কমরেডস,
আমি জানি এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে এ যুগের মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক, আমাদের প্রিয় দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষের জন্মশতবর্ষ উদযাপনের বর্ষব্যাপী কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতির জন্য কমরেডদের আবেদন করার প্রয়োজন নেই, কারণ মহান নেতার ছাত্র হিসাবে কমরেডরা আবেগ ও উৎসাহের সাথে তাঁকে অন্তরের গভীরতম শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ইতিমধ্যে নিজেরাই প্রস্তুত হয়েছেন।
এই উদযাপনে আমাদের আবার স্মরণ করতে হবে কমরেড শিবদাস ঘোষের এক বিরল ঐতিহাসিক সংগ্রামকে যার উৎস শোষিত নিপীড়িত মানুষের প্রতি অসীম দরদবোধ এবং সুদৃঢ় প্রত্যয়, অটল প্রতিজ্ঞা, অদম্য তেজ, দুর্দমনীয় সাহস, প্রগাঢ় ধৈর্য ও অধ্যবসায়ে নিরন্তর সংগ্রামের দ্বারা ভারতবর্ষের মাটিতে মার্কসবাদকে বিশেষীকৃত ও সেই প্রক্রিয়ায় তাকে আরও সমৃদ্ধ করার মধ্য দিয়ে এদেশে একটি সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার দ্বারা পুঁজিবাদী শোষণের যাঁতাকল থেকে শোষিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তির পথ নির্দেশের মহান স্বপ্ন এবং তার দ্বারা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনকেও শক্তিশালী করার লক্ষ্য।
এগুলি স্মরণ করার অর্থ হল, কমরেড শিবদাস ঘোষ যেভাবে চেয়েছিলেন, তার জন্য আমাদের নিজেদের বিবেককে আরও জাগ্রত করতে এবং শক্তিশালী বিপ্লবী যোদ্ধা হিসাবে গড়ে তুলতে হবে।
এর জন্য প্রয়োজন, ক) কমরেড শিবদাস ঘোষের বৈপ্লবিক শিক্ষাগুলি অত্যন্ত গভীরভাবে এবং মনোযোগ সহকারে বারবার পড়ার মধ্য দিয়ে আত্মস্থ করা এবং নিজেদের জীবনে সেগুলি প্রয়োগ করা, খ) কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের সমস্ত পেটিবুর্জোয়া মানসিকতা চূর্ণ করে গভীর আবেগের সাথে শোষিত নিপীড়িত মানুষের সাথে মেশা, তাদের সাথে থাকা, তাদের জীবনযাত্রা লক্ষ করা, তাদের দুঃখ-কষ্ট অনুভব করা এবং শ্রেণিসংগ্রাম ও গণসংগ্রামে তাদের যুক্ত করার জন্য রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও সংগঠিত করা, গ) নিজেদের আদর্শগত ও সাংগঠনিক চেতনার স্তর আরও উন্নত করার জন্য বিরামহীন, ধারাবাহিক চেষ্টা চালানো, ঘ) দ্বিধাহীন ভাবে জীবনের কোনও কিছু গোপন না করে আত্মসমালোচনা ও অন্যদের সমালোচনা খুশিমনে নেওয়ার দ্বারা নিজেদের সমস্ত বুর্জোয়া চিন্তাভাবনা ও অভ্যাস চিহ্নিত করে তা থেকে মুক্ত হয়ে উন্নত সর্বহারা সংস্কৃতি অর্জনের জন্য বিরামহীন সংগ্রাম করা, ঙ) নেতৃত্বের নির্দেশের অপেক্ষা না করে যেকোনও দায়িত্ব পালনের জন্য স্বকীয় উদ্যোগের অভ্যাস গড়ে তোলার কষ্টকর সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করা, চ) সমস্ত মানুষের থেকে, এমনকি পথের সাধারণ মানুষের থেকেও শিখবার মানসিকতা, ছ) কোনও কাজে সফলতার দ্বারা অহঙ্কার ও আত্মম্ভরিতার এবং ব্যর্থতার জন্য হতাশার শিকার না হওয়া, জ) সমস্ত রকমের প্রতিকূলতা ও সমস্যা মোকাবিলা করে নতুন নতুন জায়গায় সংগঠন বিস্তারের জন্য অদম্য উদ্যোগ, ঝ) নিজের বাসস্থান ও কাজের জায়গায় সাধারণ মানুষের সাথে মেশার অভ্যাস গড়ে তোলা, নিজের জনমুখী আচরণ ও উন্নত নৈতিক চরিত্রের দ্বারা জনগণের আস্থা-ভালবাসা অর্জন করার মধ্য দিয়ে তাদেরই একজন তথা তাদের নেতায় পরিণত হওয়া।
আমাদের মহান শিক্ষকের যোগ্য ছাত্র হওয়ার জন্য এই গুণগুলি অর্জন করা একান্তই প্রয়োজন।
এই উদযাপন অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে বিপ্লবী হিসাবে আমাদের উদ্যোগ আরও বাড়াতে হবে এবং নিজেদের মান আরও উন্নত করতে জীবনের সমস্ত দিক ব্যাপ্ত করে এক বিরামহীন লাগাতার সংগ্রামে সামিল হওয়ার শপথ নিতে হবে।
আমরা জানি ইতিহাসে পূর্বেকার যত মহৎ আন্দোলনই হয়েছে— ধর্মীয় আন্দোলন, নবজাগরণ, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব, স্বাধীনতা আন্দোলন বা রাশিয়া ও চিনের সর্বহারা বিপ্লব— সমস্ত আন্দোলনই জনগণকে জাগাতে, অনুপ্রাণিত করতে শিক্ষিত ও সংগঠিত করতে নিজেদের নেতাদের জন্ম দিয়েছে, তাঁদের সামনে এনেছে। এ ছাড়া কোনও বিপ্লবী আন্দোলন এগোতে পারে না। কিন্তু সূচনায় তৎকালীন সময়ের বিপ্লবভীত শাসক শ্রেণি সাধারণ মানুষের থেকে বিপ্লবী আদর্শ এবং নেতাদের নাম সর্বদাই আড়াল করে রাখতে চেয়েছে। যখন তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে, বিপ্লবী আদর্শ এবং নেতাদের নাম যখন জনগণের মধ্যে সুপরিচিত হয়ে গেছে, তখন তীব্র বিদ্বেষে তারা এইসব নেতাদের আক্রমণ করেছে, হত্যা করেছে, নির্লজ্জ মিথ্যা অপপ্রচার ও কুৎসার দ্বারা বিপ্লবী আদর্শ সম্পর্কে জনতাকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে। কিন্তু সবই ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমানে কমরেড শিবদাস ঘোষ এবং তাঁর বৈপ্লবিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটছে। ইতিমধ্যেই সর্বহারা শ্রেণির বিপ্লবী নেতা ও চিন্তানায়ক হিসাবে তাঁর অভ্যুত্থান হয়েছে, আমাদের পার্টির কর্মী, সমর্থক, দরদিরা এবং আমাদের দলকে যে জনগণ ভালোবাসেন, তারা তাঁকে শ্রদ্ধা করেন, তাঁকে নেতা হিসাবে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু দেশের বিরাট অংশের জনগণের কাছে তাঁর নাম এখনও অপরিচিত। কমরেড শিবদাস ঘোষের নাম এবং তাঁর শিক্ষা থেকে পাছে শোষিত মানুষ সত্যকারের বিপ্লবী আদর্শ ও রাস্তা খুঁজে পায়, এই আতঙ্ক থেকে শাসক শ্রেণি ও প্রচারমাধ্যম অত্যন্ত উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাঁর সম্পর্কে অবহেলা দেখায়, নীরবতা দিয়ে তাঁর নাম ও শিক্ষাগুলি মুছে দিতে চায়।
বর্তমানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই জনগণ এক অভূতপূর্ব সঙ্কটের সম্মুখীন। মৃত্যুপথযাত্রী পুঁজিবাদের সর্বশেষ স্তরে সমস্ত দিক থেকেই এক চূড়ান্ত সঙ্কট জনজীবনকে গ্রাস করেছে। সঙ্কট জর্জরিত পুঁজিবাদ আজ মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে। কিন্তু নিজে থেকে এর মৃত্যু হবে না, যেহেতু কোনও সামাজিক ব্যবস্থারই আপনা-আপনি মৃত্যু হয় না। শোষিত শ্রেণির সচেতন ভূমিকার দ্বারা অতি দ্রুত তার কবর খোঁড়ার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে হবে।
বর্তমানে আমরা দেখছি, শোষিত জনগণের মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এখানে সেখানে ফেটে পড়ছে, কোনও কোনও জায়গায় মাসাধিক কালেরও বেশি বিক্ষোভ চলছে। উত্তাল ঢেউয়ের মতো একের পর এক আন্দোলন আছড়ে পড়ছে। কিন্তু নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কোনও বিপ্লবী নেতা, বিপ্লবী আদর্শ এবং পার্টি তাদের সামনে নেই। সর্বত্রই জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ছে, তারা প্রতিবাদ চাইছে, পরিবর্তন চাইছে, কিন্তু জরুরি প্রয়োজন হল তাদের পরিচিত সর্বহারা বিপ্লবী নেতৃত্বের উপস্থিতি যা এখনও সম্ভব হয়নি। আগেই আমরা বলেছি যে সর্বহারা শ্রেণির বিপ্লবী নেতা হিসাবে কমরেড শিবদাস ঘোষকে, তাঁর বিপ্লবী শিক্ষাকে এবং আমাদের দলকে এখনও আমরা দেশের আপামর জনগণের কাছে নিয়ে যেতে পারিনি।
এখন অত্যন্ত জরুরি এবং অবশ্যকরণীয় কর্তব্য হল কমরেড শিবদাস ঘোষ তাঁর যেসব অমূল্য ভাষণগুলির মধ্য দিয়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন, সেই বক্তব্য সংবলিত পুস্তিকার ব্যাপক প্রচারের মধ্য দিয়ে প্রথমে জাতীয় স্তরে এবং পরে আন্তর্জাতিক স্তরে কমরেড শিবদাস ঘোষকে মার্কসবাদী চিন্তানায়ক এবং সর্বহারা বিপ্লবের নেতা হিসাবে তুলে ধরা ও প্রতিষ্ঠা করা।
এই উদ্দেশ্যে, বিশেষত শতবর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে গোটা দেশ জুড়ে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। অন্ততপক্ষে দেশের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ শহরে কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাসংবলিত পুস্তিকাগুলি ছাত্র-যুবক-শ্রমিক- চাষি-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী সহ সমস্ত অংশের মানুষকে দিতে হবে এবং নতুন নতুন জায়গায় গিয়ে পার্টি ও গণসংগঠন, শ্রেণিসংগঠন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। একই সাথে বিভিন্ন দেশের সমমনস্ক কমিউনিস্ট পার্টি ও গ্রুপগুলির সাথে যোগাযোগ করার জন্য আমাদের সর্বতোভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
এছাড়াও দেশের আপামর শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-যুবক-মহিলা-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কমরেড শিবদাস ঘোষের বৈপ্লবিক শিক্ষাগুলি আলোচনার দ্বারা তাদের শিক্ষিত, অনুপ্রাণিত ও সংগঠিত করতে হবে এবং বিপ্লবী আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।
দেশব্যাপী বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপকভাবে বুকস্টল ও কোটেশন এগজিবিশন করতে হবে।
অন্যান্য আরও কিছু কাজ সম্পর্কে আমি ‘আদর্শগত ও সাংগঠনিক সমস্যা প্রসঙ্গে আরও একবার’ পুস্তিকায় আলোচনা করেছি।
বিপ্লবী অভিনন্দন সহ
প্রভাস ঘোষ
২৫ জুন, ২০২২ সাধারণ সম্পাদক,
এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)