচরণ করে সকলেরই মতামত ধৈর্য ধরে শুনে সিদ্ধান্ত নিতেন৷ এটা খুব সহজ কথা নয়৷ কমরেড শিবদাস ঘোষের বৈপ্লবিক শিক্ষাকে বুকে বহন করে, দল ও নেতৃত্বের প্রতি দ্বিধাহীন আনুগত্য প্রকাশে, যে কোনও দুঃসাধ্য দায়িত্ব পালনে, স্বকীয় উদ্যোগে সংগঠন ও গণআন্দোলন গঠনে, দলের নেতা–কর্মী ও জনগণের প্রতি গভীর দরদবোধে, ঐকান্তিক কর্মনিষ্ঠায়, সাবলীল কর্মপ্রবাহের গতিছন্দে, সুদৃঢ় বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদাবোধে এবং উন্নত রুচিসম্মত বিনম্র আচরণে তিনি দলের ভিতরে–বাইরে অনেককেই জয় করেছেন৷
এখানে একটা কথা আমি বলতে চাই৷ আপনারাই শুধু নয়, মঞ্চে আমরা যারা আছি, সকলের ক্ষেত্রেই একটা শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করে গেছেন৷ তাঁর চরিত্রের একটা মহৎ রূপ বলে বহু কমরেড আমাকে জানিয়েছেন এবং আমারও অবজার্ভেশন তাই– তিনি যে নেতা, জেলা সম্পাদক, রাজ্য কমিটির সদস্য, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পরবর্তীকালে স্টাফ মেম্বার, সেটা তাঁকে দেখে একদম বোঝা যেত না৷ নেতা হওয়ার আগে ও পরে কোনও পার্থক্য তাঁর চলনে বলনে আচরণে কিছুই বোঝা যেত না৷ তিনি ছিলেন সকলের আপনজন, কাছের লোক, সুখদুঃখের সাথী, যাঁকে মন খুলে সবকিছু বলা যেত৷ এই যে দিকটা, এটা তাঁর চরিত্রের একটা অত্যন্ত মহৎ দিক ছিল৷ যেটা সকলের শিক্ষণীয়৷ কোনও দিন নেতা হতে চাননি, কোন কমিটিতে আছেন ভাবেননি, গুরুত্ব পাচ্ছেন কি পাচ্ছেন না, এ নিয়ে তাঁর কোনও ভাবনাই ছিল না৷ কাজেই মগ্ন ছিলেন৷ এটাই তো যথার্থ নেতার গুণ এটাও ঘটনা,
প্রথমবার তাঁকে যখন রাজ্য কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, আমি কি এর যোগ্য? জবাব দিয়েছি, তুমি যে যোগ্য তার পরিচয় দেবে৷ স্টাফ মেম্বার ঘোষিত হওয়ার পর দিল্লিতে পার্টি কংগ্রেস অধিবেশনে কেঁদেছেন, আমি দেখেছি৷ কমরেড নীহার মুখার্জী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পূর্বতন কিছু স্টাফ মেম্বার তাঁদের যোগ্যতা হারিয়েছেন৷ প্রয়াত কমরেড প্রতিভা মুখার্জীও হারিয়েছেন৷ স্টাফ মেম্বার হিসাবে তাঁর নাম যখন ঘোষণা হল প্রতিভা মুখার্জীকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদছেন৷ আমি মঞ্চ থেকে লক্ষ করেছি৷ পরে কমরেড প্রতিভা মুখার্জীও আমাকে জানিয়েছিলেন৷ এই প্রসঙ্গে বলতে চাই, পূর্বতন স্টাফ মেম্বার কারা থাকবেন, কারা থাকবেন না, কমরেড নীহার মুখার্জীই ঠিক করেছিলেন৷ আমাদের কাছে কিছু নতুন নাম চেয়েছিলেন৷ কিছু নাম নিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন, প্রশ্ন করেছেন, কিছু নামে সম্মতি জ্ঞাপন করেননি৷ কিন্তু প্রণতি ভট্টাচার্যের নামটা বলার সাথে সাথেই আমি লক্ষ করেছি কমরেড নীহার মুখার্জীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ এখনও আমার চোখের সামনে সেই চেহারা ভাসছে৷ শুধু বললেন, ওকে একটু ডেকে পাঠাও, আমি একটু দেখতে চাই৷ বুঝলাম, ওঁনার বুকেও ওঁর স্থান আছে৷ ‘আমি নেতা’ এর জন্য কোনও অহঙ্কার, অহমিকা, আত্মপ্রচার, গরিমা লেশমাত্র তাঁর কোথাও ছিল না৷ এটাই তো যথার্থ নেতার পরিচয়৷ তিনি যখন রোগশয্যায় তখন কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন৷ খুব সংকোচের সাথে কমরেড সৌমেন বসুকে বলেছিলেন, ‘আপনারা কেন এই সিদ্ধান্ত নিলেন? আমার এমন কী যোগ্যতা? আমি আর দলকে কী দিতে পারব?’
যদিও একথা আমি বলতে চাই কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্যকে আমাদের স্তরের কোনও নেতা পরিচর্যা করে, লক্ষ রেখে, দৈনন্দিন গাইডেন্স দিয়ে গড়ে তোলেননি৷ কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে নিজেকে গড়ে তোলার নিরন্তর সাধনাই তাঁকে এই উচ্চ মানে পৌছে দিয়েছিল৷ সকলেরই বিকাশে এক্সটার্নাল কন্ট্রাডিকশন, ইন্টারনাল কন্ট্রাডিকশন ক্রিয়া করে আমরা জানি৷ বহির্দ্বন্দ্ব সফল ভাবে কাজ করে অন্তর্দ্বন্দ্ব যদি সাড়া দেয়৷ অনেক সময় দেখা যায় আমি নেতা হয়ে যাকে ভাল করার চেষ্টা করছি আমার খুব ঘনিষ্ঠ থাকা সত্ত্বেও সে তেমন সাড়া দিতে পারেনি৷ আবার আমার থেকে অনেক দূরে, মানে আমাদের নেতাদের থেকে অনেক দূরে আছে কিন্তু কমরেড শিবদাস ঘোষের বক্তব্য পড়ছে, শুনছে, অন্য নেতাদের মূল্যবান আলোচনা শুনছে, এসব আহরণ করছে, রক্ত–মাংস–মজ্জায় মিশিয়ে নিচ্ছে৷ এভাবে নিজেকে গড়ে তোলার সংগ্রামও একজনকে বড় করে তোলে৷ প্রণতি ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে এটাই ঘটেছে৷ তাঁর ক্ষেত্রে– জানলাম একরকম, করলাম আর একরকম, বললাম অন্যরকম– এ সব ছিল না৷ করতে গিয়ে ভুলত্রুটি হয়নি, তা নয়৷ এটা তো আমাদের সবারই হয়৷ কিন্তু ভুল নিজে বুঝে হোক বা অপরে বুঝিয়ে দিক, সংশোধনে কোনও গাফিলতি ছিল না৷ এটাও সকলেরই শিক্ষণীয়৷
আমার সাথে তাঁর ভালভাবে আলাপ আলোচনার সুযোগ হয় ২০০৬ সাল থেকে৷ একথা ঠিক, তারপর থেকে আমার সাথে খুবই ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল৷ জ্ঞান অর্জনের প্রবল স্পৃহা ছিল তাঁর মধ্যে৷ প্রথমদিকে খুব পড়াশোনা করেননি৷ পরবর্তীকালে খুবই খুঁটিয়ে পড়তেন এবং কোনও প্রশ্ন থাকলেই হয় ফোনে না হয় কলকাতায় এলে জিজ্ঞাসা করতেন৷ না এলে সপ্তাহে ২–৩ দিন অবশ্যই ফোনে নানা খবরাখবর জানাতেন, পরামর্শ নিতেন, তত্ত্বগত বিষয় জানতে চাইতেন৷ দর্শন–রাজনীতি, জাতীয়–আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, সংস্কৃতি প্রত্যেকটি বিষয়েই তাঁর গভীর ধারণা ছিল৷ এই তত্ত্বজ্ঞান তাঁর উন্নত হূদয়বৃত্তি এবং উন্নত সংসৃক্তির আধারে সঞ্জীবিত হয়ে এমন সহজ সরলভাবে ব্যক্ত হত যে সেখানে তত্ত্বের কোনও ঝাঁঝ থাকত না৷ তিনি মানুষের মনের অত্যন্ত গভীরে ঢুকে যেতেন৷ সরলতা, সাবলীলতা এগুলো সব তাঁর ছিল, এ কথা সকলেই বলেছেন৷ আবার খুব বুদ্ধিমতীও ছিলেন৷ অনেকে অনেকসময় ভুল করে৷ মনে করে ও খুব সরল, মানে তার বুদ্ধি নেই, এটা ঠিক নয়৷ বুদ্ধি কম, তার সারল্য একরকম৷ আবার খুব জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, তিনিও সরল হন৷ বুদ্ধি তো কোনও জন্মগত বিষয় নয়৷ বুদ্ধি হচ্ছে যুক্তি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা অর্জন৷ সঠিক আদর্শের দ্বারা যদি বুদ্ধি পরিচালিত হয় তাহলে সেই বুদ্ধি সৃজনশীল, কল্যাণমুখী হয়৷ আবার বুদ্ধি যদি বিপথগামী হয় ব্যক্তিগত স্বার্থের ভিত্তিতে চালিত হয় সেটা কুবুদ্ধি, চালাকি, ধূর্তামি হয়৷ অতি বুদ্ধিমান অথচ খুবই সরল, তিনি একটা কঠিন, জটিল জিনিসও সরলভাবে অনুধাবন করতে পারেন, ব্যক্ত করতে পারেন৷ এই ক্ষমতা তাঁর ছিল৷ যদিও তিনি ঊর্ধ্বতন নেতাদের উপস্থিতিতে, সিনিয়ারদের সামনে সহজে মুখ খুলতেন না৷ শেখার মন নিয়ে শুনতেন৷ যার জন্য অনেক সিনিয়ার কমরেড তাঁর জ্ঞানের স্তর জানার সুযোগ পাননি৷ জুনিয়ারদের মধ্যে স্বল্প কথায় মূল বিষয়টা খুব সহজভাবে বুঝিয়ে দিতেন৷
একই সাথে পার্টিনেতা ও জননেতা হওয়া– সবসময় হয় না৷ হতে পারলে দুই ক্ষেত্রেই ভূমিকা অনেক উন্নততর হয়৷ পার্টির নেতা পার্টির কর্মীদের গাইডেন্স দেয়, পরিচালনা করে, কমিটি চালায়, কর্মসূচি দেয়, দলের অভ্যন্তরীণ জীবন দেখে, শৃঙ্খলা রক্ষা করে৷ জননেতা জনগণকে সংগঠিত করে আন্দোলন গড়ে তোলে৷ ফলে পার্টি নেতা হলেই সকলে জননেতা হয় না৷ আবার জননেতা হলেই পার্টিনেতা হওয়ার দক্ষতা জন্মায় না৷ জননেতা– যেমন আমাদের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, মহিলা নেতা, যুব নেতা, ছাত্র নেতা, সংগঠনের প্রেসিডেন্ট–সেক্রেটারি, কিন্তু এটা হচ্ছে ঘোষিত নেতা৷ আরেকটা নেতৃত্ব জনগণের সঙ্গে মিশে গরিব মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে তাদের ঘরের লোক হয়ে তাদের সুখদুঃখের সাথী হয়ে তাদের সংগঠিত করে নানা প্রতিবাদ আন্দোলন করে তাদের হূদয়কে জয় করে তাদের নেতা হন৷ এটা সহজ কথা নয়৷ পুরুলিয়া জেলায় কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য এইভাবেই নেত্রী হয়েছিলেন৷ সেইজন্য তাঁর মরদেহ যখন জেলায় পৌঁছায় হাজার হাজার মানুষ চোখের জল ফেলেছেন৷ বস্তির ঘর, আদিবাসী পাড়া, মুসলিম পাড়া সর্বত্র ছিল তাঁর অবারিত দ্বার৷ তিনি ছিলেন সকলের ঘরের লোক৷ শিক্ষিত–শিক্ষিত–গরিব মানুষ সকলেরই শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন পুরুলিয়া জেলায়৷ মতপার্থক্য থাকলেও অন্য দলের নেতা–কর্মীরাও শ্রদ্ধা করতেন৷ তাঁদের বিপদে আপদে তিনি ছুটে যেতেন৷ যেখানেই অন্যায় ঘটছে, অত্যাচার হচ্ছে কেউ সাথে থাকুক না থাকুক, ডাকুক না ডাকুক, নির্দেশ দিক না দিক ঝাঁপিয়ে পড়তেন৷ এখানে শোকপ্রস্তাবে কিছু আন্দোলন উল্লেখিত হয়েছে৷ কিন্তু এগুলিই সব নয়৷
সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ পারিবারিক দুঃখ, নারী জীবনের নিগূঢ় ব্যথা, স্বামী–স্ত্রীর দ্বন্দ্ব, সন্তান নিয়ে সমস্যা যেকোনও ব্যাপারেই তাঁর কাছে ছুটে যেতেন৷ এরকম অসংখ্য মানুষ আছে যাদের বুকে তিনি স্থান করে নিয়েছিলেন৷ ট্রেনে যাচ্ছেন, বাসে যাচ্ছেন, মর্নিং ওয়াক করছেন, স্টেশনে বসে চা খাচ্ছেন– সমস্ত জায়গাতেই পাবলিকের সাথে নানা প্রশ্ন নিয়ে আলাপ–আলোচনা, নানা কথাবার্তা বলতেন৷ তাঁর আলাপ–আলোচনা, কথাবার্তা সবকিছুর মধ্যেই ব্যক্তি প্রণতি ভট্টাচার্যের সাথে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দল চলে যেত, তাঁর শিক্ষক কমরেড শিবদাস ঘোষ চলে যেতেন৷ অনেকেই আছেন পাবলিকের সাথে মেশেন, আন্দোলন করেন, নিজে পপুলার হন, কিন্তু স্বাভাবিকভাবে দল ও নেতৃত্ব পপুলার হয় না৷ এটা তাঁরাই পারেন, যাঁদের বিপ্লব ও বিপ্লবী দলই একমাত্র জীবন, আলাদা ব্যক্তিগত সত্তা নেই৷ আমি একথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তাঁর মধ্যে অন্তত আমি ব্যক্তিগত চাওয়া–পাওয়া বলে কিছু দেখিনি৷
কমরেডদের ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে তিনি সমালোচনা করতেন, কিন্তু সেই সমালোচনায় কোথাও এতটুকু আঘাত কেউ পায়নি, বহু কমরেড চোখের জলে আমাকে লিখে জানিয়েছে৷ সমালোচনায় থাকত ভালবাসা, স্নেহ৷ আবার অন্যদের সমালোচনাও নির্দ্বিধায় তিনি গ্রহণ করতেন৷ নিজে ভুল করলে নিজেই স্বীকার করতেন এমনকী ছোটদের কাছেও৷ ছোট বড় নির্বিশেষে সকলের কাছ থেকে শিখতেন৷ কেউ কোনও কারণে আঘাত দিয়ে কথা বললেও পাল্টা আঘাত দেওয়ার আচরণ তাঁর ছিল না৷ বরং তাকেও ভালবাসায় কাছে টেনে নিয়েছেন৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ বিপ্লবী চরিত্রের যে গুণাবলি চেয়েছিলেন কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য নিরলস সংগ্রাম করে তার অনেকগুলিই অত্যন্ত সহজ সাবলীলভাবে নিজের নাড়ির সাথে মিশিয়ে দিতে পেরেছিলেন৷ এটা সহজ কথা নয়, একেবারে নিজেকে ভেঙে গড়ে তোলার সংগ্রাম চালানো৷ যেখানেই গেছেন সেখানেই ছাপ ফেলেছেন৷ বাঁকুড়া জেলায় অনেক সমস্যা ছিল, নেতাদের বোঝাপড়ার সমস্যা, কর্মীদের বোঝাপড়ার সমস্যা ছিল৷ এর আগে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা সবটা সমাধান করে যেতে পারেননি৷ কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্যকে দায়িত্ব দেওয়া হল৷ এক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কার্যকরী দায়িত্ব পালন করেছিলেন৷ কর্মক্ষেত্র তাঁর পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়া, এই দুটি জেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল৷ কিন্তু এই ক্ষুদ্র এলাকায় কাজের মধ্যেই তিনি বৃহৎ ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিলেন৷ দলীয় মুখপত্রে তাঁর কোনও ভাষণ, রচনা প্রকাশিত হয়নি৷ এই নিয়ে তাঁর কোনও পরিচয়ই নেই৷ কিন্তু যে উজ্জ্বল প্রাণবন্ত চরিত্রের পরিচয় তিনি রেখে গেছেন, তা ওই দুই জেলার গণ্ডিকে অতিক্রম করে গেছে৷
কমরেড শিবদাস ঘোষ চেয়েছিলেন, আমাদের দলের মহিলারা মেয়ে নয়, মানুষ হোক৷ পুরুষশাসিত সমাজের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকে যে হীনমন্যতাবোধ, পুরুষনির্ভরশীলতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, স্বামী–সন্তানের প্রতি দুর্বলতা এবং সঙ্কীর্ণতা দেখা যায়, সেগুলোর থেকে মুক্ত হয়ে মহিলারা বলিষ্ঠ চরিত্ররূপে আত্মপ্রকাশ করুক৷এই ছিল তাঁর স্বপ্ন৷ এটা আমার দুঃখ, কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য কমরেড শিবদাস ঘোষকে পেয়েছিলেন দূর থেকে৷ কিন্তু কমরেড শিবদাস ঘোষ কাছ থেকে তাঁকে পাননি৷ সেই সময় পুরুলিয়া জেলার দু–এক জন মহিলা কর্মী ছিলেন যাঁদের বাইরে থেকে সম্ভাবনাময় বলে মনে হত৷ আমাদের তৎকালীন নেতারা তাঁদের কমরেড শিবদাস ঘোষের কাছে হাজির করেছেন, কিন্তু তাঁরা কঠিন সংগ্রামে বেশিদূর এগোতে পারেননি৷ কিন্তু প্রণতি ভট্টাচার্য এই সুযোগ পাননি৷ কারণ আমি আগেই বলেছি তিনি সব সময় পিছনে থেকেই নিঃশব্দে কাজ করতেন, বাইরে থেকে সহজে তাঁকে বোঝা যেত না, আর তখন লাজুকও ছিলেন৷ আমি মনে করি তাঁকে দেখলে কমরেড শিবদাস ঘোষ খুব খুশি হতেন, আনন্দিত হতেন৷ দেহে নারী, কিন্তু প্রচলিত নারীসুলভ কোনও দিক তাঁর মধ্যে ছিল না৷ কোমলতায়–কঠোরতায়্ এক স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন৷
সেইসময়ে কমরেড স্বপন ঘোষ চাকরি ছেড়ে হোলটাইমার হয়েছেন৷ সেন্টারে অত্যন্ত অভাব অনটন, তখন দলের আর্থিক সামর্থ্যও ছিল না৷ পাড়া–প্রতিবেশীরা সাহায্য করতেন৷ কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য পায়ে হেঁটে গোটা শহর ঘুরে বেড়াতেন৷ আমি কমরেডদের কাছে শুনেছি সারাদিন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে পার্টির কাজ করতেন৷ আবার ফিরে এসে একমাত্র মহিলা কমরেড হিসাবে সেন্টারের কাজও করতেন৷ দারিদ্র্য অভাব অনটন ছিল, কিন্তু এসবের সাধ্য কী তাঁকে স্পর্শ করে!গান গেয়ে, কবিতা আবৃত্তি করে একটানা আনন্দে কাজ করে গেছেন৷
কমরেড বুলবুল আইচ খুব সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন, প্রণতি ভট্টাচার্যের মধ্যে বিবাহিত জীবনের যে সৌন্দর্য দেখলাম– কে তাঁর স্বামী, কে তাঁর সন্তান– এটা বোঝা যেত না৷ আমি এই চিন্তার সঙ্গে সর্বাংশে একমত৷ তাঁর দাম্পত্য জীবন, সন্তান সম্পর্কে অ্যাপ্রোচ এটা অত্যন্ত অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত৷ সন্তানকে মানুষ করেছেন, বস্তিতে বস্তিতে, পাড়ায় অন্যের বাড়িতে রেখে কাজে বেরিয়ে যেতেন৷ এখানেও আপনাদের আমি বলতে চাই, দুই বছর কঠিন ব্যাধির সাথে লড়েছেন৷ প্রায় সময়ই কলকাতায় শিবপুর সেন্টারে এবং হাসপাতালে ছিলেন৷ কিন্তু একটা দিনও বলেননি একবার ছেলেকে দেখব৷ অন্যান্য কমরেডদের ডেকে পাঠিয়েছেন, কাজকর্মের খোঁজ নিয়েছেন৷ বুঝেছিলেন মৃত্যু অনিবার্য, তার জন্য অন্য কমরেডদের মানসিক, সাংগঠনিক দিক থেকে প্রস্তুত করেছেন৷ কিন্তু কোনওদিন বলেননি ছেলেকে একবার দেখলে ভাল হত৷ বললে কোনও অন্যায় ছিল না৷ এটাই ছিল স্বাভাবিক৷ আমি একদিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ছেলেকে ডাকব? বললেন, থাক ও কাজ করছে, কাজ শিখুক৷ ও এসে কী করবে? মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের এই মানসিকতা কত বড় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত৷ কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় সৃষ্ট এ এক অমূল্য সম্পদ৷ সন্তানও তাই৷ সেও কোনও দিন বলেনি যে মায়ের কাছে একটু যাব৷ দু’বার ডেকে পাঠিয়েছিলাম, এসেছিল, দেখা করে চলে গেছে৷ মৃত্যুর দু’দিন আগে আনিয়েছিলাম৷ বলল, আমি চলে যাচ্ছি, ওখানকার কমরেডদের দেখতে হবে, শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করতে হবে৷ আশা করি সেই সন্তান মায়ের স্বপ্নকে সফল করবে, বড় হবে৷ এ রকম আরও বেশ কিছু ছেলেমেয়েকে এইভাবে মাতৃস্নেহে মানুষ করেছেন৷ সন্তান বিপথগামী হচ্ছে, মা–বাবা–বাড়ির লোক অসহায়, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্যের কাছে পাঠানো হল, তাঁর স্নেহের যাদুমন্ত্রে সেও সম্পূর্ণ পাল্টে গেল এমন দৃষ্টান্তও আছে৷ আশা করি এই সন্তানরা তাঁর স্নেহের মর্যাদা দিয়ে দলের বড় দায়িত্ব পালন করবেন৷ এই যে মাতৃত্ব, যে নৈর্ব্যক্তিক মাতৃত্ব বা এথিক্যাল মাদারহুড কমরেড শিবদাসঘোষ চেয়েছিলেন, আহ্বান করে মহিলাদের বলেছিলেন শরৎচন্দ্রের সাহিত্যের নারায়ণী, বিন্দু হও, সেই মাতৃত্বই প্রণতি ভট্টাচার্যের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে এ কথা আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি৷ এসব যে করেছেন এই নিয়েও কোনও আত্মপ্রচার কোথাও করেননি৷ শুধু মৃত্যুর কয়েক দিন আগে তাঁর ঘনিষ্ঠ স্নেহের পাত্রপাত্রী সদ্য বিবাহিত দুই কমরেডকে এই সম্পর্কে মূল্যবান গাইড লাইন দিয়ে গেছেন, তাঁদের কাছে শুনেছি৷ আশা করি তাঁরাও এর মর্যাদা রক্ষা করবেন৷
আরেকটা কথা বলছি৷ আমি দেখেছি, কোনও কমরেড সম্পর্কে কোনও দিন তিনি কোনও অভিযোগ করেননি৷ একমাত্র অভিযোগ ছিল তাঁর নিজের বিরুদ্ধে৷ আমি কেন আরও ভাল করে কাজ করতে পারছি না? কমরেড শিবদাস ঘোষ এত কথা বলেছেন, এত আলোচনা করেছেন, আপনারাও বলছেন, আমি কেন সেইভাবে করতে পারছি না? এই অভিযোগ ছিল নিজের সম্পর্কে৷ এখানে একটা কথা আমি বলতে চাই৷ একবার আমি তাঁকে দুঃখ দিয়েছিলাম৷ আমি জানতাম তিনি সমস্ত কমরেডদের প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন৷ এ ভালবাসায় কোনও পার্থক্য তিনি করেননি কখনও৷ তবুও একজন কমরেড এসে আমাকে বলেছিল যে কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্যের মধ্যে খানিকটা পক্ষপাতিত্ব দেখছি৷ বিশ্বাস না করলেও আমি তাঁকে এটা জানিয়েছিলাম৷ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন খানিকটা বিস্ময় ও খানিকটা ব্যথা নিয়ে৷ তারপর বললেন, ‘কেন বলল, আমাকে ভেবে দেখতে হবে’৷ আর কিছু বলেননি৷ সেদিন পুরুলিয়ায় ফিরে গেলেন৷ আমারও মনটা খারাপ ছিল৷ আমি পরদিন ওঁকে ফোন করলাম৷ সেই ঘটনা সম্পর্কে এখন ওঁর ডায়েরি থেকে আপনাদের একটু পড়ে শোনাব৷ ২০১৫, ১ জানুয়ারি, লিখছেন, ‘মনটা খারাপ হয়ে আছে আমার৷ আমাকে নিয়ে প্রশ্ন এসেছে৷ মনে হচ্ছে কোথাও ভুল হচ্ছে৷ জানি না কোনওদিন হয়তো সত্য প্রকাশ পাবে’৷ পরের দিন লিখছেন, ‘সকালে প্রভাসদা ফোন করেছিলেন৷ বললেন, মন খারাপ কেন? বুঝতে পেরেছেন আমার মন ভাল নেই৷ বললেন, জীবনে নানা ধরনের সমস্যা আসবে, ভুল সমালোচনাও আসবে৷ কিন্তু মন খারাপ করলে চলবে না৷ ওনার সাথে কথা বলার পর মন ভাল হল৷’ এর পরে যেটা পড়ছি, সেটা ভাল করে শুনবেন৷ লিখছেন, ‘আমার তো আলাদা করে কেউ প্রিয়জন নয়৷ আমি তো সকলকেই ভীষণ ভালবাসি৷ দুঃখ, ও কেন এটা ধরতে পারল না৷’ এই হচ্ছেন প্রণতি ভট্টাচার্য৷ আর একটা ঘটনা বলি, মেদিনীপুরে ডিএসও–ডিওয়াইও–র একটা ক্লাস ছিল৷ প্রচণ্ড গরম ছিল৷ ওঁর আসার ইচ্ছা ছিল৷ তিনি তখন পা ভেঙে পড়ে আছেন৷ আসতে পারছেন না বলে ফোন করেছেন৷ ঠিক করলাম তাঁকে দেখতে যাব৷ আমার সাথে কমরেড হায়দারও ছিলেন, পুরুলিয়ায় গেলাম৷ খুব গরমের মধ্যে তিনি ভাঙা পা নিয়ে আমাদের দেখাশোনা করতে ছুটে এসেছেন৷ তারপর পায়ের যন্ত্রণা আরও বাড়ল, আমি বকলাম৷ ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘আমাদের নেতাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অন্যদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়৷ ওনাদের কীভাবে একটু ভাল রাখা যায় এটাই প্রধান চিন্তা থাকে তখন৷ তখন আর কোনও জ্ঞান থাকে না৷ জীবনটা দিয়ে দিতে পারি ওনাদের ভাল রাখার জন্য৷ আমি কি একটু পাগলের মতো ভালবাসি? জানি না হায়দারদা অসুস্থ মানুষ৷ খুব কষ্ট হয়েছে ওঁর৷ এতটা রাস্তা, প্রচণ্ড গরমে প্রভাসদা বিধ্বস্ত হয়ে গেছেন৷’ নেতাদের সম্পর্কে এই ফিলিং, এই ইমোশন, এই হচ্ছে তাঁর চরিত্রের আরেকটা দিক৷ আবার কোনও কমরেড পিছিয়ে যাচ্ছে, তাকে সাহায্য করতে হবে এগোবার জন্য৷ সেই কমরেডকে দায়ী না করে নিজেই ভাবছেন, আমি কেন তাকে সাহায্য করতে পারছি না৷ এটা আমারও ব্যর্থতা৷ যারা একদিন কাজ করতো, বয়স্ক্, শারীরিক কারণে অসুস্থ বা পারিবারিক দুর্বলতার কারণে জড়িয়ে গেছেন তাঁদের প্রতিও তাঁর ছিল গভীর শ্রদ্ধা৷ সবসময় অন্যের গুণ নিয়েই আলোচনা করতেন৷ কমরেডরা কারও ত্রুটি বললে, তার গুণটা দেখিয়ে দিতেন৷ ছোট বড় সকলকেই মর্যাদা দিতেন৷ বহু কমরেড আমাকে জানিয়েছেন, এইসব বৈশিষ্ট্য আমিও জানতাম৷ আমি নিজে দেখেছি, অন্যের প্রশংসা শুনলে খুশি হতেন, আর তাঁর যদি প্রশংসা করা হত, লজ্জা পেতেন৷ অপরের সাথে প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা, বিরক্তি, ঈর্ষা, বিদ্বেষ– যেগুলি এই বুর্জোয়া সমাজ থেকে আসে, তার লেশমাত্র আমি তাঁর মধ্যে দেখিনি৷
আবার লক্ষ করুন, কীভাবে উনি মারণ ব্যাধির সঙ্গে লড়াই করেছেন৷ ডাক্তার তরুণ মণ্ডল সভায় বসে আছেন, উনি বলেছেন, দিল্লিতে যখন ক্যান্সার ধরা পড়ল, ভাবছেন কীভাবে প্রণতিদিকে বলবেন৷ বলছেন, প্রণতিদিকে বলতে হয়নি৷ তিনি নিজেই বুঝে গেছেন এবং সহজ, স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছেন৷ সমস্ত ডাক্তাররা বলছেন, অসুখ নিয়ে কী বুঝছেন, না বুঝছেন– এ সব নিয়ে একটা প্রশ্নও কোনওদিন করেননি৷ তিনি ভেবেছেন, দল দেখছে, দলই যা করার করবে, আমি কী ভাবব? এই যে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্তভাব, এটাও কত বড় দৃষ্টান্ত৷ তরুণ মণ্ডল একথাও বলছেন, ওঁর এই যে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে, আমি প্রথমে বুঝতেই পারিনি, কারণ বাইরে তাঁর কোনও এক্সপ্রেশন ছিল না৷ এটা তাঁর জীবনের শেষ দিকের অধ্যায়৷ এ–ও আমাদের কাছে একটা অসাধারণ দৃষ্টান্ত৷ ক্যান্সার রোগে কী ভীষণ যন্ত্রণা হয়, আপনারা যাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরা জানেন৷ কিন্তু এই অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যেও কোনও দিন এতটুকু কান্না, ছটফটানি, হা–হুতাশ, যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি৷ সব কিছুই নীরবে নিঃশব্দে সহ্য করেছেন৷ জিজ্ঞেস করলে বলতেন, হ্যাঁ একটু ব্যথা হচ্ছে৷ মুখে বলতেন একটু, বাস্তবে ছিল অসহ্য যন্ত্রণা৷ সেটা হাসিমুখেই বলতেন৷ মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এটাই ছিল তাঁর আচরণ৷ মানে নিজের কষ্ট প্রকাশ করে, অন্যকে তা জানিয়ে অন্যদের কষ্ট দিতে চাননি৷ এ কত বড় ক্ষমতা, কত বড় মানসিকতা নিজে সারা রাত ঘুমোতে পারেননি, কিন্তু তাঁকে যারা দেখছে, তারা জাগতে চাইলেও জাগতে দেননি৷ যতক্ষণ পেরেছেন টলতে–টলতেও বাথরুমে গেছেন, অন্যকে ডাকেননি৷ যারা দেখা করতে এসেছেন তাদের সাথে কাজকর্ম নিয়ে কথাবার্তা, আলোচনা করেছেন, নানা সাজেশন দিয়েছেন৷ আর এই যন্ত্রণার মধ্যেও ছিল গান শোনার প্রবল আগ্রহ৷ প্রায় প্রতিদিনই কমরেডদের নিয়ে গানের আসর বসাতেন৷ গানের ক্যাসেট শুনতেন, নিজেও মাঝে মাঝে গলা মেলাতেন৷ ছোটবেলায় গানের শখ ছিল, ভাল গলা ছিল, গায়ক হওয়ার ইচ্ছা ছিল৷ দলে যুক্ত হওয়ার পর বিপ্লবী রাজনীতিকেই সঙ্গীতরূপে আরাধ্য হিসাবে তিনি গ্রহণ করেছিলেন৷ বিপ্লবী রাজনীতির সাথে তাঁর সঙ্গীতজীবন মিশে গিয়েছিল৷ জীবনের শেষ অধ্যায়ে যারাই এসেছে, পারুক না পারুক গান গাইয়েছেন৷ পুরনো দিনের গান, ক্লাসিকাল গান, রবীন্দ্র–নজরুল সঙ্গীত– এসব শুনতেন৷ আমি শুনেছি, মৃত্যুর দু’দিন আগে, এই হাউসে আছে কমরেড কুমকুম, তাকে দিয়ে গান করিয়েছেন, সে ভাল গায়৷ সে কোথাও একটু সুর ভুল করছে, কথা ভুলে গেছে– ধরিয়ে দিয়েছেন৷ এই রকম মানসিকতা ছিল তাঁর৷ নিজের রোগ নিয়ে দুশ্চিন্তা নয়, পার্টির কাজকর্ম নিয়ে চিন্তাভাবনা, নানা বইপত্র পড়া ও শোনা আর সংগীতের চর্চা এই নিয়েই রোগাক্রান্ত দিনগুলি কাটিয়েছিলেন৷
শিবপুর সেন্টারে থাকতেন৷ দিনের বেলা আমার সাথে বিশেষ দেখা হত না৷ রাতে ঘুম হত না, সেজন্য দিনের বেলা শুয়ে থাকতেন৷ আমি ডিসটার্ব করতাম না৷ আমি যখন রাত সাড়ে আটটা–ন’টায় পার্টি অফিস থেকে ফিরতাম, সেই সময়ে দেখা করতাম৷ এই সময়ের জন্য আকুল আগ্রহে বসে থাকতেন৷ অনারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, অসহ্য যন্ত্রণায় বিদ্ধ, অনিবার্য মৃত্যু যাঁর দরজায় দাঁড়িয়ে– আমি তাঁকে কী সান্ত্বনা দেব শুধু জিজ্ঞেস করতাম, ব্যথা আছে? হাসিমুখে একই উত্তর ছিল, একটু আছে৷ মৃত্যুর পরে আমি শুনেছি, দু’জন কমরেড আমাকে বলেছেন, আমি আসার আগে পর্যন্ত বিছানায় কাতর হয়ে শুয়ে থাকতেন৷ আমার আসার সময় উঠে বসতেন, চুল, চেহারা ঠিকঠাক করে নিতেন৷ মানে আমার কাছে হাসিমুখ নিয়েই দেখানো যে, আমি ভাল আছি৷ হয়ত আমাকে দেখার আনন্দ, না হয় আমি দুঃখ না পাই তার জন্য৷ এগুলো ভাবলে বিস্মিত হতে হয়৷ সারা দেহে ছড়ানো ক্যান্সারে আক্রান্ত যে যন্ত্রণায় মানুষ ছটফট করে– যে যন্ত্রণায় অনেকে বিষ চায়, আত্মহত্যা করে, সেখানে তিনি এভাবে অত্যন্ত সহজ ভাবে আচরণ করে গেছেন, এটা খুবই বিস্ময়কর৷ এখানেও কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা– অসহ্য যন্ত্রণায় মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও একজন বিপ্লবী কীভাবে লড়াই করে তিনি দেখিয়ে গেলেন৷ আমাদেরও একদিন এই পরীক্ষা দিতে হবে৷
হাসপাতাল থেকে ওঁরা জানিয়েছেন, সমস্ত ডাক্তার, স্টাফ, নার্স, যাঁরাই তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন তাঁদের কারও সন্তান নিয়ে সমস্যা, কারও বিবাহিত জীবনের সমস্যা, নিজেদের বোঝাপড়ার সমস্যা, এ সব নিয়ে তাঁদের পরামর্শ দিয়েছেন, গাইড করেছেন৷ তাঁদের পার্টির বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ করেছেন, মানুষ হতে শিখিয়েছেন৷ মৃত্যুর দু’দিন আগে একজন নার্সকে জিজ্ঞেস করেছেন, তার সমস্যার কী হল৷ অর্থাৎ তিনি যেভাবে গাইড করেছেন, তাতে সমাধান হয়েছে কি না৷ আমাদের সকলের কাছে কত বড় শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হাসপাতালে যাঁরা যান, তাঁরা কি এমনভাবে সকলের গার্জিয়ান হতে পারেন? অর্থাৎ শেষনিঃশ্বাস ফেলার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যাকেই পেয়েছেন কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা থেকে কিছু না কিছু বোঝাবার চেষ্টা করেছেন৷ এটাই ছিল তাঁর একমাত্র সাধনা৷ শিবপুর সেন্টার থেকে যখন হাসপাতালে শেষবারের মতো যান আমি দোতলায় দেখা করলাম, আমি জানতাম আর ফিরবেন না৷ পরে আবার নিচে গিয়ে দেখা করলাম৷ ওই অবস্থায় বললেন, আপনি এখানে এলেন কেন? আমি হাত ধরে বললাম, তোমার সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করব৷ বললেন, না, একদম আসবেন না৷ ডাঃ সুভাষ দাশগুপ্ত বলছেন, ওকে বারবার বলেছেন, প্রভাসদা যেন একদম এখানে না আসেন, এখানে এলে ওঁর ইনফেকশন হবে৷ মৃত্যুর আগের দিন সুভাষকে শান্ত দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন, ‘সুভাষ তোমাদের তো আর করার কিছু নেই, এবার আমাকে ছেড়ে দাও’৷ আর, শেষবারের মতো জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রভাসদা কী রকম আছেন’৷ ও জানালো, ঠিক আছেন৷ অর্থাৎ প্রভাসদারা, নেতারা বেঁচে থাকুন, সুস্থ থাকুন, দলের কাজ যাতে চালিয়ে যেতে পারেন৷ এই তাঁর শেষ কথা৷ সুভাষ রাতে আমার অনুমতি নিয়ে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়ালো, ডাক্তার–নার্স–স্টাফরা এই দৃশ্য দেখে চোখের জল ফেলছিল৷ সুভাষ বলেছেন, তাঁর মৃত্যুতে শুধু আমরা, আপনারাই নন, গোটা হাসপাতালও কেঁদেছে৷ সেখানেও এমনই আপনজন হয়ে গিয়েছিলেন তিনি৷
আমরা সকলেই মহান শিক্ষক কমরেড শিবদাস ঘোষের ছাত্র হিসাবে জীবন সংগ্রাম চালাচ্ছি৷ উন্নত কমিউনিস্ট চরিত্র অর্জনের জন্য প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাছ থেকে শিখছি কে কীভাবে কতটা এই অমূল্য বৈপ্লবিক শিক্ষাকে জীবনে প্রয়োগ করতে পেরেছে৷ আজ এই স্মরণসভায় প্রয়াত কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্যের জীবন সংগ্রামের কিছু অধ্যায় আপনাদের কাছে উপস্থিত করলাম যাতে অত্যন্ত সাধারণ স্তর থেকে কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে সংগ্রাম চালিয়ে কী অসাধারণ স্তরে নিজেকে উন্নীত করা যায়– জীবিত আমরা যারা আছি সেটা যাতে উপলব্ধি করতে পারি, অনুপ্রাণিত হতে পারি৷
১৯৫০ সাল থেকে পার্টিতে আছি৷ এত কমরেডের শহিদ হওয়া, এত কনিষ্ঠ কমরেডদের মৃত্যু দেখছি– ভাবছি আর কতদিন দেখতে হবে আবার, স্মরণ করি, মনে শক্তি সঞ্চয় করি, মহান লেনিনের মৃত্যুর পর মহান স্ট্যালিন যে শপথবাক্য উচ্চারণ করেছিলেন তার থেকে৷ মহান স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর মহান মাও সে–তুঙ বলেছিলেন, টার্ন গ্রিফ ইনটু স্ট্রেংথ, অর্থাৎ শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত কর৷ আর স্মরণ করি, কমরেড সুবোধ ব্যানার্জীর মৃত্যুর পর কমরেড শিবদাস ঘোষের অবিস্মরণীয় শিক্ষা, ‘বিপ্লবী রাজনীতি উচ্চতর হৃদয়বৃত্তি৷ এ একদিকে যেমন কোমল, আর একদিকে এর মধ্যে রয়েছে কঠোর বাস্তবতা, কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, কঠোর ও কঠিন কর্তব্যপরায়ণতা৷ শোকের জন্য বিপ্লবীদের কাজ থেমে থাকে না৷’ বলেছেন, ‘অত্যন্ত প্রিয়জনের মৃত্যু, অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা, অত্যন্ত হৃদয়াবেগের ঘটনা, তার মধ্যেও বিপ্লবীরা কর্তব্যকে অবহেলা করতে পারে না৷ বিপ্লবী রাজনীতি বাইরে থেকে দেখতে এমনই নিষ্ঠুর, আবার বাইরের দিক থেকে যা দেখতে নিষ্ঠুর তার মধ্যেই রয়েছে যথার্থ শোকোপলব্ধির তাৎপর্য৷’ যত মৃত্যুর সম্মুখীন হই, ততবার মহান নেতাদের এই শিক্ষাগুলিকে স্মরণ করি, শক্তি সঞ্চয় করি৷ আপনাদেরও বলব, এই ভাবেই শক্তি সঞ্চয় করবেন৷ আমরা যখন থাকব না, সেদিনও মহান শিক্ষকদের এই শিক্ষাগুলি নিয়েই আপনাদের চলতে হবে৷ এ কথা বলেই আমি আজ শেষ করছি৷
ইনকিলাব জিন্দাবাদ৷
কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য লাল সেলাম৷
সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ লাল সেলাম৷
(৭০ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা ১৫জুন, ২০১৮)