এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের আসাম রাজ্য কমিটির প্রবীণ সদস্য, দরং জেলা কমিটির সম্পাদক অধ্যাপক কমরেড ভূপেন্দ্র নাথ কাকতি ২৪ জুলাই মঙ্গলদৈয়ে নিজ বাসভবনে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৯৭৭ সালে মঙ্গলদৈ লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচনের সময় মঙ্গলদৈ কলেজে তাঁর সহকর্মী অধ্যাপক প্রয়াত মিনহার আলি মণ্ডলের সঙ্গে দল ও মার্কসবাদ সম্পর্কে প্রাথমিক আলোচনার পর দলের তদানীন্তন রাজ্য সম্পাদক, বর্তমানে পলিটবুরো সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্যের সাহচর্য ও আলোচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কমরেড কাকতি দলের কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। তারপর তিনি এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী দার্শনিক, এস ইউ সি আই (সি) দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষের বিভিন্ন বই গভীরভাবে অধ্যয়ন করে এই দৃঢ় মতে উপনীত হন যে ভারতবর্ষে শোষিত মানুষের শোষণমুক্তির একমাত্র হাতিয়ার এস ইউ সি আই (সি) দল এবং দলের নির্দেশিত পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এই উপলব্ধির ভিত্তিতে তিনি কালবিলম্ব না করে এস ইউ সি আই (সি) দলের কাজেকর্মে সক্রিয় ভাবে যুক্ত হন ও ছাত্র-যুবকদের দলে যুক্ত করার জন্য প্রচেষ্টা শুরু করেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সাল থেকে আসামে উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী ও বিছিন্নতাবাদী শক্তিগুলোর প্ররোচনায় ছ’বছর ধরে তথাকথিত বিদেশি বিতাড়নের নামে চলা আন্দোলন রাজ্যের আকাশ-বাতাস যখন উত্তাল করে তুলেছিল সে সময়ে আন্দোলন সংক্রান্ত প্রশ্নে দলের সিদ্ধান্তকে তিনি সঠিক বলে বিবেচনা করেন এবং এই আন্দোলন যে রাজ্যের শোষিত-নিপীড়িত মানুষের ঐক্য বিনষ্ট করে শোষক শ্রেণিকে সাহায্য করবে তা উপলব্ধি করেন। তিনি ওই আন্দোলনের সঙ্গে নীতিগতভাবে যুক্ত না হওয়ায় তাঁকে অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছিল। আন্দোলনকারীরা কয়েকবার তাঁকে আক্রমণ ও হত্যার হুমকি দেয়। পাশাপাশি তাঁর ঘরে লুঠতরাজ চালায়। শেষে তিনি ভাড়া ঘরে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। দুর্দান্ত সাহসী, যুক্তিবাদী, মনোবলে বলীয়ান কমরেড কাকতি এত অত্যাচার সহ্য করার পরও মাথা নত করেননি এবং দলের আদর্শের প্রতি বিশ্বাস ছিল অবিচল।
কমরেড কাকতির সংগ্রামী জীবনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে নেতৃত্বের প্রতি তাঁর প্রশ্নাতীত আনুগত্য, যা কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রাণসত্তা। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা অনুযায়ী ব্যক্তিগত জীবনকে বিপ্লবী জীবনের সঙ্গে একাকার করে দিতে পারেননি কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে দলের কাছে কখনও কোনও সাহায্য চাননি, ব্যক্তিগত কারণে দলের কাজকর্ম থেকে দূরে থাকেননি এবং নেতৃত্ব বা জুনিয়র কমরেডদের কঠোর সমালোচনাও যুক্তি সহকারে গ্রহণ করতেন। দলের নেতৃত্বের নির্দেশে যে কোনও কাজ করার ইচ্ছা থাকলেও চাকরির বাধ্যবাধকতা, ঘরোয়া পরিবেশ বা সামাজিক পরিবেশের দোদুল্যমানতার অন্তর্দ্বন্দে্ব ভারাক্রান্ত হতে দেখা গেলেও তাঁকে কখনও হতাশ হতে দেখা যায়নি।
দলের আহ্বানে সরকারের যে কোনও ধরনের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনে তিনি নিজেকে দ্বিধাহীনভাবে যুক্ত করতেন, বিশেষভাবে দলগাঁও পাটকল স্থাপনের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আসাম কলেজ-শিক্ষক সংস্থার কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য থাকাকালীন রাজ্যের শিক্ষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৮৩ সালে আসাম সরকার কলেজ-শিক্ষকদের স্বাধিকার হরণের উদ্দেশ্যে কলেজ-শিক্ষক পদ প্রাদেশিকীকরণের (প্রোভিনশিয়ালাইজেশন) যে অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, তার বিরুদ্ধে কলেজ-শিক্ষকদের সংগঠিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ফলে তখন সরকার এই সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের জনবিরোধী নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি, সর্বনাশা সর্বশিক্ষা অভিযান বা শিক্ষার বেসরকারিকরণ, গেরুয়াকরণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা শিক্ষা বাঁচাও আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। দলের নির্দেশে আসামের বিশিষ্ট শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের সাহায্য-সহযোগিতায় আসামের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে গুয়াহাটির ভরলুমুখে সাধারণ মানুষের আর্থিক অনুদানে মহৎ প্রাণ মহান শিল্পী রূপকোঁওর জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালার যে পূর্ণাবয়ব ব্রোঞ্জের মূর্তি স্থাপিত হয়েছে, সেই কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
১৯৮৮ সালে দলের প্রথম পার্টি কংগ্রেস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত রাজ্য সম্মেলনে তিনি দলের আসাম রাজ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু সেই পদে বহাল ছিলেন। দলের দরং জেলা কমিটির সম্পাদক হিসেবে ৩৩ বছর কার্যনির্বাহ করা কমরেড কাকতির মৃত্যুতে দলের গুরুতর ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি আসামের শিক্ষা আন্দোলনের ক্ষেত্রেও অভাব অনুভূত হচ্ছে। কমরেড কাকতির মৃত্যুতে দল একজন অতি নিষ্ঠাবান নেতাকে হারালো। তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে জেলার কমরেডরা ছাড়াও বহু গুণমুগ্ধ ব্যক্তি তাঁর বাসভবনে উপস্থিত হন এবং শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলের রাজ্য কমিটির সম্পাদক কমরেড চন্দ্রলেখা দাস এবং পলিটবুরো সদস্য কমরেড কান্তিময় দেব গুয়াহাটি থেকে কমরেড কাকতির বাসভবনে উপস্থিত হন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। দুপুর ২টায় তাঁর মরদেহ মঙ্গলদৈস্থিত দলের জেলা কার্যালয়ে নিয়ে আসা হলে প্রিয় কমরেডকে শেষবার প্রত্যক্ষ করতে বহু কমরেড এবং শুভানুধ্যায়ী সেখানে উপস্থিত হন। সেখানে তাঁর মরদেহ রক্তপতাকায় মুড়ে অস্থায়ী মঞ্চে রাখা হয়।
শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠানের পূর্বে উপস্থিত কমরেডরা সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ স্মরণে রচিত সঙ্গীত পরিবেশন করেন। মাল্যদান করেন দলের পলিটবুরো সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্যের পক্ষে কমরেড কান্তিময় দেব, দলের আসাম রাজ্য কমিটির সম্পাদক কমরেড চন্দ্রলেখা দাস প্রমুখ। উপস্থিত রাজ্য এবং জেলা কমিটির সদস্যরা তাঁর মরদেহে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান। আর্ন্তজাতিক সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে তাঁকে শেষবিদায় জানানো হয়।
কমরেড ভূপেন্দ্র নাথ কাকতি লাল সেলাম