এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর কেন্দ্রীয় কমিটি ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং পুরুলিয়া জেলা কমিটির সম্পাদক কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য দীর্ঘ ২ বছর দুরারোগ্য ক্যান্সারের কঠিন যন্ত্রণাদায়ক জীবন অতিবাহিত করার পর ২৩ মে সকালে ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷ দলের কেন্দ্রীয় অফিসে রক্তপতাকা অর্ধনমিত করা হয়৷
ওইদিন দুপুরে তাঁর মরদেহ লেনিন সরণিতে কেন্দ্রীয় দপ্তরে আনা হয়৷ দুই শতেরও বেশি নেতা–কর্মী–সমর্থক তখন সমবেত হয়েছেন বিদায় শ্রদ্ধা জানাবার জন্য৷ প্রিয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ সর্বপ্রথম মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান৷ পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড রণজিৎ ধর, কমরেড অসিত ভট্টাচার্য, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড ছায়া মুখার্জী, কমরেড সৌমেন বসু মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান৷ গণসংগঠনগুলির সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দ মাল্যদান করেন৷ বিভিন্ন পার্টি ইউনিট ও গণসংগঠনের ইউনিটের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়৷ সিপিআই (এম)–এর পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড বিমান বসু ও পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক কমরেড প্রদীপ রায় মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান৷ ওই দিন রাতে মরদেহ সংরক্ষণ করে ২৪ মে ভোরে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর ৭ জন সদস্যের নেতৃত্বে মরদেহ নিয়ে পুরুলিয়া যাত্রা করা হয়৷ যাত্রাপথে মেছেদায় পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পার্টি, মেদিনীপুর শহরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পার্টি এবং বাঁকুড়া শহরে বাঁকুড়া জেলা পার্টির পক্ষ থেকে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানানো হয়৷ এরপর কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্যের প্রধান কর্মক্ষেত্র পুরুলিয়া জেলায় পৌঁছানো হয়৷ সেখানে তখন শত শত কর্মী ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতি৷
১৯৬৮ সালে ১৭ বছর বয়সে মুর্শিদাবাদ জেলার জিয়াগঞ্জে নিজের দিদির বাড়িতে থাকাকালীন জিয়াগঞ্জ কলেজের ছাত্রী হিসাবে কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য ছাত্র সংগঠন এ আই ডি এস ও–র সাথে যুক্ত হন৷ তাঁর দাদা কমরেড প্রভঞ্জন ভট্টাচার্য তখন পুরুলিয়া জেলায় দলের নেতৃস্থানীয় কর্মী, যাঁর প্রভাব তাঁর পরিবারে যথেষ্ট পড়েছিল৷ ১৯৭০ সালে কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য পুরুলিয়া আসেন, রঘুনাথপুর কলেজে ভর্তি হন৷ ওই সময়ে তিনি পলিটব্যুরোর প্রয়াত সদস্য কমরেড প্রীতীশ চন্দের সান্নিধ্য পান৷ রঘুনাথপুর কলেজে এ আই ডি এস ও–র দায়িত্বপালনের সূত্রে তিনি ছাত্র সংগঠনের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন৷ কে কে এম এস, এম এস এস প্রভৃতি গণসংগঠনেরও তিনি দায়িত্বশীল পদে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন৷ ১৯৮৭ সালে পুরুলিয়া জেলা প্রথম পার্টি সম্মেলনে পুরুলিয়া জেলা কমিটির সদস্য, ২০০৬ সালে জেলা সম্পাদক হন৷ ২০০৯ সালে দলের রাজ্য কমিটির সদস্য হন৷ ২০০৯ সালে দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটি তাঁকে স্টাফ সদস্যপদ প্রদান করে৷ ২০১৮ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ পান৷ তিনি রাজ্য কমিটির তরফে বাঁকুড়া জেলার ভারপ্রাপ্ত ছিলেন৷
পুরুলিয়া জেলার গরিব–মধ্যবিত্ত–নিম্নবিত্ত জনগণের বহুবিধ সমস্যা ও দাবি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে জননেত্রী হিসাবে তিনি সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান পেয়েছিলেন৷ খরা প্রতিরোধ আন্দোলন ও মদ বিরোধী আন্দোলন তাঁকে গরিব মানুষের প্রিয় নেত্রীর মর্যাদা দিয়েছিল৷ আন্দোলন করতে গিয়ে তাঁকে বহুবার গ্রেপ্তার হতে হয়৷ মার্কসবাদ–লেনিনব ঘোষের বৈপ্লবিক চিন্তাধারার প্রতি আবেগময় আনুগত্য তাঁর চরিত্রে উন্নত নৈতিকতা ও সাংস্কৃতিক মানের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিল৷ যাঁরা কাছ থেকে তাঁকে দেখেছেন, তাঁর দরদি মনের স্পর্শ পেয়েছেন, তাঁরাই তাঁর অপার স্নেহশীল মন ও চরিত্র–মাধুর্যের গভীরতা বুঝতে পেরেছেন৷ দলের কর্মীরা যথার্থই তাঁর কাছে ছিলেন সন্তানের মতো৷ কত কর্মীর কত দুঃখ ও মলিনতা তাঁর স্নেহময় পরিচর্যায় দূর হয়েছে৷ তাই ২৪ মে পুরুলিয়ায় উপস্থিত কর্মীদের চোখের জল যেন বাধা মানছিল না৷
২০১৬ সালে ক্রমাগত পেটের ব্যথার চিকিৎসার জন্য কলকাতায় হার্ট ক্লিনিক হাসপাতালে ভর্তি হন৷ লিভারের অসুখ ধরা পড়ে৷ দিল্লির লিভার ইনস্টিটিউটে বিশেষজ্ঞ ডাঃ সারিনের কাছে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়৷ সেখানেই ধরা পড়ে দুরারোগ্য ক্যান্সার, যা ততদিনে শরীরের ভিতরের অনেক জায়গায় ছড়িয়ে গেছে৷ এই সংবাদ যেন বজ্রপাতের মতো দলের নেতা–কর্মীদের স্তম্ভিত ও বাকরুদ্ধ করে দেয়৷ চেষ্টা শুরু হয় নিদারুণ যন্ত্রণা থেকে স্বস্তি দেওয়ার৷ সাময়িক কিছু স্বস্তি পেলেও যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি পাননি৷ তার মধ্যেও তাঁর হাসিমুখ কখনও অন্যরকম হয়নি৷ তাঁর প্রিয় কর্মীরা যখন মৃত্যু অবধারিত জেনে শোকে দুঃখে ভেঙে পড়েছে, তাঁদের সাত্ব্ন্না ও সাহস দিয়েছেন তিনিই৷ এমন একজন মূল্যবান নেতার মৃত্যুতে দলের ক্ষতি তো যথেষ্ট হলই, পাশাপাশি মেহনতি মানুষের আন্দোলনও বিরাট ক্ষতিগ্রস্ত হল৷
কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য লাল সেলাম
শেষযাত্রা
২৪ মে, পুরুলিয়ার তীব্র দাবদাহের মধ্যে শত শত মানুষ অপেক্ষা করছেন নীলকুঠি ডাঙার এস ইউ সি আই (সি) অফিসের সামনে৷ তাঁদের প্রিয় নেত্রী প্রণতি ভট্টাচার্যকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে জেলার দূর–দূরান্ত থেকে এসে সমবেত হয়েছেন তাঁরা৷ পাশ্ববর্তী ঝাড়খণ্ড রাজ্য থেকেও এসেছেন দলের বহু কর্মী–সমর্থক৷ সময় যত গড়াচ্ছে বাড়ছে ভিড়৷ বেলা ১টার কিছু পরেই খবর এল শবদেহ নিয়ে গাড়ি কলকাতা থেকে রওনা হয়ে মেচেদা, মেদিনীপুর শহর, বাঁকুড়ার পার্টি অফিস ঘুরে প্রায় পুরুলিয়ার কাছাকাছি৷ মুহূর্তেই ভিড় পরিণত হল সুশৃঙ্খল লাইনে৷ অসংখ্য চোখে জল তখনই বাধা মানছে না, কণ্ঠ অশ্রুরুদ্ধ, তবু কণ্ঠে উঠল স্লোগান– আমৃত্যু বিপ্লবী কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য লাল সেলাম৷ দলের রাজ্য নেতাদের তত্ত্বাবধানে শবদেহ এসে পৌঁছলো কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্যের বহু স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নীলকুঠি ডাঙার অফিসে৷
এই অফিসে বসেই কত দিন কত কমরেডের সাথে তিনি আলোচনা করেছেন নানা বিষয় নিয়ে৷ তুলে ধরেছেন সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার উপলব্ধিকে৷ তাঁর কাছে অক্লেশে পৌঁছে যেতেন যে কোনও মানুষ৷ কত সাধারণ মানুষ আসতেন তাঁদের সুখ–দুঃখের অভিজ্ঞতা তাঁদের প্রিয় প্রণতিদির কাছে বলে একটু হালকা হতে৷ সেই অফিসের বড় ঘরে মহান মার্কসবাদী নেতাদের ছবির নিচে শায়িত হল কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্যের দেহ৷ রক্তপতাকা হাতে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে কমসোমল বাহিনীর সদস্যরা৷
বাইরে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন কত মানুষ৷ পুরুলিয়ার কাটিং পাড়ার মহিলারা তাঁদের মদভাটি উচ্ছেদের সাহসী লড়াইয়ে পাশে পেয়েছিলেন প্রণতি ভট্টাচার্যকে, অঝোরে কাঁদছেন তাঁরা৷ প্রণতি ভট্টাচার্য কে হতেন আপনাদের? প্রশ্ন শুনেই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলেন জনতুন্নেসা বিবি৷ প্রণতি ভট্টাচার্য যে তাঁদের যথার্থ আপনজন অতীতে এমন শোকের দিনে যে প্রিয় কমরেডটি পুরুলিয়ার কর্মী–সমর্থকদের শিখিয়েছিলেন শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় শোককে কেমন করে দেখতে হয় সে কথা আজ এমন এক কঠিন দিনে তাঁরা তাই চেষ্টা করছেন সেই শিক্ষাকে স্মরণ করতে৷ শোকে উদ্বেল তাঁরা, তবু সজাগ শৃঙ্খলা যেন অটুট থাকে৷ একে অপরের খোঁজ নিচ্ছেন, প্রখর রোদে কেউ অসুস্থ হল কি না বারবার দেখছেন৷ ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে রিক্সা শ্রমিক, আদিবাসী শ্রমজীবী মহিলা, কৃষক, খেতমজুর, মুটে মজদুর, হকার, বন্ধ কারখানার শ্রমিক থেকে শুরু করে শিক্ষক–অধ্যাপক–ডাক্তার-উকিল সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ৷ ছাত্র–যুবকদের সাথে আছেন শিশু কোলে মা, এমনকী গুরুতর অসুস্থ এক মহিলা ছুটে এসেছেন সুদূর বান্দোয়ান থেকে৷ আছেন কত বৃদ্ধ–বৃদ্ধা৷ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের বেশ কিছু সাধারণ সমর্থকও এসেছেন শ্রদ্ধা জানাতে৷
প্রথমেই মাল্যদান করলেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড গোপাল কুণ্ডু৷ এক এক করে মালা দিলেন দলের রাজ্য নেতৃবৃন্দ যাঁরা সঙ্গে বহন করে নিয়ে এসেছেন প্রিয় কমরেডের মরদেহ৷ দলের বিহার রাজ্য কমিটির সম্পাদক কমরেড অরুণ কুমার সিং, ঝাড়খণ্ড রাজ্য সম্পাদক কমরেড রবীন সমাজপতি শ্রদ্ধা জানালেন৷ সিপিআই(এম) নেতা ও প্রাক্তন এমএলএ কমরেড নিখিল মুখার্জী, প্রাক্তন সাংসদ ও ফরোয়ার্ড ব্লকের পুরুলিয়া জেলা নেতা কমরেড নরহরি মাহাতো, আরএসপি জেলা সম্পাদক কমরেড অত্রী চৌধুরী, পিডিএসের জেলা সম্পাদক কমরেড নটবর বাগদি, পুরুলিয়া মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান, লোকসেবক সংঘের সভাপতি সুশীল মাহাতো প্রমুখ মাল্যদান করলেন৷ সাধারণ মানুষ, কর্মী–সমর্থকরাও একে একে শ্রদ্ধা জানালেন৷
মাল্যদান করলেন দলের রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড তরুণ মণ্ডল, যাঁর অপরিসীম যত্নে সংগঠিত হয়েছে কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্যের চিকিৎসা পর্ব৷ দীর্ঘ আড়াই ঘন্টা কেটে গেছে, কিন্তু তখনও কয়েকশো মানুষ ফুল হাতে দাঁড়িয়ে৷ কিন্তু উপায় নেই, শেষযাত্রা শুরু করতে হবে৷ সঙ্গীত গোষ্ঠী শুরু করলেন কমরেড শিবদাস ঘোষের উপর রচিত গান এবং আন্তর্জাতিক সঙ্গীত৷ শোকস্তব্ধ শতশত মানুষ গলা মেলালেন তাতে৷ অশ্রুসজল চোখে দৃঢ় কণ্ঠে উত্থিত স্লোগানের মধ্য দিয়ে শববাহী গাড়িতে কমরেডরা তুলে দিলেন মরদেহ৷ শুরু হল মিছিল৷
সহস্রাধিক মানুষের মিছিল দলীয় কার্যালয় থেকে হাটের মোড়, পোস্ট অফিস মোড়, অলঙ্গী ডাঙা হয়ে বোঙ্গাবাড়ির শ্মশানের ৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার মধ্যে অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন৷ মিছিল আকারে ক্রমাগত বেড়েছে৷ দেখা গেল হাঁটছেন অন্য দলের কিছু সাধারণ কর্মীও৷
শ্মশানে বিদায় জানাতে হবে নেত্রীকে, মন ভারাক্রান্ত, গভীর যন্ত্রণায় কর্মী–সমর্থকরা হাহাকার করছেন৷ তার মধ্যেও মুষ্টিবদ্ধ হাতে লাল সেলাম জানাতে জানাতে একের পর এক কমরেড শপথ করছেন অতীতের ভুল–ত্রুটি শুধরে নতুন উদ্যমে বিপ্লবী সংগ্রামে সামিল হওয়ার৷ আগুনের লেলিহান শিখা যখন প্রিয় মানুষটিকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে, চোয়াল শক্ত করে কান্না উদগত কান্নার দমক চেপে রেখে একদল যুবক একদৃষ্টে তাকিয়ে সেই দিকে৷ অস্ফূটে বলছে এক কিশোর– তুমি যা চেয়েছিলে তেমনই হবার চেষ্টা করব আপ্রাণ, কথা দিলাম৷ শেষ যাত্রার মূল সুর ধ্বনিত হয়ে গেল এই ক’টি কথাতেই৷
(৭০ বর্ষ ৪১ সংখ্যা ১জুন, ২০১৮)