কমরেড জগন্নাথ দাসের জীবনাবসান

এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কমিটির সদস্য কমরেড জগন্নাথ দাস করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১৮ মে রাত্রে ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।

মেদিনীপুর কলেজে পাঠরত অবস্থায় ১৯৭৬ সালে তিনি ওই কলেজে ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও-র সংস্পর্শে এসে মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত হন। জরুরি অবস্থার মধ্যে ওই কলেজের অভ্যন্তরে ডিএসও-র উপর ছাত্র পরিষদ আক্রমণ চালায়। ১৯৭৭-এর পরে রাজ্যে সিপিএম ক্ষমতায় এলে এসএফআই-এর আক্রমণ সে সময় ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কমরেড জগন্নাথ দাস বহুবার সেই আক্রমণের শিকার হয়েছেন। পারিবারিক আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে মেদিনীপুর শহরে একটি ব্যায়ামাগারের মধ্যে একটি ছোট্ট আশ্রয়স্থলে দরিদ্র পরিবারের কয়েকজন বন্ধুর সাথে থেকে অতি কষ্টে তিনি পড়াশোনা চালিয়েছেন। মেদিনীপুর কলেজে পড়াকালীনই তাঁর জন্মস্থান সবং থানায় এআইডিএসও-র পাশাপাশি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পার্টি সংগঠন গড়ে তোলার কাজ তিনি শুরু করেন।

পরিবারের আর্থিক প্রয়োজন ও চাপে মিলিটারির চাকরিতে চলে যান। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মনে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। একদিকে দেশের মানুষের অসহায় অবস্থা, অন্য দিকে মিলিটারির জন্য বিপুল ব্যয় ও সেই বাহিনীর ভূমিকা ও কার্যকলাপ তাঁর মনে প্রশ্ন তোলে। ফলে দু-তিন মাসের মধ্যেই চাকরি ছেড়ে তিনি সংগঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সেই সময় সবং থানার অন্য অংশে কমরেড ভূষণ চন্দ্র মণ্ডলের নেতৃত্বে পার্টি সংগঠনের কাজে যুক্ত হয়ে নানা গণআন্দোলনে তিনি ভূমিকা নেন। ১৯৭৮-এর বিধ্বংসী বন্যায় কেলেঘাই নদীর দু’ধারে অবস্থিত সবং, নারায়ণগড, ভগবানপুর, পটাশপুর প্রভৃতি ব্লক কার্যত ধ্বংস হয়ে গেলে পার্টির নেতৃত্বে উদ্ধারকাজ, ত্রাণ সরবরাহ ইত্যাদি কাজে তিনি সক্রিয় ভূমিকা নেন। পরবর্তীকালে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাপক জনগণকে যুক্ত করে কেলেঘাই, কপালেশ্বরী, বাঘাই নদী সংস্কারের দাবিতে গণকমিটির নেতৃত্বে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন সফল পরিণতিতে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তিনি গ্রহণ করেছিলেন। ভাষা শিক্ষা আন্দোলন, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়কে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ছাত্রদের জন্য কেবলমাত্র বৃত্তিমুখী শিক্ষার প্রতিষ্ঠান করার সরকারি পরিকল্পনা বন্ধ এবং মৌলিক বিষয়গুলি চালু করার দাবিতে গঠিত শিক্ষার সম্প্রসারণ কমিটির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। বাসভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলন এবং এলাকায় সারের কালোবাজারি বন্ধ, রাস্তাঘাট, পানীয় জল, সেচ ব্যবস্থা, ধানের ন্যায্য দাম প্রভৃতি বহুবিধ দাবিতে আন্দোলনে তিনি সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৮৮ সালে প্রথম পার্টি কংগ্রেসের প্রাক্কালে ‘৮৭ সালে তিনি সবং লোকাল কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন।

পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত সামান্য জমিটুকু বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে তিনি সবং থানার কেন্দ্রস্থল তেমাথানিতে পার্টি অফিস তৈরির জন্য জমি কিনে দিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত অর্থ, সম্পত্তি বলতে তাঁর আর কিছুই ছিল না। সর্বক্ষণই দলের কার্যক্রমের মধ্যে তিনি নিজেকে ব্যাপৃত রাখতেন।

‘৯০-এর দশকের গোড়ায় বিদ্যুৎ গ্রাহক আন্দোলন গড়ে ওঠার পরে তিনি সারা বাংলা বিদ্যুৎ গ্রাহক সমিতি (অ্যাবেকা)-র সাথে যুক্ত হয়ে এলাকার তৎকালীন বিদ্যুৎ ব্যবস্থার দুর্দশা দূর করবার জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং থানা জুড়ে তাঁর নেতৃত্বে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে উঠে। তিনি অ্যাবেকার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক হিসাবে বিস্তীর্ণ জেলা জুড়ে ব্লকে ব্লকে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলেন এবং আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। বিদ্যুৎ আন্দোলনে রাজ্যস্তরেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন। উপরোক্ত আন্দোলনগুলিতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ব্যক্তি ধরে ধরে দলের আদর্শ সম্পর্কে আলোচনা, মুখপত্রের গ্রাহক ও ডোনার করানো ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তাঁদের বিপ্লবী দলের প্রতি আকৃষ্ট করেছেন।

কোনও বিষয়ে সমালোচিত হলে, কখনও দুঃখ পেলেও পাল্টা জবাব তিনি দিতেন না। ছোটদের গুণ দেখলে তাদের বরাবরই উৎসাহিত করতেন।

তাঁর অকালমৃত্যুতে দল হারাল একজন নিষ্ঠাবান সংগঠককে। রাজ্যের বিদ্যুৎ গ্রাহকরা এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সাধারণ মানুষ হারাল তাঁদের জীবনের নানা সমস্যা নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পরীক্ষিত একজন সংগঠককে।

কমরেড জগন্নাথ দাস লাল সেলাম

গণদাবী ৭৩ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা