কমরেড রণজিৎ ধর শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থে সমগ্র জীবন সমর্পণ করেছিলেন — স্মরণসভায় কমরেড প্রভাস ঘোষ

এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের পলিটবুরো সদস্য কমরেড রণজিৎ ধরের স্মরণসভা ২১ জুন হাওড়ার শরৎ সদনে অনুষ্ঠিত হয়৷ উপচে পড়া হলে অগণিত কর্মী–সমর্থকের উপস্থিতিতে প্রয়াত নেতার জীবন সংগ্রামের শিক্ষণীয় দিকগুলি তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ৷ সভার সভাপতি পলিটবুরো সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্য কেন্দ্রীয় কমিটির শ্রদ্ধার্ঘ পাঠ করেন৷ প্রকাশের আগে কমরেড সাধারণ সম্পাদক তাঁর ভাষণটিতে কিছু বিষয় যোগ করেন৷ সেটি প্রকাশ করা হল৷

কমরেড সভাপতি ও কমরেডস

আপনারা জানেন, স্মরণসভা আমরা প্রয়াত নেতা বা কর্মীর জীবনসংগ্রামের থেকে কী শিক্ষা নিতে পারি, তাঁর গুণাবলি থেকে কী শিক্ষা নিতে পারি এবং তাঁর মৃত্যুজনিত অভাবপূরণে কতটা ব্রতী হতে পারি এই উদ্দেশ্য নিয়েই করে থাকি৷ আমাদের জুনিয়র কমরেডরা চায় আমি আরও কিছুদিন বেঁচে যাতে কাজকর্ম করতে পারি৷ আমিও তাই চাই৷ কিন্তু দীর্ঘজীবনের একটা গুরুতর ব্যথার দিকও থাকে৷ পরপর বহু নেতা–সহকর্মী–জুনিয়র কর্মীর মৃত্যু এবং বহু অকাল মৃত্যুর দুঃখ ও দলের শহিদদের দুঃসহ শোক বহন করতে হয়– যা খুবই কষ্টের৷ এই হলেই সম্প্রতি কমরেড সি কে লুকোস, কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্যের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সেখানেও আমাকে বলতে হয়েছে৷

সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ মাল্যদান করছেন

কমরেড রণজিৎ ধরের সাথে প্রায় ৬৯ বছর ধরে আমি কাজ করেছি৷ ৬৯ বছরের বহু জটিল কঠিন সংগ্রাম ঝড়ঝঞ্ঝা সঙ্কট সমস্যা অনেক কিছুর মধ্যে দিয়েই আমাদের চলতে হয়েছে৷ এই মুহূর্তে সবকিছু গুছিয়ে বলাও আমার পক্ষে অসম্ভব৷

প্রথমেই আমি বলতে চাই, আমাদের যার যাই গুণ থাকুক, ক্ষমতা যোগ্যতা দক্ষতা থাকুক, তার কতটা আমাদের কৃতিত্বে অর্জিত আর কতটা যিনি আমাদের সর্বহারা বিপ্লবী মতাদর্শে অনুপ্রাণিত করেছেন শিক্ষিত করেছেন সযত্নে লালন পালন করেছেন সেই মহান নেতা ও শিক্ষকের জন্য অর্জিত, তা মনে রাখা দরকার৷ এ কথা নিশ্চয়ই সকলে একবাক্যে স্বীকার করবেন যে, আমরা সাধারণভাবে হারিয়েই যেতাম যদি না আমরা মহান শিক্ষক কমরেড শিবদাস ঘোষের সংস্পর্শে আসতাম৷

২১ জুন হাওড়ার শরৎ সদনে কমরেড রণজিৎ ধর স্মরণসভা

পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রথম স্তর কমরেড শিবদাস ঘোষ এবং কমরেডস নীহার মুখার্জী, শচীন ব্যানার্জী, সুবোধ ব্যানার্জী, প্রীতীশ চন্দ, হীরেন সরকার, এঁরা৷ দ্বিতীয় স্তর কমরেডস আশুতোষ ব্যানার্জী, সুকোমল দাশগুপ্ত, তাপস দত্ত, অনিল সেন, অমৃতেশ্বর চক্রবর্তী, শীতেশ দাশগুপ্ত, সনৎ দত্ত, ইয়াকুব পৈলান৷ এঁরা সকলেই প্রয়াত৷ তারপর তৃতীয় স্তরে হচ্ছি আমরা৷ আমাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন কমরেড রণজিৎ ধর, আর বয়োকনিষ্ঠ হচ্ছেন কমরেড অসিত ভট্টাচার্য৷ আমরা সকলেই একটা যুগের ফসল৷ সেই সময়টা হচ্ছে ভারতবর্ষের গৌরবোজ্জ্বল স্বদেশি আন্দোলনের শেষ পর্যায়৷ আমাদের শৈশব, কৈশোর, যৌবনের প্রারম্ভে এ দেশের নবজাগরণের যাঁরা পথিকৃৎ এবং স্বদেশি আন্দোলনের বীর যোদ্ধা, শহিদ, এঁদের নাম স্কুলে, কলেজে ঘরে ঘরে মধ্যবিত্ত পরিবারে আলোচ্য বিষয়বস্তু ছিল৷ এরই সাথে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাব, মহান স্ট্যালিন, মহান মাও সে তুং– এসব নাম আমাদের উজ্জীবিত করেছিল৷ এর সাথে সেই সময় সামাজিক জীবনে, পারিবারিক জীবনে যেসব উন্নত মূল্যবোধ জীবন্ত চর্চার বিষয় ছিল ঘরে বাইরে সর্বত্র, সেই আঁচে–তাপেই আমরা মানুষ হয়েছি৷ তার একটা ধারা ছিল প্রত্যক্ষ রাজনীতি করা৷ এখানে আমরা যে তিনজন আছি, সেখানে আমি নিজে দলে যুক্ত হওয়ার আগেই কমিউনিজমের আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম৷ তখন গভীরে বোঝার স্তর ছিল না৷ তাতেই রাজনীতি করার, কমিউনিস্ট হওয়ার একটা স্বপ্ন নিয়ে চলতে চলতে এই মহান দলের সংস্পর্শে আসি৷

কমরেড অসিত ভট্টাচার্যের সাথে যখন আমার যোগাযোগ হয় তার পরিবারটাই ছিল পুরনো কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত৷ তার প্রভাবও তাঁর মধ্যে ছিল৷ কমরেড মানিক মুখার্জী কমরেড নীহার মুখার্জীর ভাই৷ সেই পরিবারে কমরেড শিবদাস ঘোষের যাতায়াত ছিল৷ সেই প্রভাবটাও কাজ করেছিল তাঁর মধ্যে৷ কমরেড রণজিৎ ধরের একটু ভিন্ন ধারা ছিল৷ সেই যুগেরই আর একটা ধারা৷ রাজনীতিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেই সামাজিক কাজকর্ম– পরের বিপদে–আপদে ছুটে যাওয়া, আর্ত–পীড়িত মানুষের সেবা করার মতো সামাজিক কাজকর্মে লিপ্ত থাকা৷ কমরেড রণজিৎ ধর এই ধারাতেই দলের সংস্পর্শে আসেন৷ যিনি তাঁকে যোগাযোগ করিয়ে দেন তিনি বেশি দিন সক্রিয় ছিলেন না৷ কিন্তু তাঁর প্রচেষ্টায় দল একজন মূল্যবান, একজন সম্ভাবনাময় চরিত্রকে পেয়েছিল৷

 

এখানে আমি একটা কথা বলতে চাই৷ এখনকার অনেক নেতা–কর্মীদের অনেকেই যোগাযোগ বের করার নিজস্ব উদ্যোগ থাকে না৷ সেইসময় আমরা যারাই কাজ করতাম, যার যেখানে পরিচিতি, যোগাযোগ, আত্মীয় বন্ধু এমনকি রাস্তায় আলোচনা হচ্ছে, যেখানেই আলোচনা হচ্ছে যেভাবেই হোক তাকে কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার সাথে যুক্ত করার একটা প্রচেষ্টা ছিল খুব৷ তখন ছিল দুই পাঁচ দশ জন মানুষ নিয়ে কাজ৷ প্রত্যেকটি যোগাযোগকে আমরা খুব মূল্যবান মনে করতাম৷ এখনকার কর্মীরা অবহেলায় অনেক সম্ভাবনাপূর্ণ যোগাযোগ হারায়৷ উপযুক্ত নেতৃত্বের সংস্পর্শ পেলে কে যে কী হতে পারে, আগের থেকে বলা যায় না৷ সেজন্য সব যোগাযোগকেই যত্নের সাথে পরিচর্যা করতে হয়৷ এই যে যার নাম শোকপ্রস্তাবে উল্লিখিত হয়েছে, তিনি বেশি দিন সক্রিয় থাকলেন না, কিন্তু তিনি কমরেড রণজিৎ ধরকে যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে গেলেন৷ আমাকে যিনি কমরেড শিবদাস ঘোষের কাছে নিয়ে গেছেন, পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, তাঁকে আজও আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি, না হলে আমি হারিয়েই যেতাম৷ এই যে প্রচেষ্টাটা তখনকার দিনে কর্মীদের ছিল, সবার প্রথমে আমি এই কথাটা উল্লেখ করতে চাই৷

আমাদের সাথে রণজিৎদার আর একটা পার্থক্য ছিল৷ আমরা ছোটবেলা থেকে একটা সুশৃঙ্খল পরিবারে পিতা–মাতার স্নেহে–পরিচর্যায় বড় হয়েছি৷ তারপর আমার যেমন, বাড়ির সাথে বিচ্ছেদ হয়ে গেল৷ বাড়ির লোক রাজনীতি করতে দেবে না, আমি রাজনীতি করব৷ কমরেড অসিত ভট্টাচার্যের পরিবারে এস ইউ সি আই (সি) পার্টি করা না–করা নিয়ে একটা সংঘাত ছিল৷ ও পরে এমনিই কাজের প্রয়োজনে পরিবার ছেড়ে দিয়েছে, পরিবার থেকে বিতাড়িত হতে হয়নি৷ কমরেড মানিক মুখার্জীকেও পরিবার থেকে বিতাড়িত হতে হয়নি৷ ছোটবেলা থেকেই সেন্টারে এসে গিয়েছিল৷ কমরেড রণজিৎ ধরের জীবনে একটা শূন্যতা ছিল৷ মা মানসিক রোগী ছিলেন৷ বাবা ওকালতি করতেন, সংসার দেখতেন না৷ ফলে শৈশবেই অনেকটা ছন্নছাড়া জীবন ছিল তাঁর৷ তাঁর মুখ থেকেই শোনা যে, খাওয়া–দাওয়া, পড়াশোনা এসব দেখার কেউ ছিল না৷ এই অবস্থায় তাঁর বাবা তাঁকে এদেশে পাঠিয়ে দেন–যেভাবেই হোক কিছু করতে, থাকতে৷ অনেকটা এরকম আর কী৷ সবটা আমার জানা নেই৷ অনেকটা নদীর স্রোতে দিশাহীনের মতো ভাসতে ভাসতে কালীঘাটের ওই পাড়াতে উনি স্থায়ী হলেন৷ স্থায়ী হওয়া মানে কোনও ঘর নেই থাকার৷ আমি যখন তাঁকে দেখি, তখন উজ্জ্বলা সিনেমার পাশে কালী স্টুডিও ছিল৷ সেখানে বারান্দায় একটা বেঞ্চ ছিল৷ সেই বেঞ্চেই রাত কাটাতেন৷ কখনও কোনও বস্তির ঘরে কাটাতেন৷ এইরকম এলোমেলো জীবন ছিল৷ প্রেসে কাজ করতেন৷ মানে প্রেসের কাগজপত্র এখানে ওখানে মোট বওয়ার কাজ করতেন৷ রেস্টুরেন্টে থালা–বাসন মাজতেন৷ বয়ের কাজ করতেন৷ পরবর্তীকালে খাওয়ার বিনিময়ে টিউশনি করতেন এক বাড়িতে৷ স্নান করতেন উজ্জ্বলা সিনেমার একটা কল ছিল, সেখানে৷ কিন্তু পাড়ায় তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ও যোগাযোগ ছিল৷ রোগীর সেবা, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, মৃতদেহের সৎকার করা, পাড়ার যে কোনও ঘরের বিপদে–আপদে ছুটে যাওয়া– আরও অনেককে নিয়ে এই কাজটা তিনি করতেন৷ খুব সম্ভবত আমার থেকে কয়েক মাস আগেই দলের সাথে তাঁর যোগাযোগ৷ আমিও মাঝেমাঝে তাঁর কাছে যেতাম৷ আমারও তখন না–খাওয়ার দিন৷ ধরুন আজ সারাদিন খাবার জোটেনি৷ পরদিন সকালবেলা যেতাম৷ উনি আমার চেহারা দেখে বুঝতে পারতেন৷ উজ্জ্বলা সিনেমার একটা ক্যান্টিন ছিল৷ ওদের আগের দিনের যে খাবার উদ্বৃত্ত থাকত, সকালবেলা উনিও খেতেন, আমিও খেতাম৷ আমি একটু লাজুক ছিলাম৷ অনেক সময় প্রয়োজন থাকলেও সেখানে যেতাম না৷ আবার কখনও কখনও খিদের জ্বালায় বাধ্য হয়ে যেতাম৷ সেই সময় স্টাডি ক্লাস হত৷ আমরা ১৫/২০ জন থাকতাম৷ তার মধ্যে উনিও একজন ছিলেন৷ কমরেড শিবদাস ঘোষের আলোচনা আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম৷ সব না বুঝলেও একটা উত্তাপ অনুভব করতাম৷ 

সেইসময় বিভিন্ন আন্দোলন চলছে৷ ১৯৫৩ সালে ট্রামভাড়াবৃদ্ধি প্রতিরোধ আন্দোলনে গ্রেপ্তার হয়ে লালবাজারে উনি এবং আমি ছিলাম৷ জেলেও দেখেছি, বিভিন্ন দলের নেতা–কর্মীদের সাথেও সহজে তিনি মিশতেন৷ ’৫৪ সালে শিক্ষক আন্দোলনের মধ্যেও তিনি ছিলেন৷ সেইসময় গ্রেপ্তার হয়ে আলিপুর জেলে থাকার সময় আমার প্রচণ্ড জ্বর হয়েছিল৷ আমি অজ্ঞান হয়ে জেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম৷ আমার মাথার কাছে তিনি বসে থাকতেন, শুশ্রূষা করতেন৷ এই সেবার দিকটা আমার তখনই চোখে পড়েছিল৷

’৫৯ সালে খাদ্য আন্দোলনের সময় উনি পার্টির একটা হ্যান্ডবিল লিখেছিলেন৷ সেটা খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল৷ সেই হ্যান্ডবিল সিজ করার জন্য পুলিস পার্টি অফিসে এসেছিল৷ প্রকাশক ছিলেন আমাদের তৎকালীন অফিস সম্পাদক প্রয়াত কমরেড দুর্গা গুহ৷ তাঁকে পুলিশ এই হ্যান্ডবিলের জন্য অ্যারেস্ট করেছিল৷

এই যেমন একটা দিক, আবার মাঝেমাঝে তাঁর সাথে যোগাযোগ থাকত না৷ পাড়ার কাজে কোথায় চলে গেছেন– খুঁজে বের করতে হত৷ ছোটবেলায় তাঁর যে জীবন, তার একটা ধারা মাঝেমাঝে তাঁর মধ্যে কাজ করে গেছে৷ তাঁকে ডেকে আনতে হত, খুঁজতে হত৷ কখনও কমরেড মানিক মুখার্জীকে দিয়ে তাঁকে কমরেড ঘোষ ডেকে পাঠাতেন৷

আমি যখন ডিএসও–র রাজ্য সম্পাদক, তিনি তখন ডিএসও–র প্রথম কলকাতা জেলা সম্পাদক৷ যদিও তিনি বেশি দিন এই পদে ছিলেন না৷ পার্টির অন্য দায়িত্বে চলে যান৷ পরবর্তীকালে আমি পার্টির রাজ্য কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হলাম৷ তার কিছু দিন বাদে তিনিও অন্তর্ভুক্ত হলেন৷ আমি যখন রাজ্য সম্পাদক নির্বাচিত হই, সেই সম্পাদকমণ্ডলীতে তিনি সদস্য ছিলেন৷ আরও পরে আমি পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলাম৷ তিনি কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটবুরোর সদস্য হলেন৷ তিনি আমার থেকে ছ–সাত বছরের বড় ছিলেন৷ বড় হিসাবে যে শ্রদ্ধা প্রাপ্য, আমি এবং আমরা সকলেই তাঁকে তা দিতাম৷ আমি তাঁর থেকে বয়সে ছোট হওয়া সত্ত্বেও কোনও দিন তাঁকে নিয়ে কাজ করতে আমার কোনও অসুবিধা হয়নি৷ আমার চিন্তাভাবনা, কর্মপদ্ধতির প্রতি যথেষ্ট আস্থা তিনি বজায় রেখেছেন৷ তারপর তাঁর আরও কিছু কঠিন কাজ আমি দেখেছি৷ কমরেড সুকোমল দাশগুপ্ত যখন রাজ্য সম্পাদক, তখন কমরেড সুকোমলদা পুরুলিয়া এবং উত্তরবঙ্গের তিনটি জেলার দায়িত্বে ছিলেন৷ কলেজে অধ্যাপনা করতেন পার্টির প্রয়োজনে৷ তাঁর বেতনের টাকাটা পার্টির পক্ষে তখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ কমরেড সুকোমল দাশগুপ্ত যখন এই জেলাগুলিতে যেতে পারতেন না, কমরেড রণজিৎ ধর তখন পুরুলিয়া, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহারে প্রায়ই যেতেন, মিটিং করতেন, ক্লাস করতেন৷ কমরেড রণজিৎ ধর, আমি, কমরেডস হায়দার, কৃষ্ণ চক্রবর্তী, শীতেশ দাশগুপ্ত, গায়ত্রী দাশগুপ্ত, বাদশাদা– আমরা বীরভূমের ইলেকশনে ’৬২ থেকে ’৭২ পর্যন্ত এক–একজন এক একটা অঞ্চলের দায়িত্বে কাজ করেছি৷ আমাদের কারোরই তখন খাওয়া–থাকার কোনও সংস্থান ছিল না৷ কমরেড গোপাল কুণ্ডুও ছিলেন৷ ’৬৭ সালে কমরেড সাধনা চৌধুরীও গিয়েছিলেন৷ তারপর ’৮০–র দশকে বেশ কয়েকবার নির্বাচনে দক্ষিণ ২৪ পরগণার জয়নগর–কুলতলীর দায়িত্বে আমি ছিলাম, কমরেড রণজিৎ ধর মথুরাপুর–মন্দিরবাজারের দায়িত্বে ছিলেন৷ আমরা দু’জন একত্রে কাজ করেছি৷ অভিজ্ঞতার বিনিময় করেছি এবং এগুলির মধ্য দিয়ে তাঁকে আমার দেখা ও চেনার অনেক সুযোগ ঘটেছে৷

কমরেড রণজিৎ ধরের জীবনে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে কমরেড শিবদাস ঘোষের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসে৷ তাঁর লেখা দেখে কমরেড শিবদাস ঘোষ আকৃষ্ট হন৷ এখানে আর একটা কথাও বলা দরকার৷ সেইসময় পশ্চিম বাংলার একটা বিখ্যাত দুর্গাপুজো কংগ্রেস প্রভাবিত কালীঘাটের ‘সঙঘশ্রী’ ক্লাব করত৷ তার সম্পাদক ছিলেন তিনি৷ তিনি ঈশ্বরবিশ্বাসী নন৷ কিন্তু অত্যন্ত সৎ, দায়িত্বশীল বিবেচনা করে তাঁকেই বারবার সম্পাদক রাখা হত৷ যেহেতু আর্থিক দিক থেকে তিনি অত্যন্ত সৎ এবং পরিচালনার দিক থেকে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন৷ ক্লাবের ম্যাগাজিনে তিনি কিছু কিছু লিখতেন৷ এখান থেকেই তাঁর লেখার শুরু৷ শ্যামাপ্রসাদ কলেজে তিনি ছাত্রসংসদে নির্বাচিত হয়ে ম্যাগাজিন সম্পাদক হয়েছিলেন৷ সেখানেও তাঁর লেখার চর্চা ছিল৷ গণদাবীতেও মাঝেমাঝে লিখতেন৷ কালীঘাটে কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলার নির্বাচনে প্রথমবার তিনি অল্প ভোটে হারেন৷ একদিকে শক্তিশালী কংগ্রেস, সিপিএম, আর অন্য দিকে আমরা৷ পরের বার তিনি জেতেন৷ এই দুটি নির্বাচনে আমার দায়িত্ব ছিল পরিচালনার৷ পার্টির তখন অত প্রভাব ছিল না৷ কমরেড রণজিৎ ধরের প্রভাবেই কালীঘাটের গোটা যুবশক্তি সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে পার্টিকর্মীর মতো৷ তা ছাড়া তখন দক্ষিণ কলকাতার আশুতোষ কলেজ, যোগমায়াদেবী কলেজ, চারুচন্দ্র কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন এআইডিএসও পরিচালনা করত৷ অন্যান্য কলেজেও আমাদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল৷ এটাও এই নির্বাচনে কাজে লেগেছে৷ দ্বিতীয়বার  নির্বাচিত হয়ে তিনি টাউন প্ল্যানিং কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন৷ তখন তিনি তাঁর ভূমিকার দ্বারা অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছিলেন৷ তাঁর কর্মপদ্ধতি, নিষ্ঠা, সততা, দায়িত্ববোধ প্রভৃতি একটা আলোচ্য বিষয়বস্তু হয়ে গিয়েছিল বিভিন্ন দল, নির্দল সকলের মধ্যেই৷ এসব জায়গায় তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়ে গেছেন৷

মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ অতি অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী বিপ্লবী সংগঠকও ছিলেন৷ একবার ভেবে দেখুন, কী কঠিন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মুষ্টিমেয় সঙ্গী নিয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সাথে তিনি আমাদের দলকে প্রতিষ্ঠা করেছেন৷ একমাত্র তাঁর শিক্ষাকে হাতিয়ার করেই আজ দল কত বড় হয়েছে৷ তিনি প্রত্যেক কমরেডের বিশেষ গুণ কী, বিশেষ বৈশিষ্ট্য কী, এই সব কংক্রিটলি বুঝে কাকে কীভাবে বিকশিত করতে হয়, এ ব্যাপারে অত্যন্ত উন্নত স্তরের অসাধারণ সাংগঠনিক প্রতিভার পরিচয় দিয়ে গেছেন৷ কমরেড মানিক মুখার্জীকে যেভাবে দেখেছেন, আমাকে সেভাবে দেখেননি৷ আমাকে যেভাবে দেখেছেন, কমরেড অসিত ভট্টাচার্যকে সেভাবে দেখেননি৷ কমরেড রণজিৎ ধরকে আরেকভাবে দেখেছেন৷ কাকে কীভাবে ডেভেলপ করানো যায় প্রত্যেকের পার্টিকুলার বৈশিষ্ট্যকে স্টাডি করে করে সেটাই তিনি করেছিলেন৷ যেমন আমার ক্ষেত্রে বলি৷ তিনি আমাকে প্রথম দিকে কোনও নেতার অধীনে কাজ করতে দেননি৷ নিজেও কাজের ব্যাপারে ইনস্ট্রাকসন দিতেন না৷ প্রথমে আমি দুঃখ পেয়েছিলাম এই ভেবে যে আমার ব্যাপারে তাঁর ইন্টারেস্ট নেই৷ পরে জানলাম তিনি সবই লক্ষ রাখতেন৷ শুধু আমি নয়, অন্য জেলার, অন্য রাজ্যের, দূর গ্রামের প্রায় সব কর্মীরই খোঁজ নিতেন, গাইড করতেন৷ কিন্তু আমার ব্যাপারে এই ব্যতিক্রম হল কেন? অনেক পরে ভেবে দেখেছি, আমার স্ট্যান্ডার্ড যাই হোক, আমি একাগ্র মনে কাজ করতাম, আমার প্রথম দিকেই নিজস্ব উদ্যোগে কাজ করার অভ্যাস ছিল৷ এটা ব্যাহত হোক তিনি চাননি৷ এমনকি ভুল করতেও দিয়েছেন, যাতে তার থেকে শিখি৷ গুরুতর ভুল করে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিলাম একবার৷ তিনি, কেন ভুল করলাম, এ জন্য একবারও সমালোচনা করলেন না৷ সস্নেহে আমাকে কাছে টেনে সাহচর্য দিয়ে অনুপ্রাণিত করেছিলেন৷ আবার এই প্রক্রিয়ায় আমি যেমন ডিএসও গঠন পর্বে আরও উদ্যোগী হলাম, হাতে–কলমে কাজ করে কিছু শিখলাম, আবার আমার তত্ত্বগত অজ্ঞতার জন্য অজ্ঞাতসারে একক চিন্তা ও ক্রিয়ার অভ্যাস গড়ে উঠল– যেটা কালেকটিভের অন্তরায়৷ উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি আমাকে ত্রুটিমুক্ত করার জন্য বোঝালেন, তীব্র ভর্ৎসনাও করেছিলেন৷ এই ভর্ৎসনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না৷ আমি প্রথম দিন কেঁদে বললাম, ‘আপনি আর আমাকে ভালবাসেন না৷’ তখন উত্তরে যা বললেন, আজও আমার মনে গাঁথা হয়ে আছে৷ তিনি বললেন, ‘‘তুমি দেখেছ সামান্য ভুলের জন্য আমি নীহার মুখার্জী, শচীন ব্যানার্জী, সুবোধ ব্যানার্জীকে কীরকম তীব্রভাবে বকাবকি করি৷ তোমাকে বকব না সেদিন যেদিন তোমার উপর আমার আর ভরসা থাকবে না৷’’ তাঁর এই মন্তব্য আজও প্রায় প্রতিদিন আমার মনকে তাড়া করে বেড়ায়– চলার পথে তাঁর এই ভরসার মূল্য দিতে পারছি কি না৷ তাই বলছিলাম, শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়, প্রত্যেককে আলাদা স্টাডি করে সেইভাবে ডেভেলপ করাতেন৷ এবার রণজিৎদার আলোচনায় আবার আসি৷

‘রণজিৎদা’ কথাটাই মুখে আসে, আমরা সেই নামেই বলতাম৷ দলের মধ্যে তাঁর পরিচয় রণজিৎদা হিসাবেই৷ শৈশব থেকে যে স্নেহ–মমতা রণজিৎদা পরিবার থেকে পাননি, এই অভাবটা কমরেড ঘোষ বুঝেছিলেন৷ আর তাঁর লেখার দক্ষতা আকৃষ্ট করেছিল৷ এই দুটিকে ভিত্তি করেই কমরেড শিবদাস ঘোষ তাঁকে বুকে টেনে নেন এবং সযত্নে তাঁকে গড়ে তোলেন৷

কমরেড শিবদাস ঘোষের আরেকটা দিক অনেকেই জানেন না৷ আমি তাঁকে কলম ধরতে দেখিনি কখনও৷ বোধহয় প্রথম জীবনে ‘সাম্যবাদী শিবিরের আত্মসমালোচনা’ তাঁর লিখিত রচনা৷ সেইসময় কিছু কিছু লিখতে হয়েছিল তাঁকে৷ বিশ্বের অন্যান্য সাম্যবাদী নেতারা সকলে লিখিত বক্তব্যই বলেছেন, বই লিখেছেন৷ সেগুলি সকল কমিউনিস্টের কাছে অমূল্য সম্পদ৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ কিন্তু যে কোনও বিষয় মুখেই আলোচনা করতেন৷ দর্শনের জটিল তত্ত্ব হোক, রাজনীতির দুরূহ প্রশ্ন হোক, কঠিন সাংগঠনিক সমস্যা হোক, সাহিত্য–সংস্কৃতি হোক,  ক্লাসে মিটিংয়ে অত্যন্ত সুবিন্যস্তভাবে তিনি এক্সটেম্পোর ডিসকাশন করে যেতেন৷ এ এক বিস্ময়কর ক্ষমতা৷ আমার একটা কথা মনে হয়েছে যে, এত দ্রুত তাঁর চিন্তার গতি, বলার মধ্যে দিয়ে যা দেখতাম, লিখতে গেলে সেটা ব্যাহত হত৷ লেখাটা স্লো, বলাটা আরও অনেক দ্রুত, ফলে তাঁর পক্ষে লেখায় অসুবিধাই হত৷ তাঁর চিন্তার যা গতি, সেটাকে দ্রুত লেখায় প্রকাশ করা সমস্যা হত৷ সম্ভবত এই কারণেই তিনি লেখেননি, আলোচনা করেছেন অনেক৷ প্রথম যুগের অনেক আলোচনা, যখন অনেকটা আমাদের না–বোঝার স্তর, সেগুলির কিছু নোট আছে এই পর্যন্ত, প্রায় হারিয়ে গেছে৷ ১৯৫৯ সালে ‘মার্কসবাদ ও মানবসমাজের বিকাশ প্রসঙ্গে’ বক্তব্যটি ভাটপাড়ার এক পার্টিকর্মীর বন্ধু আমেরিকা থেকে একটা টেপ রেকর্ডার এনেছিল তাতে রেকর্ড করা সম্ভব হয়৷ এরপরে আবার টেপে রেকর্ড করার সুযোগ ছিল না৷ ’৬৭ সালে পার্টির কিছু আর্থিক সামর্থ্য হয় একটা টেপ রেকর্ডার কেনার৷ ওনার বক্তব্য যা কিছু সংরক্ষিত করা গেছে তা এইসময় থেকেই৷ ফলে কমরেড ঘোষের অতীতের বহু মূল্যবান আলোচনা অনেক কমরেডের স্মৃতিতেই ছিল, যাঁরা অনেকেই এখন আর জীবিত নেই৷ কিন্তু সেগুলি রেকর্ডেও নেই৷ এ ইতিহাসের এক বিরাট ক্ষতি৷ এখানে আমি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে চাই কমরেড ঘোষের ভাষণ সম্পাদনা করার ক্ষেত্রে কমরেড রণজিৎদা বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন৷ সম্পাদনা মানে –কমরেড ঘোষ বক্তৃতা দিয়েছেন, সেই বক্তৃতা কমরেড রণজিৎদা ক্যাসেট থেকে প্রথম লিপিবদ্ধ করতেন৷ কমরেড ঘোষ সেটা শুনতেন, কোথাও কোথাও শব্দ বা বাক্য পরিবর্তন করে দিতেন৷ প্রতিটি সংস্করণেই তিনি এটা করতেন৷ এই কাজটা শরৎচন্দ্রও তাঁর সাহিত্যে বারবার করেছেন৷ যাতে বক্তব্য আরও ডিসিসিভ হয়৷ কোথাও কোথাও কমরেড ঘোষ আরও পয়েন্ট যোগ করে দিয়েছেন৷ কমরেড ঘোষ ডিকটেশন দিতেন তা নয়, তিনি বক্তৃতার ঢংয়েই মুখে বলতেন৷ রণজিৎদা শুনতেন বা নোট করতেন৷ সেগুলি পরে কমরেড ঘোষের ভাষায় তাঁরই ঢংয়ে প্রকাশ করে লেখা কত কঠিন কাজ এ কাজে রণজিৎদার দক্ষতা, নিষ্ঠা ও ধৈর্য খুবই প্রশংসনীয় ছিল৷ তিনি লিখে আনতেন, কমরেড ঘোষ শুনতেন, ঠিক হয়েছে কি না দেখতেন৷ প্রয়োজনে আবার সংশোধন বা পরিবর্তন করতেন৷ আবার রণজিৎদা লিখে আনতেন৷ এরপর কমরেড ঘোষ অ্যাপ্রুভ করতেন৷ কখনও তাড়াতাড়ি হত, কখনও সময় লাগত৷ যেমন কমরেড ঘোষের একটা মূল্যবান বক্তব্য ‘কেন এস ইউ সি আই (সি) ভারতবর্ষের মাটিতে একমাত্র সাম্যবাদী দল’ আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনেরই মূল্যবান একটি সম্পদ৷ এই বক্তব্যও হারিয়ে যেত৷ এই আলোচনা উনি করেন ১৯৬৭ সালে জলপাইগুড়িতে৷ কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তী উপস্থিত ছিলেন৷ তাঁর একটা অসাধারণ ক্ষমতা ছিল স্মৃতিতে ধরে রাখার৷ ’৬৫ সালে আমার একটা বক্তব্য ‘শিক্ষাসংস্কৃতি ও নৈতিকতার সঙ্কট প্রসঙ্গে’ কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তীই নোট করে আমাকে দেখান৷ আমি এডিট করে দিই, পরে ছাপানো হয়৷ এই বইয়ের মধ্যে বিশেষ তত্ত্ব ছিল না৷ কিন্তু কমরেড শিবদাস ঘোষের ওই আলোচনা অত্যন্ত মূল্যবান তত্ত্বসমৃদ্ধ৷ কীভাবে একটা কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে হয়, বিপ্লবী দলের চরিত্র কী, বৈশিষ্ট্য কী, গণতান্ত্রিক একেন্দ্রীকরণ কীভাবে গড়ে তুলতে হয়, যৌথ নেতৃত্ব কাকে বলে, যৌথ নেতৃত্বের কংক্রিট এক্সপ্রেশন কাকে বলে, সর্বহারা সংস্কৃতি কী, এসব থেকে শুরু করে বহু অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ আছে এই আলোচনায়৷ কৃষ্ণ চক্রবর্তী নোট করে কমরেড শিবদাস ঘোষকে দেন৷ এই নোটটা না দিলে কিন্তু এই বইটা আমরা পেতাম না৷ তারপর কমরেড শিবদাস ঘোষ কমরেড রণজিৎদাকে নিযুক্ত করে নোটটাকে ভিত্তি করে নতুন পয়েন্ট যুক্ত করে দিনের পর দিন আলোচনাটাকে সমৃদ্ধ করেন৷ এই সম্পাদনার কাজটা শুধু ভাষাজ্ঞানের দ্বারা হয় না৷ ভাষাজ্ঞানের সাথে দরকার একজন এই আলোচনাটা কতটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে৷ এই উপলব্ধি করতে পারা এবং সেই উপলব্ধিকে ব্যক্ত করার কাজটি তিনি করেছেন৷ আর কমরেড শিবদাস ঘোষ তাকে আরও নিখুঁত করার দিকে নিয়ে গেছেন৷ কমরেড ঘোষ বলতেন, আমার কালকের বক্তৃতায় তোমরা মুগ্ধ হয়েছ, কিন্তু আমি সন্তুষ্ট নই৷ আরও উন্নত করতে হবে৷ একটা শব্দ, একটা এক্সপ্রেশনও ওঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ মহান নেতার সাথে থেকে এইভাবে কাজ করতেন কমরেড রণজিৎ ধর৷ ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত কমরেড শিবদাস ঘোষের যত বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে প্রত্যেকটি বক্তব্যের ক্ষেত্রেই কিন্তু কমরেড রণজিৎ ধর ভূমিকা নিয়েছেন৷ তাঁর এই ভূমিকার জন্য গোটা পার্টিকে কৃতজ্ঞতার সাথে তাঁকে স্মরণ করতে হবে৷ আবার এই কাজটা করতে করতেও কমরেড রণজিৎ ধরের মধ্যে একটু ছাড়াছাড়া যে ভাব ছিল– যেটা আমি আগেই বলেছি ছোটবেলার থেকে তাঁর ওইভাবে গড়ে ওঠার ফলে– কমরেড শিবদাস ঘোষের সংস্পর্শে এসে সেটার থেকেও তিনি অনেকখানি মুক্ত হতে পেরেছিলেন৷ কেউ হয়তো কমিউনে মাছ পাঠিয়েছে, কমরেড শিবদাস ঘোষ খুঁজতে পাঠাতেন রণজিৎদা কোথায়৷ খুব আদর করে তাঁকে খাওয়াতেন৷

অনেকে জানেন না, ভাবেন যে কমরেড শিবদাস ঘোষ বোধহয় সবসময় গালে হাত দিয়ে বসে ভাবতেন৷ না, তিনি একদম এরকম ছিলেন না৷ তিনি সব সময়ই সব ব্যাপারে প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন৷ আড্ডা মারতেন, ক্যারম খেলতেন, তাস খেলতেন, দাবা খেলতেন৷ তাস খেলার মধ্যে কমরেডস শচীন ব্যানার্জী, মণি চ্যাটার্জী, রবি বসু ছিলেন৷ রণজিৎদাও ছিলেন৷ এসব খেলা শুধু খেলা নয়৷ এর মধ্যে দিয়েও তিনি মানুষকে পাল্টাতেন৷ তিনি ক্ল্যাসিকাল গান, পুরনো দিনের গান, সেতার–সরোদ শুনতেন, খেলাধূলা–নাটক–সিনেমায় তাঁর ইন্টারেস্ট ছিল৷ সাহিত্যের বই পড়তেন, শরৎসাহিত্য পড়তে গিয়ে তো তাঁর কণ্ঠস্বর আবেগে রুদ্ধ হয়ে যেত৷ এসব নিয়ে তিনি যে মার্কসবাদী বিশ্লেষণ করতেন, সেটা খুবই আকর্ষণীয় ছিল৷ বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের মহান নেতাদের ছাড়াও তিনি অতীতের বড় মানুষদের, বিভিন্ন ধর্মের প্রবর্তকদের, নবজাগরণের মনীষীদের, পশ্চিমের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও আমাদের দেশের মহান ব্যক্তিদের, বীর শহিদদের জীবনসংগ্রাম নিয়ে আলোচনা করতেন৷ এঁদের থেকে নিজেও নিয়েছেন, আমাদেরও শিখতে বলতেন৷ তিনি বলতেন, আমি সকলের কাছ থেকেই শিখি, ফুটপাথের মানুষের থেকেও শিখি৷ অন্য দলের নেতা ও কর্মীদের গুণ থেকেও শিখতে বলতেন৷ অন্য দলের নেতাদের নিয়ে কুৎসা, নিন্দা একদম পছন্দ করতেন না৷ নানা প্রশ্নে যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা করতেন৷ প্রতিদিন বিকালে পার্টি অফিসে নানা প্রশ্নে ঘন্টার পর ঘন্টা নানা শিক্ষণীয় আলোচনা করতেন৷ কখন যে রাত গভীর হয়ে যেত, সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনত, কারও খেয়াল থাকত না৷ আমি মাঝে মাঝে এসব শুনতাম, মূল্যবান সম্পদ আহরণ করতাম, উদ্দীপিত হতাম৷ কমরেড রণজিৎদা সহ সেই সময়ের অনেকেই এ সবের দ্বারা খুব প্রভাবিত হয়েছেন৷ সাধারণ শ্রমিক–কৃষক পরিবার থেকে যাঁরা তাঁর সাথে দেখা করতে আসতেন, এমনকি কমরেডদের বাবা–মায়েরাও যখন আসতেন, তিনি তাঁদের সাথে আপন হয়ে আলোচনা করতেন৷ শিশুদের সাথেও অনায়াসে মিশতেন, খেলাধূলা করতেন৷ একবার একটি শিশু বার বার ক্যারম খেলায় হেরে কাঁদছিল৷ আমি তখন কমরেড ঘোষকে বললাম, ওকে একবার জিতিয়ে দিন না৷ উনি বললেন, ও বার বার হেরে জেতার জন্য লড়াই করুক, তাতে ওর জেদ ও প্রতিজ্ঞা বাড়বে৷ এরকম অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে বহু শিক্ষা দিয়ে গেছেন৷

কমরেড শিবদাস ঘোষের নিবিড় সাহচর্য এবং স্নেহের সাথে রণজিৎদাকে গড়ে তোলার যে প্রচেষ্টা, এটা তাঁর উত্তরণের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল৷ ঘরে কেউ নেই, লাইট জ্বলছে, কমরেড শিবদাস ঘোষ বিরক্ত হতেন৷ বলতেন পার্টির টাকা অপচয় হচ্ছে৷ অসুস্থ শরীরে কমরেড রণজিৎ ধর স্নান করাচ্ছেন, সাবান মাখাচ্ছেন৷ বলতেন, এরকমভাবে সাবান গায়ে ঘসতে নেই৷ আগে ফ্যানা করুন, না হলে সাবান বেশি খরচ হবে, পাবলিক মানি ওয়েস্ট হবে৷ কলের তলায় বালতি জলে ভরে যাওয়ার পরে আরও জল পড়লে বকতেন৷ বলতেন, লেবার পাওয়ারের মিস ইউজ হচ্ছে৷ মানে শ্রমিকরা পরিশ্রম করে জল পাঠাচ্ছে, তাঁদের শ্রমের অপচয় হচ্ছে৷ এই সমস্ত ছোটখাটো জিনিসও কমরেড শিবদাস ঘোষ কত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে লক্ষ রাখতেন এবং শিক্ষা দিতেন৷ এসব রণজিৎদার থেকেই শোনা৷

আমার তো অন্য রকম জীবন ছিল৷ আমি তা আগেই আপনাদের বলেছি৷  কমরেড মানিক মুখার্জী তো একটা বড় সময় কমরেড শিবদাস ঘোষের সাথে ছিলেন৷ কমরেড অসিত ভট্টাচার্য কলকাতায় এলে ওনার সাথে থাকতেন৷ আমি একবার একটা দিন ও এক রাত শুধু ওনার সাথে সিউড়িতে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম৷ আমি প্রয়োজনে যেতাম, তিনিও প্রয়োজনে ডাকতেন৷ রাতে পার্টি অফিসে দেখতাম কোনও বিষয়ে আলোচনা করছেন, গাইড করছেন৷ হাঁপানি রোগ নিয়ে ভেতরে, বন্ধ অফিস ঘরে বেশিক্ষণ থাকতে পারতাম না৷ তার মধ্যেও শোনার ও বোঝার চেষ্টা করতাম৷ আমার তখন একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল, যে কোনও ছাত্র–ছাত্রীকে কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা৷ যে কোনও স্কুল–কলেজে তাঁর চিন্তায় সংগঠন গড়ে তোলা৷ ফলে বেশিরভাগ সময় বাইরেই কাটাতাম৷ যার ফলে অনেক মূল্যবান আলোচনা শোনা মিস করেছি৷ এটা আজ আমার কাছে এক প্রতিকারহীন বেদনা হয়ে আছে৷ এর থেকে আমার যা আহরণ করার, আমি তা আহরণ করেছি, আজও করে চলেছি৷ এর মানে এই নয় যে, আমি যতটুকু শিখেছি এমনি এমনি শিখেছি৷ আমার যা কিছু গুণাবলি সবই তাঁর কাছ থেকেই শেখা৷ কাছে থাকি আর দূরেই থাকি, আমি মন দিয়ে তাঁর মার্কসবাদী বিচারধারা, নানা বিষয়ে বিশ্লেষণ, বিভিন্ন সাংগঠনিক সমস্যা ও কমরেডের সমস্যা ট্যাকল করা– এগুলি লক্ষ করতাম, শেখার চেষ্টা করতাম৷ না বুঝতে পারলে সরাসরি ওনাকে প্রশ্ন করতাম৷ কখনও কখনও না বুঝতে পেরে তর্ক করতাম৷ উনি ধৈর্যের সাথে ধরিয়ে দিতেন৷ কর্মীদের তর্ক–বিতর্ক করতে দেওয়া, মন খুলে যে কোনও কথা বলতে দেওয়া, এটা তিনি সকলের ক্ষেত্রেই করেছেন৷ আবার জুনিয়ারদের কোনও পয়েন্ট কারেক্ট মনে হলে গ্রহণও করতেন৷ অবশ্য রণজিৎদাকে কখনও তর্কবিতর্ক করতে দেখিনি৷ কিন্তু এটা বুঝেছি, সমস্ত আলোচনা মন দিয়ে শুনতেন ও গ্রহণ করতেন৷ আবারও বলছি, কমরেড শিবদাস ঘোষের ভাষণ প্রকাশের ক্ষেত্রে রণজিৎদার ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং এক অর্থে বলতে গেলে আমরা এর জন্য কৃতজ্ঞ৷

আরেকটা খুবই প্রশংসনীয় কাজ তিনি করেছেন৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ ’৭২ সালে ভাইরাল অ্যাটাকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ প্যারালিটিক হয়ে যান৷ একমাত্র ব্রেন, হার্ট, ফুসফুস এরকম কিছু জায়গা বাদ দিলে বাকি সব অঙ্গই অচল হয়ে গিয়েছিল৷ কমরেড ঘোষ ধরেই নিয়েছিলেন যে তিনি বাঁচবেন না৷ ফলে পার্টির টাকা অপচয় করা ঠিক হবে না৷ বলেছেন আমি পার্টি কমিউনে পার্টিকর্মীদের মধ্যেই মারা যাব৷ তখন সকলে মিলে সিদ্ধান্ত করে বলা হল, আপনার চিকিৎসার জন্য আপনাকে নার্সিং হোমে পাঠানো হবে৷ এটা পার্টির সিদ্ধান্ত৷ এখানেও কমরেড শিবদাস ঘোষের আর একটা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে চাই৷ তিনি পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, শিক্ষক৷ উনি মনে করছেন, বাঁচবেন না, চিকিৎসা করলে পাবলিক মানির অপচয় হবে৷ কিন্তু যে মুহূর্তে শুনলেন চিকিৎসা করানো পার্টির সিদ্ধান্ত, একটা কথাও আর উচ্চারণ করলেন না৷ যে এথিক্স তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, পার্টি যা সিদ্ধান্ত নেবে, তা মানতে হবে– তিনি তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন৷ হাসপাতালের ডাক্তারকে বলেছেন, আমার কমরেডরা বুঝবে না, তারা আবেগ থেকে বলছে, আপনারা ডাক্তার, আপনারা তো বোঝেন, তাদের বোঝান৷ ডাক্তার বলছেন, আমাকে ৭২ ঘন্টা সময় দিন৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ তখন একটা আঙুলও নাড়াতে পারতেন না৷ কোনও কিছু করতে পারতেন না৷ এরকমই অবস্থা ছিল তাঁর, খুব যন্ত্রণা হত৷ রণজিৎদা দিনরাত তাঁর সেবা করে গেছেন৷ এক দিনের ঘটনা কমরেড ঘোষের কাছ থেকে শোনা৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ রণজিৎদাকে বলছেন, কেন আপনারা এত পরিশ্রম করছেন? পার্টির টাকা নষ্ট করছেন? রণজিৎদা কেঁদে ফেলেছেন৷ বলেছেন, আপনি মারা গেলে আমরা কী করে বাঁচব? কমরেড ঘোষ বললেন, ওনার চোখের জল আমাকে থামিয়ে দিল৷ তারপর তিনি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলেন৷ নার্সিং করা, সেবাযত্ন করা সবই দিন রাত জেগে রণজিৎদাই করেছেন৷ বাইরের কোনও নার্স ছিল না৷ ডাক্তারেরা বলেছেন তিন বছর লাগবে আপনার ঠিক হতে৷ কমরেড ঘোষ সিদ্ধান্ত নিলেন, তিন বছর নয়, এক বছরের মধ্যে উনি খাড়া হবেন৷ এই সময় পার্টির প্রথম গাড়ি কেনা হল কমরেডদের ডোনেশনে৷ গড়ের মাঠে ওনাকে নিয়ে আসতেন রণজিৎদা এবং কমরেড সুনীল পাল৷ কমরেড ঘোষ পা ফেলতে পারতেন না, টলতেন৷ দু’জন দু’পাশে থাকতেন৷ দু’পা হাঁটলেই ওনার দরদর করে ঘাম ঝরত৷ এইভাবে রণজিৎদা তাঁকে নিয়ে দিনের পর দিন চেষ্টা করে গেছেন৷ এইভাবে সেবাযত্ন করে কমরেড শিবদাস ঘোষকে বাঁচাবার জন্য যে সার্ভিসটা রণজিৎদা টানা দিয়েছেন, সে জন্য তাঁর মধ্যে কোনও শ্রান্তি–ক্লান্তিবোধ ছিল না৷ কমরেড ঘোষ এক বছরের মধ্যেই আবার সক্রিয় হয়ে গেলেন অবিশ্বাস্য সংগ্রাম করে৷

কমরেড ঘোষের মৃত্যুর দিনেও ১৯৭৬ সালের ৫ আগস্ট সকাল থেকে আমরা উপস্থিত ছিলাম টালার কমিউনে৷ পরপর কয়েক বার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে৷ কমরেড ঘোষ একদিকে কাত হয়ে শুয়ে আছেন৷ পিছনে রণজিৎদা বসে সেই ভোরবেলা থেকে আস্তে আস্তে পিঠে হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন যাতে যন্ত্রণার এতটুকুও উপশম হয়৷ মানে তাঁর দেহের সাথে যেন মিশে আছেন যখন কমরেড ঘোষ কমরেড শচীন ব্যানার্জীকে অস্ফুট স্বরে ডাকলেন, হাতটা ধরলেন, কমরেড শচীন ব্যানার্জী কেঁদে ফেলেছেন৷ তারপর আমাকে ডাকলেন, আমি ভয়ে গেলাম না৷ গেলে তো আরও ভেঙে পড়ব, এটা হার্টের রোগীর পক্ষে ক্ষতিকর হবে৷ কমরেড ঘোষ নিঃশব্দে একটার পর একটা হার্ট অ্যাটাক সহ্য করছেন৷ রণজিৎদা পিছনে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন৷ সন্ধ্যাবেলা যখন কমরেড শিবদাস ঘোষ শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, তখনও রণজিৎদা কিছুই বুঝতে পারেননি, হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন৷ ঘরে বাকিরা যখন কেঁদে উঠল তখন তিনি চমকে গেলেন৷ আমি পাশের ফাঁকা ঘরে ছুটে চলে এসেছি৷ জানলায় হাত দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কাঁদছি৷ চমকে দেখি পিঠে কমরেড নীহার মুখার্জীর হাত৷ বললেন, এখন কান্না থামাও৷ অফিসে যাও, সকলকে খবর দাও৷ পাশের ঘরে দেখছি রণজিৎদা শিশুর মতো চিৎকার করে কাঁদছেন৷ অফিসে এসে যা করার করলাম৷ তারপরে শোকমিছিল হল৷

এখানে কমরেডদের আর একটা কথা আমি বলতে চাই, পরে বলার সুযোগ পাব কি না জানি না৷ রণজিৎদা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আমার নিজের কথাও কিছু কিছু এসে গেছে৷ কমরেড সুবোধ ব্যানার্জীর শোকমিছিল যখন হয়, কলকাতায় আলোড়ন হয়েছিল৷ একটা যথার্থ শোকের মিছিল৷ পরে কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাকে বলেছিলেন, পরে যখন শোকমিছিল করবে গ্রামের চাষিরা যেখানে মিছিলে থাকে সেখানে মধ্যবিত্ত ভলান্টিয়ার দিও৷ সেইসব স্থানে মিছিল সেদিন কিছুটা এলোমেলো হয়েছিল৷ পরের মিছিল বলতে কোন মিছিল তিনি বুঝিয়েছেন তা আপনারা বুঝতেই পারছেন৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ চেয়েছিলেন তাঁর মৃতদেহ বাহিত যে শোকমিছিল হবে সেটাও যেন পার্টির পক্ষে, বিপ্লবের পক্ষে কাজ করে, সাধারণ মানুষের মনে দাগ কেটে যায়৷ সেটা ঘটেও ছিল৷ বিপ্লবের সাথে কতটা একাত্ম হয়ে থাকলে এভাবে ভাবা ও বলা সম্ভব!

সেদিন শবদাহের পর কেওড়াতলা থেকে ফিরে এলাম৷ হাতিবাগানে একই সেন্টারে আমি, রণজিৎদা থাকি৷ কেওড়াতলা শ্মশান পর্যন্ত যেন একটা ঘোরের মধ্যে কাজ করছিলাম৷ যদিও সাধ্যমতো সবই করেছি৷ রাতে ফিরে শুয়ে আছি, চোখে ঘুম নেই৷ কমরেড ঘোষকে ঘিরেই তো আমাদের জীবনের সব কিছু৷ সব যেন ওলট–পালট হয়ে গেল৷ হঠাৎ মনে পড়ে গেল কমরেড সুবোধ ব্যানার্জীর স্মরণসভাতে ওনার বক্তব্য৷ তার পিছনেও একটা ঘটনা আছে৷ কমরেড সুবোধ ব্যানার্জী যখন হাসপাতালে তখন পার্টির একটা স্কুল চলছিল৷ আমাদের সম্পাদকমণ্ডলীর মধ্যে একটা মতপার্থক্য হয়, স্কুল বন্ধ করা হবে নাকি চলবে৷ আমি স্কুল করার পক্ষে ছিলাম৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ মিটিংয়ে ঢুকে সব শুনে বললেন, তোমরা যখন লড়াই করবে তখন আমার মৃত্যুর খবর পেলে কি লড়াই থামাবে? এ হয় না৷ উনি যখন পরে সুবোধ ব্যানার্জী স্মরণে ওই স্কুলের ডায়াসেই বক্তৃতা দিচ্ছিলেন– বিপ্লবীরা শোককে কী চোখে দেখে, তখন বুঝলাম আমাদের তিনি প্রস্তুত করছেন তাঁর মৃত্যুজনিত শোককে কীভাবে দেখব সেজন্য৷ সে রাত্রে হঠাৎ সে কথা আমার মনে পড়ে গেল৷ বইটা খুঁজে বের করে আমি উঠে গেলাম রণজিৎদার ঘরে৷ সেই রাতে কারওরই ঘুম নেই৷ রণজিৎদাকে ডেকে আনলাম৷ রণজিৎদা সুবোধ ব্যানার্জীর উপর কমরেড শিবদাস ঘোষের বক্তৃতাটা পড়তে পড়তে কেঁদে ফেললেন৷ আমিও কেঁদে ফেলেছি৷ আমার প্রস্তাব গ্রহণ করে রণজিৎদা বললেন, এটা গণদাবীতে ছাপানো হবে৷ এটা সমস্ত কমরেডদের প্রতিই একটা ঐতিহাসিক বার্তা৷ আজও তা আমাদের গাইড করে চলেছে, আগামী দিনেও করে যাবে৷ কমরেড নীহার মুখার্জী ভাষণের ওই অংশ রেকর্ডে ধরে কমরেডদের দিতে বললেন৷ পরের দিনই বসে কমরেড রণজিৎদা চোখের জলে লিখলেন সেই অসাধারণ লেখা– ‘সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ’৷ গণদাবীতে প্রকাশিত হল৷ এখন ওটা একটা বুকলেট৷ ঠিক জীবনী নয়, তাঁর সংগ্রামের কিছু কিছু অংশ৷ বোঝা যায় রণজিৎদা কীভাবে দেখেছেন কমরেড শিবদাস ঘোষকে পরবর্তী কালে যখনই কমরেড ঘোষের কথা বলতেন, তিনি কেঁদে ফেলতেন৷

কমরেড রণজিৎদার কিছু বিরল গুণাবলি ছিল, যেগুলো কমরেড শিবদাস ঘোষের সংস্পর্শে আরও সমৃদ্ধ ও উন্নত হয়েছে৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছেন, আগে মানবতাবাদী মূল্যবোধ অর্জন কর, তারপর সেই স্তর অতিক্রম করে সর্বহারা সংস্কৃতি অর্জন করবে৷ এই মানবতাবাদী মূল্যবোধও একটা বিরাট উন্নত স্তর, যা নিয়ে সমগ্র নবজাগরণ, স্বদেশি আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল৷ সেই যুগের শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক, যোদ্ধারা সংগ্রাম করেছিলেন৷ এই স্তর অর্জন করে পরের সর্বহারা মূল্যবোধের স্তরে আমাদের যাওয়ার প্রশ্ন৷ আমরা কে কতটা সেই স্তরে যেতে পেরেছি, পারিনি আমি এখন সেই বিচারে যেতে চাই না৷ কার মধ্যে কতটা সর্বহারা সংস্কৃতি জীবন্ত, আবার কতটা মানবতাবাদী চিন্তার প্রভাব রয়েছে সেটাও বিচার্য বিষয়৷ আবার আজকের দিনে মানবতাবাদী মূল্যবোধও রক্ষা করা যায় না সর্বহারা সংস্কৃতির প্রভাব না থাকলে, এ কথাটাও আমি এখানে বলতে চাই৷ মানবতাবাদী মূল্যবোধ যখন নিঃশেষিত হয়ে গেছে তখন কোনও ব্যক্তি তাকে রক্ষা করতে পারে না যদি তার সাথে সর্বহারা সংস্কৃতির প্রভাব যুক্ত না হয়৷ আমাদের অধিকাংশ নেতা, অগ্রণী কর্মীরা এগিয়ে পিছিয়ে এই স্তরেই আছে৷ আবার সর্বহারা সংস্কৃতিরও কেউ কেউ বেশ কিছু দিক অর্জন করতে পেরেছে, কেউ কিছু কিছু অর্জন করেছে, কেউ অর্জন করার সংগ্রাম করছে৷ আবার কারও এক সময়ে অর্জিত উন্নত স্তর চলার পথে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, যেহেতু পুঁজিবাদী সমাজে প্রোলেতারিয়েত এবং বুর্জোয়া চিন্তার বিরামহীন দ্বন্দ্বের মধ্যে আমাদের অবস্থান এবং প্রতি মুহূর্তেই বুর্জোয়া অপসংস্কৃতি আমাদের প্রোলেতারিয়েত বিপ্লবী সত্তাকে ধ্বংস করতে চায়, হত্যা করতে চায়, সংগোপনে আক্রমণ করে, সূক্ষ্মভাবে আক্রমণ করে নানা ভাবে– তাই এখানে সচেতন, সজাগ সক্রিয় সংগ্রাম না থাকলে অর্জিত উন্নত মানও রক্ষা করা যায় না৷ ধীরে ধীরে একটু একটু করে তার ক্ষয় ঘটতে থাকে৷ এগুলি কমরেড ঘোষেরই শিক্ষা৷ সেজন্য সব সময়ই, প্রতি মুহূর্তেই নিজেকে রক্ষার জন্য, এগিয়ে যাওয়ার জন্য সজাগ, সচেতন সংগ্রাম চালাতে হয়৷ আবার এই সংগ্রামে অন্য কমরেডদের সমালোচনা, সহযোগিতাও প্রয়োজন৷ কিন্তু এটা আমি বলতে পারি, রণজিৎদা একটা উন্নত মূল্যবোধের চর্চা সব সময়ই করতেন৷ মূল্যবোধের উপর, নীতিনৈতিকতার উপর খুবই জোর দিতেন৷ যেটা কমরেড শিবদাস ঘোষ বারবার বলে গেছেন৷

কমরেড রণজিৎদা কখনও কারও কাছ থেকে আঘাত পেলেও প্রত্যাঘাত করতেন না৷ এটা খুবই বিরল দৃষ্টান্ত৷ স্বল্প হলেও কিছু কমরেডের মধ্যে এই গুণ আছে৷ প্রত্যাঘাত করার মাননিসকতা তাঁর দেখা যেত না৷ ছোটবেলা থেকেই তাঁর একটা দরদি মন, পরোপকারী মন ছিল৷ পার্টির সংস্পর্শে এসে, কমরেড শিবদাস ঘোষের সংস্পর্শে এসে এই দরদি মনটা, স্নেহসিক্ত মনটা আরও জীবন্ত প্রাণবন্ত হয় এবং আরও উচ্চস্তরে ওঠে৷

গোটা দলের মধ্যেই কমরেড রণজিৎ ধরের একটা বিশেষ স্থান ছিল, কোনও বিশেষ কমিটির বিশেষ নেতা হিসেবে নয়৷ তাঁর সংস্পর্শে এলেই একটা স্নেহের আবেদন সকলেই পেত৷ কারও চোখ মুখ একটু শুকনো, কেউ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, পারিবারিক সমস্যার জন্য হোক, কাজের ব্যর্থতা জনিত কারণে হোক বা কোনও নেতার কোনও রূঢ় আচরণের জন্য হোক– কেউ কষ্ট পেয়েছে আঘাত পেয়েছে– তিনি যদি জানতেন, দেখতেন, শুনতেন, তাঁর কাছে আসুক না আসুক, তিনি এগিয়ে গিয়ে তার দুঃখ–কষ্টকে দূর করার জন্য যথাযথ চেষ্টা করতেন৷ একটা কোমল হৃদয়ের স্পর্শ, অনেকটা মায়ের মতো এই কোমল হৃদয়ের স্পর্শ সকলে অনুভব করতেন৷ তিনি কমরেডদের বন্ধু ছিলেন৷ কমিটির নেতা হওয়া যায়, কিন্তু নেতা হয়ে বন্ধু হওয়া খুব কঠিন কাজ৷ সমস্ত স্তরের নেতা–কর্মীদের তিনি বন্ধুর মতো ছিলেন৷ নির্দ্বিধায় যে কোনও কথা তাঁর কাছে যে কেউ ব্যক্ত করতে পারত৷ তিনি যদি নিজে ভুল করতেন বা তাঁর কোনও আচরণ বা কথা ভুল বলে অপরে ধরিয়ে দিত বা নিজের থেকেই বুঝতে পারতেন, তিনি নিজেই কিন্তু ব্যক্ত করতেন যে আমার এটা ঠিক হয়নি, এটা ভুল হয়েছে৷ কোথাও আমি এই করেছি ওই করেছি, শিবদাস ঘোষ আমাকে দিয়ে লিখিয়েছেন, শিবদাস ঘোষ আমাকে এই চোখে দেখেছেন, এই সব কথা কোনও দিন কেউ শোনেনি৷ আত্মপ্রচার বলতে যা বোঝায়, অহঙ্কার বা অহমিকা, এসব জিনিস আমি বিশেষ খুঁজে পাইনি৷ তাঁর জীবনযাত্রা ছিল অত্যন্ত সহজ, সাধারণ, কষ্টসহিষ্ণু৷ ঝড় বৃষ্টি শীত সবকিছু অগ্রাহ্য করতেন, স্বাস্থ্য চর্চা করতেন৷ যে কোনও কমরেড অসুস্থ হয়েছে বা কমরেডের বাড়ির কেউ অসুস্থ– শুনলে নিজে ছুটে গিয়ে খোঁজ খবর নিতেন৷ কমরেড নীহার মুখার্জী সহ অন্য সব নেতারই অসুস্থতায় তিনি সেবা যত্ন করে গেছেন৷ অফিসে কোনও কমরেড এসেছেন, অপরিচিত, তাঁর সাথে বসে যেতেন, আলোচনা করতেন, গল্প করতেন৷ এই সব কিছু মিলিয়েই কর্মীদের একটা ভালোবাসা মিশ্রিত শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে গিয়েছিলেন স্বকীয় গুণে৷

বহু মিটিংয়ে আমার সাথে ছিলেন৷ খুব কম কথা বলতেন৷ অনেক সময় বলতেনও না৷ আর যেগুলো বলতেন, তার মধ্যে বুদ্ধির ছাপ, চিন্তার ছাপ থাকত৷ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যে কোনও জিনিস বিচার করার, বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা ছিল তাঁর৷ কোনও কমরেড সম্পর্কে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বা কোনও সমস্যা হলে আমি দেখেছি, বহু জায়গায় তাঁর সাথে আমার মতৈক্য হত, আমি যে ভাবে ভেবেছি, উনিও সেইভাবে ভেবেছেন৷ আবার কখনও কখনও মতপার্থক্যও ঘটেছে৷ কখনও উনি ঠিক, কখনও আমি ঠিক, মত বিনিময় হয়েছে৷ কিন্তু চুলচেরা বিশ্লেষণ বলতে যা বোঝায়, কার্যকারণ সম্পর্ক দিয়ে বিচার যাকে বলে, এ তাঁর ছিল৷ দুমদাম কমেন্ট করে দিলাম, যা মনে এল বলে দিলাম, এ সব ছিল না৷ খুব ধীর স্থির শান্ত সংযত চিন্তা এবং আচরণ ছিল৷ একটা গুরুগম্ভীর পরিবেশ, একটা চিন্তাক্লিষ্ট পরিবেশ, উইট–হিউমার করে– হাল্কা ভাবে নয়, সেটাকে খুব সহজ করে দিতেন৷ মঞ্চে রাখা এই হাসিমুখটাই ছিল তাঁর প্রকৃত ছবি, হাস্যোজ্জ্বল ছবি৷ গোটা দলের মধ্যে যে স্থানটা তিনি নিজের গুণে অর্জন করেছিলেন সেটা বিরাট শিক্ষণীয় বিষয়৷ মানুষকে, কমরেডদের তিনি প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন৷ পরিচিত–পরিচিত সব শিশুকেই তিনি সস্নেহে কাছে টেনে নিতেন৷ তাদের সাথে শিশুর মতোই মিশে যেতেন৷ এটাও সবার চোখে আকর্ষণীয় ছিল৷

এখানে আরেকটা কথা আমি বলতে চাই৷ কমরেড শচীন ব্যানার্জীর মৃত্যুর পরে তিনি কয়েক বছর অফিস সম্পাদকের দায়িত্ব খুব নিপুণভাবে পালন করেছিলেন৷ তিনি যে অফিস সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন সেটাও কেউ বুঝত না৷ এর জন্য টেবিল চেয়ার ঘর এগুলির দরকার ছিল না৷ তিনি নিঃশব্দে কাজ করে গেছেন৷ কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হওয়ার আগে আমাদের সিনিয়রদের একটা বৈঠক ছিল৷ কমরেড নীহার মুখার্জী যে নামগুলো প্রস্তাব করেন তাতে কমরেড রণজিৎ ধর, কমরেড মানিক মুখার্জীর নাম ছিল না৷ অন্যেরা বলেন, কেন রণজিৎ ধরের নাম থাকবে না? কমরেড নীহার মুখার্জী বলেন, উনি নিজেই আমাকে বলেছেন যে আমাকে রাখবেন না, আমি শিবদাস ঘোষের বাকি লেখাগুলোর  এডিটিং নিয়ে থাকব, অন্য কোনও দায়িত্বের মধ্যে থাকতে চাই না৷ ফলে ওনার নাম রাখা হয়নি৷ কিন্তু মিটিংয়ে ডাকা হত আমন্ত্রিত সদস্য হিসাবে৷ একদিন তিনিই মিটিংয়ে বললেন, কেন্দ্রীয় কমিটিতে আমার নাম না–রাখাটা খুব ঠিক হয়েছে৷ কারণ আমি দেখেছি, কেন্দ্রীয় কমিটিতে আমার নাম না–রাখার জন্য আমার মনে ক্ষোভ হয়েছে৷ যদিও আগে আমি নীহার মুখার্জীকে বলেছি আমার নাম রাখবেন না৷ তাই উনি রাখেননি৷ আবার না রাখার জন্য আমার মধ্যে দুঃখ হয়েছে, ক্ষোভ হয়েছে৷ এই কারণের জন্যই আমি কেন্দ্রীয় কমিটির যোগ্য নই৷ লক্ষ করুন, এখানে একটা দৃষ্টান্তমূলক চরিত্র পাওয়া যায়৷

তিনি কোনও কাজের দায়িত্বে আছেন, সে জন্য কম্যান্ড করছেন– এই করো ওই করো, এ রকম নয়৷ কাজ করাচ্ছেন, নিজেও করছেন– সবার সাথে মিশে৷ কম্যান্ড করে কাজ করাচ্ছেন, এ সব ছিল না৷ ঘাটশিলায় কমরেড শিবদাস ঘোষের মূর্তি উদ্বোধন হবে৷ তখনও বহু কাজ বাকি, দিন ঘোষণা হয়ে গেছে৷ মাঠে জঙ্গল হয়ে আছে, এখানে–সেখানে উঁচু–নিচু হয়ে আছে৷ জুনিয়র কমরেডরা চেষ্টা করছেন পরিষ্কার করার৷ কমরেড রণজিৎদাও ওই বয়সে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কোদাল হাতে নিয়ে৷ এই সব কাজে তাঁর কোনও দ্বিধা ছিল না৷ 

তাঁর ব্যক্তিগত চাহিদাও বিশেষ ছিল না৷ জামাকাপড় অপরে যা দিত, তাই পরতেন৷ সাদামাটা জীবন ছিল৷ দলের ফান্ড নিজের জন্য খরচ করতে চাইতেন না৷ গুণগ্রাহীরা যা দিত তাতেই চালাতেন, অতিরিক্ত হলে ফান্ডে জমা দিতেন৷ দলের ফান্ডের অপব্যয় একদম সহ্য করতে পারতেন না৷ কারণ তিনি এ ক্ষেত্রে কমরেড শিবদাস ঘোষের জীবনযাত্রা প্রত্যক্ষ করেছেন৷ কমরেড রণজিৎদা পারতপক্ষে কাউকে বলতেন না এক গ্লাস জল দাও, আমার এই গেঞ্জিটা কেচে দাও৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ একটা বক্তৃতায় বলেছিলেন, যতক্ষণ নিজে পারো করবে না কেন? অন্য কমরেডদের ব্যবহার করবে কেন? রণজিৎদার সাথে শেষ জীবনেও সল্টলেক সেন্টারের যে জুনিয়র কমরেডরা থাকত তাদের সাথে কাপড় নিয়ে টানাটানি করেছেন– দেবেন না, নিজে কাচবেন৷ নিজের কাজ নিজে করবেন৷ একজন অভিভাবকের মতো, সকলে খেয়েছে কি না, কে খেয়েছে কে খায়নি, সবসময় খোঁজ নিতেন৷ যে সেন্টারে থাকতেন তাঁদের প্রত্যেকের দুঃখ ব্যথা সমস্যা এটা ওটা সবকিছুর মধ্যে রণজিৎদা ছিলেন৷

ডিএসও–র কাজে তিনি বেশি দিন ছিলেন না৷ ডিএসও–র কাজে আমার সাথে ছিলেন কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তী, কমরেড অসিত ভট্টাচার্য, ভবেশ গাঙ্গুলি, এঁরা৷ পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে যে অনুষ্ঠান হয়, সেখানে সিনিয়রদের বলতে বলা হয়৷ উনি বলবেন না৷ তারপরে ওরা জোর করে ওনাকে বলার জন্য তুলল৷ দাঁডিয়ে উনি ডিএসও গঠনের ক্ষেত্রে আমার কী সংগ্রামী ভূমিকা সেই ইতিহাস বলে গেলেন৷ উনি যে এত লক্ষ করেছেন আমিও জানতাম না৷ অথচ আমার সাথে যে ডিএসও–তে বেশিদিন একত্রে কাজ করেছেন এমন নয়৷ অথচ কোনও নেতা বা কর্মী কোথায় স্ট্রাগল করছে, কীভাবে স্ট্রাগল করছে, তার গুণ কী, খুব খোঁজখবর রাখতেন তিনি৷ আজকে হয়ত কারও উপর রেগে তার ত্রুটি নিয়ে আমার কাছে বলেছেন, যাঁর সম্পর্কে আজকে রাগ, বিরক্তি প্রকাশ করেছেন পরদিন দেখতাম তাঁর কী কী গুণ আছে এসে বলছেন৷

শেষ বয়সে ওনাকে কয়েকটি রাজ্যের দায়িত্ব দেওয়া হল৷ এক্ষেত্রে শোকপ্রস্তাবে একটা স্লিপ হয়ে গেছে, মহারাষ্ট্রেও তিনি দায়িত্বে ছিলেন৷ এই রাজ্যগুলো, যেগুলো শংকর সিংয়ের নেতৃত্বে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সেগুলোতে ওনাকে দায়িত্ব দেওয়া হল৷ তখন অবশ্য তাঁর শরীর ভেঙে গেছে৷ পরিশ্রম করতে পারছিলেন না৷ তবুও অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন এই সব জায়গায় গিয়ে গিয়ে৷ পরে যখন পারছিলেন না, সেখানকার কমরেডরা নোট করেছেন, উনি আমাকে দিয়ে মিটিং করাতেন৷ বলতেন, তুমি বলো৷ আমি বলতাম, আপনি কিছু বলুন৷ তখন ওনার বলার ক্ষমতা অনেক কমে গিয়েছিল৷ বলতেন, না তুমি বললেই হবে৷ আমি আলোচনা করার পর বলতাম, আর কিছু থাকলে আপনি বলুন৷ বলতেন, বলার দরকার নেই, যা বলেছ ঠিকই আছে৷ বিহার, ইউ পি, ঝাড়খণ্ডের কমরেডদের সাথে আমাকে নিয়ে গিয়ে গিয়ে মিটিং করেছেন৷

কমরেড, আজকের এই সভায় প্রায় অনেকেই আছেন যাঁরা পার্টির সাথে নতুন যুক্ত হয়েছেন৷ তাঁরা দেখেননি, কমরেড শিবদাস ঘোষ ২০–২৫ জনকে নিয়ে ক্লাস করছেন৷ তাঁরা দেখেননি, শিবদাস ঘোষ জনসভা করছেন ১০০–১৫০ জন লোক নিয়ে৷ তাঁরা দেখেননি, কলকাতায় এই পার্টির নাম কেউ জানে না, কমরেড শিবদাস ঘোষকে কেউ চেনে না৷ তাঁরা দেখেননি, আমি দেখেছি কমরেড শিবদাস ঘোষকে না খেয়ে থাকতে৷ কমরেড নীহার মুখার্জি চিঁড়ে সংগ্রহ করে এনেছেন৷ চিঁড়ে ভিজিয়ে সেই জল ভাগ করে সকলে খাচ্ছেন৷ আমি দেখেছি, আমার যে স্কুলে আমি মিটিং করতে কমরেড ঘোষকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিলাম ১৯৫২ সালে, তিনি একটু দেরি করে এলেন৷ অথচ উনি কোনও দিন এতটুকু দেরি করতেন না৷ ওই দিন দেরি হয়েছিল তার কারণ, একটা জামা পরে নীহার মুখার্জী বেরিয়ে গেছেন, ফিরতে দেরি হয়েছে তাঁর৷ তিনি ফিরলে তারপরে উনি সেই জামা পরে বেরিয়েছেন৷ আর জামা ছিল না৷

এখনকার কমরেডরা এক কথায় দু–কথায় এগুলো শোনে, কিন্তু পার্টির প্রতি আজ যে সমর্থন, মানুষের এত ভালবাসা, কত কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এসব এসেছে সেই সব বুঝতে পারে না৷ সে সময় অবিভক্ত সিপিআইকে সাপোর্ট করছেন মহান স্ট্যালিন, মহান মাও সে–তুঙ৷ তাদের কর্মীরা আমাদের বলত, শিবদাস ঘোষ কি স্ট্যালিনের চেয়েও বড়, লেনিনের চেয়েও বড়? ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করত৷ সেই যুগে যাঁরা আকৃষ্ট হয়েছিলেন কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে, তাঁদের সেই সংগ্রামটা ছিল অত্যন্ত কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ৷ যারা কেরিয়ার ছেড়ে, ঘর ছেড়ে, সব কিছু ছেড়ে এগিয়ে এসেছিল, তারা আজকের এই পার্টিকে পায়নি৷ কমরেড শিবদাস ঘোষের এত নাম, পার্টির এত নাম, তাঁর ছাত্র হিসেবে আজ আমি জেনারেল সেক্রেটারি, আমারও কিছু পরিচিতি, সেদিন পার্টির এসব ছিল না৷ সে যুগে যাঁরা লড়াই করে গেছেন স্তরে স্তরে, তাঁদের এই সংগ্রামটাও স্মরণীয়৷ যে কথা দিয়ে আমি শুরু করেছিলাম– বার্ধক্যজনিত কারণে বহু কমরেড প্রয়াত হচ্ছেন৷ কেউ ১৯৬০ সালে, কেউ ’৭০ সালে, কেউ ’৮০ সালে, না হয় পরবর্তীকালে যুক্ত হয়ে মারা গেছেন, শত্রুর আক্রমণে–পুলিশের আক্রমণে শহিদ হয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকে এই ঝান্ডা বহন করেছেন৷ যেমন একজন কমরেড, এঁর নাম আপনারা কেউই জানেন না, কমরেড কুশধ্বজ মণ্ডল, পুরুলিয়ায় প্রাইমারি টিচার, সিপিএম মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করিয়েছিল৷ তারপর মামলায় জিতে তিনি বেরিয়ে এসেছেন৷ স্বেচ্ছায় প্রভিডেন্ট ফান্ডের সব টাকা পার্টিকে দিয়েছেন৷ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন৷ যে ঘরে শুয়ে থাকতেন, বিছানার পাশে কমরেড ঘোষের বইগুলি থাকত৷ আত্মীয় বন্ধু–বান্ধব যাঁরা তাঁকে দেখতে আসত তাঁদের এই বই দিতেন৷ যখন কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে, মৃত্যুর দু’দিন আগে, তখনও আঙুল দিয়ে দেখাতেন, এই বইটা দাও৷ এই নামটাই তো অনেকে জানেন না৷ জানার কথাও নয়৷ এরকম কত কমরেডের কত সংগ্রাম, কত অবদান আছে, যাঁরা আজ প্রয়াত৷

বহু কমরেড বহু অবদান রেখে গেছেন কত ভাবে কত দিক থেকে৷ এই স্মরণসভায় বলতে গিয়ে এই কথাগুলো আমার মনে এল৷ এখনকার কমরেডদের সংগ্রাম আরও কঠিন, আমি জানি৷ আমি আগেই বলেছি, সে যুগ আমাদের সাহায্য করেছিল৷ বাংলার ঘরে ঘরে তখন রামমোহন বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র দেশবন্ধু  বিবেকানন্দ সুভাষচন্দ্র৷ আমাদের বলত, এঁরা প্রাতঃস্মরণীয়, প্রাতঃকালে স্মরণ কর৷ আমাদের জীবন এভাবে শুরু হয়েছিল৷ ওদিকে মহান লেনিন–স্ট্যালিনের নাম আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিল৷ আমাদের মাস্টারমশাইরা আমাদের অভিভাবকরা, আমাদের নিরক্ষর মায়েরা, আমার নিজের নিরক্ষর মা, সকলের মায়েরা, চোখের জল ফেলতে ফেলতে ক্ষুদিরামের গানটা গাইতেন৷ আমরা এই আবহে মানুষ হয়েছি৷ আজকের সমাজে অনেক পরিবর্তন হয়েছে৷ আজ সর্বত্র পচা গলা বিষাক্ত পুঁজিবাদী পরিবেশ৷ সমাজ জীবন, পারিবারিক জীবন, ব্যক্তিজীবন একটা গলিত শবদেহের মতো৷ সেই পরিবেশের থেকে আসছে কমরেডরা৷ তাদের সংগ্রামের ক্ষেত্রে আরও বেশি প্রযোজ্য কমরেড শিবদাস ঘোষের বক্তব্য৷ অতি দুঃখে তিনি বলেছেন, আমরা ছিন্নমূল হয়ে গেছি, পূর্বতন যুগের উন্নত সংস্কৃতির মান, নবজাগরণ এবং স্বাধীনতা আন্দোলন, তার সাথে যোগসূত্র স্থাপন কর, তাদের থেকে নাও, তারপর সর্বহারা সংস্কৃতি অর্জনের সংগ্রামে ব্রতী হও৷ মনে রাখবেন, আজকের দিনে নিকৃষ্ট ব্যক্তিবাদের প্রভাবমুক্ত হয়ে কমিউনিস্ট চরিত্র অর্জন আরও কঠিন সংগ্রাম৷ ধর্মীয় নৈতিকতা আছে, তার পরিবর্তে মানবতাবাদী নৈতিকতা গ্রহণ করতে হবে, বুর্জোয়া মানবতাবাদী নৈতিকতা আছে, তার পরিবর্তে সর্বহারা বিপ্লবী নৈতিকতা অর্জন অপেক্ষাকৃত সহজ সংগ্রাম৷ কিন্তু সমাজে এখন কোনও নৈতিকতাই নেই, মূল্যবোধই নেই, এর প্রয়োজনীয়তাবোধও অবলুপ্তপ্রায়৷ এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সর্বহারা বিপ্লবী নৈতিকতা অর্জন খুবই কঠিন সংগ্রাম৷ সেজন্যই কমরেড শিবদাস ঘোষ এই শিক্ষা দিয়ে গেছেন যে, আগে নবজাগরণ ও স্বদেশি আন্দোলনের যুগের আপসহীন ধারার শিক্ষা ও মহান চরিত্রগুলির সাথে যোগসূত্র স্থাপন কর, তাঁদের থেকে শিক্ষা নিয়ে এগোও, তারপর সেই স্তর অতিক্রম করে সর্বহারা বিপ্লবী চরিত্র অর্জনের স্তরে প্রবেশ করবে৷ বড় বড় কথা নয়, বড় চরিত্র অর্জনের সাধনা করতে হবে৷ এই যে স্মরণসভায় আপনারা উপস্থিত হয়েছেন, এর আগেও এসেছেন, এগুলো তো নিছক একটা প্রোগ্রাম নয়, এর থেকে কী নেব, কী গ্রহণ করব, কীভাবে জীবনকে পাল্টাব, এসব চিন্তা যদি না থাকে, তাহলে এই স্মরণসভার কোনও মানে নেই৷ কমরেড রণজিৎদা তো বলেননি, আমাকে স্মরণ করো৷ যাঁরা প্রয়াত তাঁরা কেউ বলেননি আমাকে স্মরণ করো৷ তাঁদের তো পাওয়ার কিছু নেই৷ প্রয়াতদের স্মরণ করে জীবিতরা পায়, যদি তারা নিতে পারে৷ আশা করি আপনারা সেভাবেই নেবেন৷ এ কথা বলেই আজকে আমি এখানে শেষ করলাম৷

কমরেড রণজিৎ ধর লাল সেলাম

সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ লাল সেলাম

 

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা)