এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী দার্শনিক ও চিন্তানায়ক, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসহীন ধারার বিপ্লবী যোদ্ধা, ভারতবর্ষের মাটিতে একমাত্র সাম্যবাদী দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাতা-সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষ ১৯২৩ সালের ৫ আগস্ট তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশের) ঢাকা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ভারতের ও বিশ্বের শোষিত শ্রেণির সামনে তাঁর বিপ্লবী চিন্তাধারা, আদর্শ এবং সংগ্রামকে তুলে ধরে ভারতের তথা বিশ্বের সাম্যবাদী আন্দোলনকে দিশা দেখানোর উদ্দেশ্যেই আমরা ৫ আগস্ট ২০২২ থেকে বর্ষব্যাপী তাঁর জন্মশতবর্ষ উদযাপন করতে উদ্যোগী হয়েছি।
সমগ্র পুঁজিবাদী বিশ্ব চূড়ান্ত সঙ্কটে নিমজ্জিত। সারা বিশ্বে প্রবল ক্ষমতাশালী পুঁজিবাদী শোষণে সাধারণ মানুষ হাহাকার করছে। শ্রমিক শ্রেণির শক্তিশালী বিপ্লবী আন্দোলনের অনুপস্থিতিতে বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশেই সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী শাসন প্রতিক্রিয়াশীল জনবিরোধী শক্তিগুলিকে মাথা তুলতে আরও সাহায্য করছে। প্রায় সমস্ত পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশে সর্বব্যাপক মন্দার কারণে সরকারি-বেসরকারি অধিকাংশ কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অথবা বন্ধ হতে বসেছে, যার ফলে কোটি কোটি শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। সমস্ত দেশেই বেকারবাহিনী বিপুল সংখ্যায় বাড়ছে। তারা অভুক্ত এবং গৃহহীন অবস্থায় খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। এরই পরিণতিতে মুষ্টিমেয় কিছু ধনী আরও ধনী হচ্ছে এবং বিশাল সংখ্যক গরিব আরও গরিব হচ্ছে। কৃষকদের অবস্থাও অত্যন্ত শোচনীয়। নির্বাচন এখন সম্পূর্ণ প্রহসনে পরিণত হয়েছে, প্রতারণা চরম রূপ নিয়েছে। পাশাপাশি সমগ্র জাতিকে এক নৈতিক সঙ্কট গ্রাস করেছে। জনগণের নৈতিক মেরুদণ্ড ধ্বংস করার় চক্রান্ত চলছে। শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের সকল সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশের এই হচ্ছে চেহারা। সব দেশেই মানুষ এর থেকে মুক্তি চাইছে। বিক্ষোভও উত্তাল ঢেউয়ের মতো ফেটে পড়ছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির থেকে সংগঠিত, দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে উঠতে পারছে না। এ রাস্তায় পদক্ষেপ করতে হলে প্রকৃত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শের ভিত্তিতে প্রয়োজন সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব ও সঠিক সাম্যবাদী দল। মহান লেনিনের এই শিক্ষাকে বারবার তুলে ধরে কমরেড শিবদাস ঘোষ ভারতে সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টি এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-কে গড়ে তোলার জন্য তরুণ বয়সে ১৯৪০-এর দশকে এক অকল্পনীয় দুরূহ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
সিপিআই নেতাদের সততা ও আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়েও তাঁদের সকল নীতি ও কার্যকলাপের মার্কসবাদী বিশ্লেষণের ভিত্তিতে কমরেড শিবদাস ঘোষ এই স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এই দলটি একটি সঠিক কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে গড়ে উঠতে পারেনি। ফলে তিনি ভারতবর্ষে একটি সঠিক কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। অর্থ-সম্পদহীন, প্রচারহীন এক তরুণের এই দুঃসাহসিক সংকল্পকে সেদিন অনেকেই ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেছেন, অসম্ভব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোনও বিরুদ্ধ সমালোচনা ও বাধাই তাঁকে আটকাতে পারেনি। তিনি এক সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে বিপ্লবী-দুঃসাহসের সাথে দল প্রতিষ্ঠার কঠিন সংগ্রামে নিয়োজিত থেকেছেন। তাঁর সহযোগীদের বলেছেন, ‘‘যাঁরা এই দুঃসাহসিক প্রচেষ্টায় থাকার সাহস নিয়ে থাকতে পারবেন, তাঁরা থাকুন। অন্যেরা না পারলে চলে যান। আমি জানি, আমি অনাহারে রাস্তায় পড়ে মরে থাকতে পারি। বুঝব, ভারতবর্ষে বিপ্লবের আয়োজনের প্রয়োজনে এটা হয়ত দরকার ছিল। কিন্তু আমি যে সবার বিবেকের কাছে বিপ্লবী আদর্শ ও বিপ্লবী পার্টির অপরিহার্যতার আবেদন জানিয়ে যাব, তা ব্যর্থ হবে না, ব্যর্থ হতে পারে না। ইতিহাস তার মূল্য দেবেই।” আজ এই দলের সংগঠন ২৩টি রাজ্যে বিস্তার লাভ করেছে এবং সর্বত্রই এ দলের নেতা-কর্মীরা জনগণের সমস্যা সমাধানের দাবি নিয়ে লড়াই-আন্দোলন চালাচ্ছেন।
কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখালেন, মহান সাম্যবাদী আদর্শের মর্মবস্তু নিহিত আছে তার উন্নত নৈতিকতা ও সংস্কৃতির মধ্যে। তিনি আরও দেখালেন, স্বাধীন ভারতবর্ষ একটি পরিপূর্ণ পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, যাকে উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমেই একমাত্র মানুষের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধিত হতে পারে। তার ফলে অর্থনীতি, বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি– সব কিছুই অগ্রগতির পথে পদক্ষেপ করতে পারবে। আসলে ক্ষয়িষ্ণু মরণোন্মুখ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সমস্ত অগ্রগতির পথে জগদ্দল পাথরের মতো বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাই পুঁজিবাদ উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিপ্লব করতেই হবে। কিন্তু এ শুধু মুখে বললে বা গরম ভাষায় বত্তৃতায় বললে হবে না। এই নতুন উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য উন্নত চরিত্রের বিপ্লবী চাই। এই লক্ষ্যেই তিনি দলের নেতা ও কর্মীদের এমন ভাবে গড়ে তুলতে চাইলেন, যাতে তাঁরা দেশের শোষিত মেহনতি মানুষের সামনে আদর্শ ও দৃষ্টান্তমূলক চরিত্র হিসাবে দাঁড়াতে পারেন। শুরু থেকেই এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের মধ্যে বিপ্লবী চরিত্র গড়ার সংগ্রামের ওপরেই তিনি জোর দিয়েছেন।
দল গঠনের ওই কঠিন সংগ্রামের সময়েই তিনি আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতাদর্শগত আলোচনা উপস্থিত করলেন। মহান স্ট্যালিন ও মহান মাও সে তুং-কে নিজের শিক্ষক রূপে গণ্য করেও তিনি তাঁদের অন্ধভাবে অনুসরণ করার কথা বলেননি, নিজেও করেননি। তিনি দেখিয়েছেন, আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী নেতৃত্বের সঙ্গে একটি দেশের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্ক হবে দ্বান্দ্বিক।
কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে হাজার বার সরকার পরিবর্তিত হলেও পুঁজিবাদী শোষণের জোয়াল থেকে মানুষের মুক্তি সম্ভব নয়। মানবমুক্তির একমাত্র পথ হল সঠিক রাজনৈতিক মূল লাইনের ভিত্তিতে জনগণের বিপ্লবী সংঘবদ্ধ শক্তি গড়ে তোলা এবং শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা।
তিনি দেখালেন, বিপ্লবী তত্ত্ব মানে কেবল বিপ্লবের রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণ করা বোঝায় না। প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিকল্প হিসাবে জীবনের সর্বদিক সম্পর্কে মার্কসবাদী তথা সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ আয়ত্ত করা ছাড়া পুঁজিবাদকে ধ্বংস করা যাবে না। মার্কসবাদকে জীবনদর্শন হিসাবে গণ্য করে তিনি বললেন, যারা মার্কসবাদী হবে, তাদের সর্বহারা বিপ্লবী দলের নেতৃত্বে নিজেদের সমস্ত প্রকারের বুর্জোয়া চিন্তাভাবনা ও ব্যক্তিগত সম্পত্তিজাত মানসিকতা থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রাম করতে হবে এবং এই প্রক্রিয়ায় পেশাদার বিপ্লবীতে পরিণত হতে হবে। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকরণ, যৌথ নেতৃত্ব, দলের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি সকল বিষয়েই তিনি সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশ রেখে গেছেন, যেগুলি না জানলে ও চর্চা না করলে কোনও দেশেই আজকের যুগে যথার্থ বা সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠতে পারে না। তাঁর জন্মশতবর্ষ উদযাপন কালে এই সত্যটাও আমরা বিশ্বের সকল দেশের বিপ্লবী নেতা ও কর্মীদের কাছে তুলে ধরতে চাই।
ভারতবর্ষে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সামগ্রিক রূপরেখা তিনিই দিয়ে গেছেন। এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি ভারতবর্ষের সর্বহারা বিপ্লবের নেতা ও শিক্ষকে পরিণত হয়েছেন। এ দেশে যাঁরাই শোষিত শ্রমিক শ্রেণির মুক্তিসংগ্রাম তথা সর্বহারা বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তুলে তাকে সফল পরিণতিতে নিয়ে যেতে চান, তাঁদের সকলকেই কমরেড শিবদাস ঘোষের জীবন, সংগ্রাম ও শিক্ষাগুলিকে বারবার অধ্যয়ন করে আত্মস্থ করতে হবে। এই মহান নেতা ও শিক্ষকের জন্মশতবর্ষ উদযাপন এই আহ্বান নিয়েই আমাদের সামনে উপস্থিত।