শোষিত নিপীড়িত মানুষের জ্ঞানসাধনার প্রশ্নটি অত্যন্ত জরুরি
আপনারা যারা সমাজকে পাল্টাতে চান, দুনিয়াকে পাল্টাতে চান, এই পুঁজিবাদী শোষণের জাঁতাকল থেকে মুক্তি পেতে চান, তাঁদের জীবনভোর সত্যের সাধনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, এই কারণেই শোষিত, নিপীড়িত মানুষের ক্ষেত্রে সত্যসাধনার প্রশ্নটিও অত্যন্ত জরুরি। কেননা, সত্য হল অমোঘ সত্য, ‘ডিসিসিভ ট্রুথ’। অন্যদিকে, এক-একটি বিশেষ মুহূর্তে সত্য হল কোনও বিশেষ বিষয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ সত্য– অসম্পূর্ণ বা অস্পষ্ট ধারণার সেখানে স্থান নেই। (মার্ক্সবাদ ও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের কয়েকটি দিক)
আমি সামাজিক মানুষ, আমি সমাজেরই একজন। সমাজ পচে গেলে ক্ষয়ে গেলে গোটা মানবসমাজের ক্ষতি, সাথে সাথে আমারও ক্ষতি। ফলে সমাজে সমস্যা কী, সমাজ কেন অধোগতির দিকে নেমে যাচ্ছে– সে সব নিয়ে যদি যুবকরা মাথা না ঘামান, এ ব্যাপারে যদি তাদের কোনও দায়িত্ববোধ না থাকে, এ ব্যাপারে যদি তাদের কোনও করণীয় কাজ না থাকে– তাদের কাজ যদি হয় সমাজ অভ্যন্তরের শ্রেণিসংগ্রামগুলো এবং সমস্ত রকমের সামাজিক আন্দোলনের সাথে সম্পর্কচ্যুত শুধু বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চা, তাহলে আমি বলব, তা জ্ঞানতত্ত্বের বা জ্ঞানসাধনার নামে ভাঁড়ামি। (যুবসমাজের প্রতি)
জীবনের নতুন প্রয়োজনকে ভিত্তি করে জন্ম নেয় নতুন আদর্শবাদ
বুর্জোয়া স্বাধীনতা বা জাতীয়তাবোধের যে আদর্শকে উচ্চারণ করলে একদিন মানুষকে জান দিতে হত, আজ সেই বুর্জোয়া স্বাধীনতার ধ্যানধারণা, দেশাত্মবোধ, দেশপ্রেমের ধ্যানধারণা শোষকশ্রেণির হাতে সুবিধার অস্ত্রে পর্যবসিত হয়েছে। অর্থাৎ সেই আদর্শবাদ আজ শোষকশ্রেণির শাসন, জুলুম, আধিপত্য রক্ষার আদর্শে রূপান্তরিত হয়েছে। (যুবসমাজের প্রতি)
ইতিহাসের গতিপথে সেই জাতীয়তাবাদী ও বুর্জোয়া মানবতাবাদী আদর্শ আজ যে শুধু অকেজো হয়ে গিয়েছে, প্রতিক্রিয়াশীল রূপ ধারণ করেছে তাই নয়, উপরন্তু আজ তা ক্ষমতাসীন শাসক-শোষক পুঁজিপতিশ্রেণির হাতে একটা ‘প্রিভিলেজ’ (সুবিধা) নেওয়ার অস্তে্র পর্যবসিত হয়েছে। তাই আজ আর কোনও মতেই পুরনো দিনের সেই জাতীয়তাবাদী আদর্শ যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে পারছে না।
(সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ও বেকার সমস্যার সমাধান কোন পথে)
কিন্তু, এই আদর্শবাদ ও নীতি-নৈতিকতার ধারণার কোনও শাশ্বত রূপ নেই। আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ না থাকলে কোনও সমাজ এগোতে পারে না। কিন্তু আজ যে আদর্শবাদ সমাজকে এগোতে সাহায্য করছে আগামীকাল আবার সেই আদর্শই সমাজের রাশ টেনে ধরছে, সমাজপ্রগতির বিরোধিতা করছে, মহাপ্রতিক্রিয়াশীল আদর্শে পরিণত হচ্ছে। এটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ, মানুষের প্রয়োজন এক জায়গায় বসে থাকতে পারে না। তাই জীবনের নতুন প্রয়োজনকে ভিত্তি করে নতুন আদর্শবাদ জন্ম নেবেই।
(মার্কসবাদ ও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের কয়েকটি দিক)
সত্যানুসন্ধানই হচ্ছে মার্ক্সবাদের বুনিয়াদ
মার্কসবাদকে আমাদের একটি বিজ্ঞান হিসেবেই বুঝতে হবে– কতকগুলো শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় ধারণার ভিত্তিতে নয়। অর্থাৎ, যে ‘কো-অর্ডিনেটেড নলেজ’ বা ‘কমপ্রিহেনসিভ সায়েন্স’ হিসেবে মার্ক্সবাদ গড়ে উঠেছে তাকে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে, বিশেষ দেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে, বিশেষ বিশেষ দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োগ করতে হবে। এর মধ্য দিয়েই মার্ক্সবাদের ধারণাগুলোকে ক্রমাগত সমৃদ্ধ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মার্ক্সবাদ শুধুমাত্র একটা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়, এটা একটা বিশ্বদর্শন– ‘ওয়ার্ল্ড আউটলুক’ এবং ‘গাইড টু অ্যাকশন’। (মার্ক্সবাদ ও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের কয়েকটি দিক)
ভোটের মাধ্যমে মুক্তি অসম্ভব
ভোটের মারফত হাজার বার গভর্নমেন্ট পাল্টে বা আক্ষরিক অর্থে আইনকানুন সংশোধন করার চেষ্টা করার মধ্য দিয়ে জনসাধারণের পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও পুঁজিবাদী শোষণব্যবস্থা থেকে মুক্তি অর্জন অসম্ভব। এই মুক্তি অর্জনের একমাত্র পথ হচ্ছে, জনসাধারণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোকে সঠিক বিপ্লবী কায়দায় পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে জনসাধারণের অমোঘ বিপ্লবী সংঘশক্তি গড়ে তোলা এবং বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণির দলের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা। এ ছাড়া জনসাধারণের মুক্তির আর কোনও দ্বিতীয় রাস্তা নেই। বাকি সব রাস্তাই হচ্ছে অযথা সময় নষ্ট ও আত্মপ্রতারণা মাত্র। (১৫ই আগস্টের স্বাধীনতা ও গণমুক্তির সমস্যা)
আমি সচেতন– এ কথার অর্থ কী
‘আমি সচেতন’ এইজন্যই যে, আমি সচেতনভাবে নিজেকে এবং পরিবেশকে পরিবর্তিত করার জন্য তৈরি। এই তৈরি যদি আমি না থাকি, তাহলে আমি সচেতন নই। ডিকশনারির ভাষায় হয়ত আমি শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী; কিন্তু আসলে আমি সচেতন নই। একজন সচেতন মানুষ তাঁর উদ্যোগ ছাড়তে পারেন না। একজন সচেতন মানুষ শুধু আলোচনাই করেন না, সচেতন মানুষের নির্দিষ্ট দায়িত্ব থাকে এবং সেই দায়িত্ব তিনি নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। এ ব্যাপারে তিনি কারও কাছে অজুহাত দিতে পারেন না, নিরর্থক জবাবদিহি করতে পারেন না। লড়াই করে তিনি হারতে পারেন, পরীক্ষা করার মধ্য দিয়ে তিনি ব্যর্থ হতে পারেন। কিন্তু, তাঁর ব্যর্থতার সমস্ত জিনিসটাই মাথা উঁচু করে তিনি দুনিয়ার কাছে রাখতে পারেন। কারণ, তিনি ফাঁকি দেননি। তিনি বসে বসে কেবল আলোচনা করেননি। কেন করতে পারছেন না, বা কীসের জন্য করতে পারছেন না, শুধু তার কারণ খুঁজে বেড়াননি। তিনি চেষ্টা করেছেন, লড়াই করেছেন, উদ্যোগ নিয়েছেন, তারপর ব্যর্থ হয়েছেন। বিপ্লবীদের চিন্তা, মানসিকতা এরকম হবে।
(অন্ধ অনুকরণ করে বিপ্লব করা যায় না)
কোনও মানুষই শ্রেণিঊর্ধ্ব নয়
শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সামাজিক চিন্তা যেখানে শ্রেণিচিন্তা সেখানে কোনও ব্যক্তিই শ্রেণিস্বার্থ থেকে মুক্ত ব্যক্তি নয়। যিনি যত বড় মহামানবই হোন, তিনি এটা উপলব্ধি করতে পারুন আর না পারুন – কোনও না কোনও শ্রেণিস্বার্থের সাথে সবাইকে যুক্ত হয়ে পড়তে হয়, কোনও না কোনও শ্রেণির চিন্তাকেই তাকে প্রতিফলিত করতে হয়। ফলে, এরূপ অবস্থায় জেনে হোক বা না জেনে হোক, যখন কোনও না কোনও শ্রেণির চিন্তার সাথে সবাইকে যুক্ত হয়ে পড়তে হচ্ছে তখন বাস্তবে কোনও না কোনও শ্রেণীস্বার্থ নিয়েই চলব, অথচ নিজে ভাবতে থাকব– ‘আমি কোনও শ্রেণির সাথেই যুক্ত নই, আমি গোটা সমাজের স্বার্থ নিয়েই ভাবছি’– এর চেয়ে অজ্ঞতা ও আত্মপ্রতারণা আর কিছু হতে পারে না। (যুবসমাজের প্রতি)
সভ্যতা মুক্তিবেদনায় কাঁপছে
আপনি মজুর, আপনি ‘সিভিলাইজেশন’-এর স্রষ্টা, এ সভ্যতার স্রষ্টা। আর এই সভ্যতা মুক্তিবেদনায় কাঁপছে, সে আপনাদের কাছে মুক্তি চাইছে। শুধু আপনাদের মুক্তি নয়, গোটা মানবসভ্যতার মুক্তি আপনাদের হাতে। তার দায়িত্ব শ্রমিকের হাতে। অথচ আপনাদের, শ্রমিকদের সে সম্বন্ধে আজও এতটুকু চেতনা নেই। সেই চেতনা যদি শ্রমিকদের মধ্যে না আসে, সেই চেতনায় শ্রমিকরা যদি উদ্বুদ্ধ না হতে পারেন তাহলে সব ব্যর্থ।
(শ্রমিক আন্দোলনে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে)
মনে রাখা দরকার যে, মজুরের মাইনে বাড়াবার লড়াই বিপ্লবী লড়াই নয়। মালিকদের ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে মজুরের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াই হচ্ছে সত্যিকারের বিপ্লবী লড়াই। মজুরের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক লড়াইয়ের মধ্য থেকে যখন এই আকাঙক্ষা, এই স্পৃহা এবং এই চেতনা গড়ে তোলা হয়, বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্রগতির স্বার্থে দরকার হলে দ্বিধাহীন চিত্তে মজুরি ত্যাগ করবার মতো মানসিকতা মজুরদের মধ্যে সৃষ্টি হয়, তখনই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন স্কুল অব কমিউনিজম-এর অর্থে পরিচালিত হল ধরতে হবে।
(যুক্তফ্রন্টের অভ্যন্তরীণ সমস্যা প্রসঙ্গে)
অবাধ শিল্প বিকাশের দ্বার খুলে দিতে হলে উৎপাদনকে পুঁজিবাদী উদ্দেশ্য থেকে মুক্ত করতে হবে
চাষি জীবনের প্রধান দু’টি সমস্যার একটি হচ্ছে জমি উদ্ধার করে জমি বিলি করার পরও গ্রামে যে বাড়তি জনসংখ্যা থেকে যাবে, যাদের জমি দেওয়া যাবে না এবং যে বাড়তি জনসংখ্যা প্রতিদিন গড়ে উঠবে, গ্রামে সেই বাড়তি জনসংখ্যার উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং আর একটি হচ্ছে কৃষির আধুনিকীকরণ ও যন্ত্রীকরণ। আর, এ দু’টি মূল সমস্যারই সমাধান জড়িয়ে রয়েছে শিল্পবিপ্লব এবং শিল্পের অবাধ অগ্রগতির দ্বার খুলে দেওয়ার মধ্যে। আর অবাধ শিল্পবিকাশের দ্বার আমরা তখনই খুলে দিতে পারি, যখন পুঁজিবাদবিরোধী বিপ্লবের আঘাতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এবং পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে উৎপাদনকে পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্ক ও উদ্দেশ্য থেকে মুক্ত করে দিতে পারি। (ভারতবর্ষের কৃষি সমস্যা ও চাষি আন্দোলন প্রসঙ্গে)
সমাজতান্ত্রিক আদর্শবাদ ছাড়া সাংস্কৃতিক অবক্ষয় প্রতিরোধ হবে না
যুবসমাজকে প্রকৃত মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শবাদের ভিত্তিতে তাদের উন্নততর সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মান গড়ে তুলতে না পারলে কোনও মতেই এই অবক্ষয়কে প্রতিরোধ করা যাবে না। (সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ও বেকার সমস্যার সমাধান কোন পথে)