এসইউসিআই(কমিউনিস্ট)–এর স্টাফ মেম্বার, কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনের ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড প্রশান্ত ঘটক নানা রোগে দীর্ঘকাল গুরুতর অসুস্থ থাকার পর গত ৩১ জুলাই কলকাতার হাতিবাগান সেন্টারে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷ তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর৷ ওই দিন তাঁর মরদেহ সংরক্ষিত রাখার পর ১ আগস্ট দলের কেন্দ্রীয় অফিসে নিয়ে আসা হয়৷ প্রয়াত প্রিয় সহযোদ্ধাকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য কলকাতা, হুগলি, হাওড়া জেলা থেকে কমরেডরা সমবেত হন৷
মরদেহে প্রথম মাল্যদান করে বৈপ্লবিক শ্রদ্ধা জানান সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ৷ এরপর পলিটবুরো সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্য, কমরেড শঙ্কর সাহা, কমরেড গোপাল কুণ্ডু ও কমরেড সৌমেন বসু শ্রদ্ধা জানান৷ উপস্থিত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা একে একে শ্রদ্ধা জানান৷ অন্যান্য রাজ্য নেতাদের সাথে বিভিন্ন জেলা কমিটি এবং পার্টি ও গণসংগঠনের ইউনিটগুলির পক্ষ থেকেও মাল্যদান করা হয়৷ এরপর মরদেহ প্রয়াত কমরেডের প্রধান রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্র হুগলি জেলার শ্রীরামপুরে জেলা কার্যালয়ের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়৷ কয়েকজন কেন্দ্রীয় কমিটির ও রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সাথে যান৷ শ্রীরামপুর দলীয় কার্যালয়ে জেলার নেতা–কর্মী–সমর্থক মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পর শোক মিছিল সহকারে শ্মশানে গিয়ে প্রয়াত কমরেডের শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়৷
১৯৬০–এর দশকে কমরেড প্রশান্ত ঘটক ছাত্রাবস্থায় এস ইউ সি আই (সি)–র সাথে নিজেকে যুক্ত করেন৷ পিতার চাকরির সূত্রে বিভিন্ন জেলায় ঘুরলেও শেষে হুগলিতেই তাঁর পরিবার স্থায়ী হয়৷ তাঁর পরিবার ছিল সিপিএম দলের সাথে যুক্ত৷ কমরেড প্রশান্ত ঘটকও তাই ছিলেন৷ কিন্তু শ্রীরামপুর কলেজের অধ্যাপক হিসাবে এস ইউ সি আই (সি)–র প্রয়াত নেতা কমরেড সুকোমল দাশগুপ্তের প্রতি ছাত্রদের গভীর শ্রদ্ধা ও আকর্ষণের প্রভাব প্রশান্ত ঘটকের উপরও পড়েছিল৷ ১৯৬১–৬২ সালের ছাত্রসংসদ নির্বাচনে কমরেড দিলীপ ভট্টাচার্যকে সভাপতি করে ডিএসও ছাত্র সংসদ গঠন করে৷ সেইসময় শ্রীরামপুর অঞ্চলে রাজনৈতিক দল হিসাবে কংগ্রেস শক্তিশালী ছিল৷ তবুও শ্রীরামপুর কলেজ সংসদ নির্বাচনে ডিএসও–র কাছে একাধিকবার পরাস্ত হয়ে ক্ষিপ্ত কংগ্রেস কলেজে কমরেড সুকোমল দাশগুপ্তের উপর হামলা করায়৷ কলেজের ছাত্ররা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে ও ধর্মঘট করে৷ এই সব ঘটনা ওই কলেজের ছাত্র প্রশান্ত ঘটকের মনের গভীরে ছাপ ফেলে৷ তদানীন্তন ছাত্র নেতা, বর্তমানে দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ ওই সময় কলেজের সংগঠন দেখাশোনার জন্য যাতায়াত করতেন৷ এই সূত্রেই তাঁর সাথে কমরেড ঘটকের পরিচয় হয়৷ রাজনৈতিক আলোচনা শুরু হয়৷ কিছুদিন আলোচনার পর যে মুহূর্তে কমরেড ঘটক মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের বৈপ্লবিক চিন্তাধারাকে সঠিক বলে উপলব্ধি করলেন, তখনই তিনি অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার, ঘর–বাড়ি সকল কিছু ছেড়ে দলের সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়েন৷ তাঁর হাত দিয়েই হুগলি জেলায় দলের সাংগঠনিক কাজকর্মের সূচনা হয়৷ এজন্য দিন–রাত তিনি পরিশ্রম করেছেন৷ জেলায় কোনও একজন যোগাযোগের সন্ধান পেলে তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়েছেন৷ এই সূত্রে জেলার নানা স্থানে বহু পরিবারের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়, বহু বাড়ির দরজা তাঁর জন্য খুলে যায়৷ বহু ছাত্র–যুব–মহিলা দলে যুক্ত হতে শুরু করেন৷ এখন হুগলি জেলায় যাঁরা দলের কাজ করেন, তাঁদের অধিকাংশকে তিনিই দলে যুক্ত করেছেন৷ জেলার শ্রমিক আন্দোলন, গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি পুলিশি অত্যাচারের শিকার হয়েছেন, কারারুদ্ধও হয়েছেন৷ সিঙ্গুরের চাষি আন্দোলনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন৷
দল তাঁকে যখন যে দায়িত্ব দিয়েছে তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে তা পালন করেছেন৷ বীরভূম, বর্ধমান সহ দক্ষিণ ২৪ পরগণার কুলতলিতে তিনি দলের দ্বারা অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন৷ তত্ত্বগত চর্চা ও জ্ঞান তাঁর ছিল৷ জটিল তত্ত্ব সহজ ভাষায় তিনি আলোচনা করতে পারতেন৷ অত্যন্ত সৎ, নির্ভীক, নিবেদিতপ্রাণ এই কমরেড মহান নেতার শিক্ষা, দলের রুচি–সংস্কৃতি ও আচরণবিধি নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করতেন৷ কোনও নেতার সাথে মতপার্থক্য ঘটলে, তিনি নির্দ্বিধায় তা ব্যক্ত করতে পারতেন৷
শেষ দিকে একের পর এক কঠিন রোগের আক্রমণে তাঁর শরীর ভেঙে যায়৷ যখন আর চলাফেরা করতে পারছেন না, চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁকে কাজ থেকে বিরত থাকতে বললে তখন দুঃখ পেতেন৷ মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে এক কমরেড তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘প্রশান্তদা কেমন আছেন?’ উত্তরে তিনি ক্ষীণ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘‘এভাবে বেঁচে থেকে লাভ কী?’’ অর্থাৎ কাজ না করতে পারলে বাঁচার প্রয়োজন কী? এই জাতের বিপ্লবী নেতা ছিলেন কমরেড প্রশান্ত ঘটক৷ তাঁর স্মরণে কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে সভা ১৪ আগস্ট বিকাল ৪টা৷ হুগলিতে সভা ১৯ আগস্ট৷
কমরেড প্রশান্ত ঘটক লাল সেলাম