এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর রাজ্য কমিটির পূর্বতন সদস্য ও জলপাইগুড়ি জেলা কমিটির প্রথম সম্পাদক কমরেড দিলীপ ভট্টাচার্য দুরারোগ্য লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৩ জুলাই জলপাইগুড়ি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। গত দু-বছর তিনি নানা রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন। তাঁর মৃত্যুসংবাদে দলীয় কর্মী সহ সাধারণ মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। পরদিন বিকেলে তাঁর মরদেহ জেলা কার্যালয়ে আনা হলে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ও দার্জিলিং জেলার নেতৃবৃন্দ ও কর্মী সমর্থকেরা, বহু শুভানুধ্যায়ী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান।
জলপাইগুড়ি জেলা সহ উত্তরবঙ্গে পার্টি সংগঠন গড়ে তোলার সূচনায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান কর্মী সমর্থক দরদিদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছেন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র দিলীপ ভট্টাচার্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতায় এসে তালতলা হাইস্কুল থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে জলপাইগুড়ি গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। পারিবারিক সূত্রে অরুণ ভট্টাচার্যের মাধ্যমে কমরেড সুধীর পালের সাথে যোগাযোগ ঘটে এবং কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসেন। ১৯৬৭ সালে এ আই ডি এস ও-র বিশিষ্ট সংগঠক কমরেড সলিল চক্রবর্তী জলপাইগুড়িতে এলে কমরেড দিলীপ ভট্টাচার্য ও তার সহপাঠী এবং বন্ধুদের নিয়ে একটি আলোচনা সভায় মিলিত হন। সেখান থেকেই তিনি দলীয় কাজে আত্মনিয়োগ শুরু করেন। পার্টির আহ্বানে সংগঠনের প্রয়োজনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে দিয়ে আনন্দচন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৮ সালে কমরেড জয়দেব মণ্ডল ওই কলেজে অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন। ওই বছরেই ভয়ঙ্কর বন্যায় জলপাইগুড়ি শহর তছনছ হয়ে যায়। বন্যা পরবর্তী সময়ে দিলীপ ভট্টাচার্যের উদ্যোগে রিলিফ ওয়ার্ক, টে’ট বুক লাইব্রেরি গড়ে তোলা হয়। কাদোবাড়ি ও বোয়ালমারিতে সাংগঠনিক কাজ শুরু হয়। সেই সময় জলপাইগুড়িতে তিনি একমাত্র সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য কষ্টকর জীবন সানন্দে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি যে কাজই করুন তা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সুনিপুণভাবে গুছিয়ে করতে পারতেন। তিনি নির্ভীক ভাবে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কার্যকরী করার ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। অনন্যসাধারণ চরিত্রের গুণে বহু মানুষকে তিনি আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন। ধীরে ধীরে জলপাইগুড়ি সদর ও রাজগঞ্জ ব্লকে সংগঠন গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে ধূপগুড়ি, ফালাকাটা, ময়নাগুড়িতে সংগঠন বিস্তার লাভ করে।
মোহিত নগরে সরকারি কৃষি খামারে তিনি শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তুলে তাদের বহু দাবি আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রয়াত কমরেড উৎপল রায়ের উদ্যোগে রামঝোরা চা-বাগানে পার্টি ইউনিট ও ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। এ আই ইউ টি ইউ সি অনুমোদিত নর্থ বেঙ্গল টি প্ল্যান্টেশন এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন গড়ে ওঠার পর কমরেড দিলীপ ভট্টাচার্য উক্ত বাগানে সাংগঠনিক কাজ দেখাশোনা করার জন্য নিয়মিত যেতেন। ওই বাগানের প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়নের নেতারা মালিক পক্ষের সহায়তায় বোনাস দেওয়ার সময় অফিস থেকে ইউনিয়নের চাঁদা কেটে রেখে শ্রমিকদের বোনাস দিতেন। তার বিরুদ্ধে শ্রমিকরা আন্দোলন গড়ে তুললে সেই আন্দোলন ধ্বংস করতে ওই ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কমরেড দিলীপ ভট্টাচার্যের উপর নৃশংস আক্রমণ চালায়। মরণাপন্ন অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মাথায় আটটা সেলাই পড়ে সে যাত্রায় কোনওক্রমে তিনি বেঁচে যান। জরুরি অবস্থার সময় যখন সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায় তখন কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার আলোকে জলপাইগুড়ি জেলায় শরৎ জন্মশতবার্ষিকী কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটির সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক জয়দেব মণ্ডল। এই কমিটির উদ্যোগে জেলা জুড়ে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছিল এবং পার্টির সংগঠন বিস্তারের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছিল। এই কমিটিকে সুনিপুণ পরিচালনার ক্ষেত্রেও কমরেড দিলীপ ভট্টাচার্যের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৯৮০ সালে তাঁর নেতৃত্বে উত্তরবঙ্গ পাট চাষি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটির নেতৃত্বে পাটের ন্যায্য মূল্যের দাবিতে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার ও দার্জিলিং জেলার একাংশে তীব্র আন্দোলন সংগটিত হয়। এই কমিটির নেতৃত্বে কৃষকদের পক্ষ থেকে দিল্লিতে এগ্রিকালচার প্রাইস কমিশনের চেয়ারম্যানকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পাট চাষিদের দাবিগুলো সর্বভারতীয় স্তরে নিয়ে আসা হয়। ১৯৮৮ সালে প্রথম পার্টি কংগ্রেসের সময় তিনি রাজ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন, পরবর্তীকালে কৃষক সংগঠন এ আই কে কে এম এস গড়ে তোলার জন্য তাকে রাজ্য স্তরে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমরেড দিলীপ ভট্টাচার্যের মৃত্যুতে দল হারালো একজন একনিষ্ঠ নেতাকে এবং জনগণ হারালো তাদের প্রিয় আপনজনকে। তাঁর স্মরণসভা ২৪ জুলাই জলপাইগুড়ি শহরে। প্রধান বক্তা দলের পলিটবুরো সদস্য কমরেড সৌমেন বসু।
কমরেড দিলীপ ভট্টাচার্য লাল সেলাম