কমরেড নুরসেদ আলীর জীবনাবসান

এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও অফিস সম্পাদক কমরেড নুরসেদ আলী করোনা পরবর্তী নানা শারীরিক জটিলতার কারণে ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালে ১৯ মে বিকালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর।

তাঁর মৃত্যুসংবাদ পৌঁছতেই গোটা মুর্শিদাবাদ জেলায় গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। ২০ মে কলকাতাতেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। ওই দিন কমরেড আলীর মরদেহে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃবৃন্দ। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পূর্বতন মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক কমরেড স্বপন ঘোষাল এবং বর্তমান জেলা সম্পাদক ও রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড সাধন রায়ের পক্ষেও মাল্যদান করা হয়। প্রয়াত কমরেডের ঘনিষ্ঠ কমরেডরা সহ দলের গীতাঞ্জলি প্রিন্টিং প্রেস ও জেলা পার্টি অফিসের পক্ষে মাল্যদান করা হয়। এছাড়াও চিকিৎসক, নার্স এবং দলের অন্যান্য নেতা-কর্মীরা মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

ভগবানগোলা ব্লকের জালি বাগিচা গ্রামের প্রান্তিক কৃষক পরিবারের সন্তান কমরেড নুরসেদ আলী ছাত্র জীবনের প্রথম দিকে সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআই-এর সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে মুর্শিদাবাদ জেলা জুড়ে এস ইউ সি আই (সি)-র উপর সিপিএমের আক্রমণের ঘটনায় তাঁর মনে বিভিন্ন প্রশ্ন জাগে। এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তিনি এআইডিএসও এবং পার্টির নেতাদের কাছে ছুটে যান। মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এস ইউ সি আই (সি) দলের উন্নত রুচি-সংস্কৃতির মান তাঁকে আকৃষ্ট করে। তিনি দলের কাজ শুরু করেন। এই সময় জেলার শ্রীপৎ সিং কলেজে ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে ১৯৭৮ সালে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের প্রাথমিকে ইংরেজি ও পাশফেল তুলে দেওয়ার প্রতিবাদ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সেই সময়ই জেলায় বন্যার্ত মানুষের জন্য ত্রাণকার্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন তিনি।

১৯৮৫ সালে দলের প্রয়োজনে গ্রাম থেকে বহরমপুর শহরে জেলা অফিসে আসেন এবং সেই থেকেই কমরেড আলী জেলা প্রেসের কাজ দেখাশোনা শুরু করেন। বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ক্রমাগত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ কাজে দক্ষ হয়ে ওঠেন। সে সময় দলের আর্থিক সঙ্গতি ছিল খুবই সামান্য। ফলে প্রেস এবং অফিসের কর্মীদের নানা সমস্যায় পড়তে হত। তার মধ্যেও মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের যে আদর্শ মনুষ্যত্বের প্রদীপ জ্বালায়, চরিত্রকে বিকশিত করে, সেই সংগ্রামী ধারায় নিজেকে বিকশিত করে গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু করেন। যৌথ জীবন পরিচালনার সংগ্রামেই পরিবারের সদস্যদেরও তিনি দলের সাথে যুক্ত করেছেন। তাঁর পরিবারের সকলেই দলের কর্মী। ‘দলই জীবন’ এই লক্ষ্যে তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন।

১৯৮৮ সালে প্রথম পার্টি কংগ্রেসে তিনি প্রতিনিধি হিসাবে অংশ নেন। দলের পলিটবুরো সদস্য কমরেড মানিক মুখার্জী, পূর্বতন জেলা সম্পাদক প্রয়াত নেতা কমরেড প্রাণগৌর বসাক সহ নেতৃবৃন্দের সাহচর্য তাঁর বিকাশে সাহায্য করেছিল। নিজেকে ত্রুটিমুক্ত করা ও ক্রমাগত বিকশিত হওয়ার জন্য দলের আভ্যন্তরীণ সংগ্রামকে তিনি আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন। দলের দেওয়া জেলা অফিসের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব শুধু নয়, তাঁকে দল যখন যে দায়িত্ব দিয়েছে তা হাসিমুখে হৃদয় দিয়ে পালন করেছেন। প্রেস এবং অফিসের নীরস আপাত কঠিন নিরানন্দময় কাজের মধ্যেও বিপ্লবী জীবনের আনন্দ তাঁর চোখেমুখে ফুটে উঠত। তাঁর এই ভূমিকা এবং নিরলস সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি জেলা অফিসের ঘর থেকেই গোটা জেলার কমরেডদের অন্তঃস্থলে স্থান করে নিয়েছেন।

২০০৯ সালে জেলা সম্মেলনে তিনি দলের জেলা কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন। ২০১৮ সালে তিনি দলের জেলা অফিস সম্পাদক নির্বাচিত হন। অফিসের কাজ পরিচালনা করার পাশাপাশি তিনি জেলার আরও বহু সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করতেন।

জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গণসংগঠন বা দলের নেতা-কর্মীরা জেলা অফিসে এলে তাদের বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজখবর নিতেন, কখনও সমালোচনাও করতেন। আবার ভালবেসে কাছে টেনে নিতেন। জুনিয়ার কমরেডদের গুণাবলিকে শ্রদ্ধাও করতেন প্রবল। এ সব কিছুর মধ্য দিয়ে তিনি আক্ষরিক অর্থেই গোটা জেলার অনেকেরই অভিভাবকে পরিণত হন। তাঁর প্রয়াণে মুর্শিদাবাদ জেলার গরিব খেটে খাওয়া মানুষ তাদের এক বিশিষ্ট সংগ্রামী আপনজনকে হারাল এবং দল হারাল একজন দক্ষ সংগঠক ও নেতাকে।

কমরেড নুরসেদ আলী লাল সেলাম

গণদাবী ৭৩ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা