কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য স্মরণে কেন্দ্রীয় কমিটির শ্রদ্ধার্ঘ্য

 

৪ জুন হাওড়ার শরৎ সদনে অনুষ্ঠিত স্মরণসভায় এই শ্রদ্ধার্ঘ্যটি পাঠ করেন  সভার সভাপতি কমরেড সৌমেন বসু৷

এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, পুরুলিয়া জেলা কমিটির সম্পাদক এবং বামপন্থী আন্দোলন ও গণআন্দোলনের নেতা প্রয়াত কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্যের বিপ্লবী জীবনসংগ্রামের প্রতি এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর কেন্দ্রীয় কমিটি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছে৷

‘‘উন্নততর সাংস্কৃতিক মান অর্থাৎ সর্বহারা সংসৃক্তিগত মান আয়ত্ত করা ব্যতিরেকে বিপ্লবী তত্ত্ব বিচারের ক্ষমতাকেই সঠিকভাবে অর্জন করা যায় না এবং বিপ্লবী তত্ত্বও সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যায় না৷ এই কারণেই বিপ্লবী রাজনীতিকে কার্যকরীভাবে রূপ দেওয়া মানেই হচ্ছে বাস্তবে জীবনটাকেই পরিবর্তিত করা৷’’ সর্বহারার মহান নেতা এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী চিন্তানায়ক এবং এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষের এই শিক্ষা কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্যের জীবনে মূর্ত হয়ে উঠেছিল৷ তিনি বিপ্লব এবং বিপ্লবী জীবনকেই একমাত্র সাধনা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন৷

কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য ১৯৬৮ সালে ১৭ বছর বয়সে মুর্শিদাবাদ জেলার জিয়াগঞ্জ কলেজে পড়ার সময় ছাত্র সংগঠন এ আই ডি এস ও–র সাথে যুক্ত হন৷ ১৯৭০ সালে তিনি নিজ জন্মস্থান পুরুলিয়া জেলায় ফিরে আসেন এবং রঘুনাথপুর কলেজে ভর্তি হন৷ ওই সময় তিনি প্রয়াত কমরেড নির্মল মণ্ডলের সাথে যোগাযোগের মারফৎ দলের পলিটব্যুরো সদস্য প্রয়াত কমরেড প্রীতীশ চন্দের সান্নিধ্যে আসেন এবং তাঁরই মাধ্যমে সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তা ও জীবন দর্শনের সংস্পর্শ লাভ করেন এবং একজন বিপ্লবী হিসাবে নিজেকে গড়ে তোলার সংগ্রাম শুরু করেন ৷

কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্যের সংগ্রাম ছিল অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া পুরুলিয়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের অতি সাধারণ এক নারীর কমিউনিস্ট বিপ্লবী হওয়ার জীবন্ত সাধনা৷ তিনি স্কুল–কলেজে শিক্ষা নিয়েছিলেন, কিন্তু গরিব মানুষের প্রতি অফুরন্ত ভালবাসা তাঁকে শুধু স্কুল–কলেজের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে পারেনি৷ পুরুলিয়া জেলার গরিব মানুষ অধ্যুষিত গ্রামগুলিই  তাঁর কাছে ছিল প্রবল আকর্ষণস্থল৷ ১৯৭০–’৭২ সাল পর্যন্ত রঘুনাথপুর কলেজে পাঠরত থাকাকালীন একদিকে জেলার ছাত্র আন্দোলন সক্রিয়ভাবে গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করেন, পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া পুরুলিয়া জেলার গরিব মানুষের আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করেন৷ তিনি এ আই ডি এস ও–র পুরুলিয়া জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন এবং রঘুনাথপুর কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচিত সদস্য হিসাবে পত্রিকা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন৷ কলেজে পাঠরত অবস্থায় পুরুলিয়া জেলায় কাশীপুর থানার পার্টি সংগঠনের কাজেও আত্মনিয়োগ করেন৷ পড়াশুনা অসম্পূর্ণ রেখে তিনি কাশীপুর থানার গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন, তাঁদের মাঝেই দিন কাটাতেন৷ এ ভাবেই তিনি গরিব মানুষের পরিবারগুলির অত্যন্ত প্রিয় ‘ছোড়দি’ হিসাবে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন৷ ১৯৭৮ সালে তিনি কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনের জেলা কমিটির সদস্য হন৷

কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য ছিলেন অত্যন্ত সহজ, সরল, প্রাণবন্ত, সাহসী, দৃঢ়চেতা, উদার মনের, উচ্চ–সংস্কৃতিসম্পন্ন ও কোমল হৃদয়ের৷তথাকথিত এবং প্রচলিত নারীসুলভ মন তাঁর ছিল না৷দলমত নির্বিশেষে খুব সহজে তিনি যে কোনও মানুষের সাথে অত্যন্ত সাবলীলভাবে সম্পর্ক স্থাপন করতে এবং মন জয় করে নিতে পারতেন৷ ছোটদের প্রতি ছিল তাঁর অপার স্নেহ এবং তিনি ছিলেন যথার্থ মাতৃসম, বয়স্ক্দের প্রতি ছিলেন গভীর শ্রদ্ধাশীল৷ পার্টি সংগঠন ও গণআন্দোলন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে জননেত্রী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষানুযায়ী পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি কমিউনিস্ট বিপ্লবীর ধারণা অনুযায়ী চলার চেষ্টা করেছেন এবং তাঁর কাছে পারিবারিক সম্পর্কের বাঁধন ছিল পার্টি আদর্শকেন্দ্রিক৷ কেউ বলুক না বলুক, পরিচিত হোক বা অপরিচিত এলাকা হোক, কোনও নির্দেশের অপেক্ষা না করে তিনি আপন উদ্যোগে সাধারণ মানুষের যে কোনও সমস্যা নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন৷ অত্যন্ত বিরুদ্ধ পরিবেশেও তিনি কাজ করতে পারতেন৷ অভাব, অনটনের কষ্টকর দিনগুলিতেও হাসি মুখে আনন্দের সাথে পার্টির কর্মকাণ্ডে তিনি মগ্ন থেকেছেন, এর প্রভাব তাঁর পার্টির কাজে কখনও ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারেনি৷ যে কোনও স্তরের পার্টি নেতা সম্পর্কে হোক বা কোনও কর্মী সম্পর্কেই হোক কোনও সমালোচনা বা কোনও বক্তব্য থাকলে তিনি সরাসরি সাবলীলভাবে বলতে পারতেন৷ আবার তিনি কোনও ভাবে সমালোচিত হলে সহজভাবেই নিতে পারতেন৷ ছোট হোক বড় হোক কেউ ভুল ধরিয়ে দিলে এবং তা বুঝতে পারলে, সেই ভুল থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতেন৷ তাঁর প্রতি কোনও অবিচার হলেও কারও প্রতি কোনও বিরূপ মন নিয়ে চলতেন না, তাঁদের সাথেও সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে পারতেন৷ তিনি দলের রাজনীতি সহজভাবে মানুষের কাছে রাখতে পারতেন এবং দলের রাজনীতির দক্ষ প্রচারক ছিলেন৷

তিনি পুরুলিয়া জেলা খরা প্রতিরোধ আন্দোলন, নারী নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন, মদ বিরোধী আন্দোলন, বাসভাড়া বৃদ্ধি প্রতিরোধ আন্দোলন ও স্থানীয় নানা সমস্যা নিয়ে আন্দোলন অসুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্ত নিরলসভাবে চালিয়ে গিয়েছেন৷ তিনি গণআন্দোলন বিশেষ করে নারী নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে বহুবার পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ও কারাবরণ করেছেন৷

কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য ১৯৯০ সালে মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠনের রাজ্য কমিটির সদস্য এবং রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন৷পরবর্তীকালে এ আই এম এস এস–এর সর্বভারতীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন৷১৯৮৭ সালে পুরুলিয়া জেলা প্রথম পার্টি সম্মেলনে জেলা কমিটির সদস্য হন৷২০০৬ সালে তিনি পুরুলিয়া জেলা কমিটির সম্পাদক হন৷২০০৯ সালে পার্টির দ্বিতীয় রাজ্য সম্মেলনে রাজ্য কমিটির সদস্য হন৷ ২০০৯ সালে পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে স্টাফ সদস্য নির্বাচিত হন৷২০১৮ সালে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন৷

২০১৬ সালের জুন মাসে অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসার জন্য তিনি ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালে ভর্তি হন৷লিভারের কিছু সমস্যাজনিত কারণে ১০ আগস্ট দিল্লির লিভার ইনস্টিটিউটে চিকিৎসার জন্য তাঁকে পাঠানো হয়, সেখানে ক্যান্সার ধরা পড়ে৷ তিনি অসুস্থ অবস্থাতেও বিছানায় শুয়ে অসহ্য যন্ত্রণা নীরবে সহ্য করে দলের কাজ চালিয়ে গেছেন৷অসুস্থতাকে তিনি তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে কোনও প্রতিবন্ধক হতে দেননি৷ দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক রোগ ভোগের পর ২৩ মে সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷তাঁর মৃত্যুতে দল হারাল এক বিরল চরিত্রের আমৃত্যু বিপ্লবীকে৷

কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য লাল সেলাম

(৭০ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা ১৫জুন, ২০১৮)