দুরারোগ্য ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর দলের বিশিষ্ট সংগঠক এবং মালদা জেলার প্রাক্তন সম্পাদক কমরেড গোপাল নন্দী ১৯ ফেব্রুয়ারি ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। পরদিন সকাল ১০টায় ৪৮ লেনিন সরণিতে পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তাঁর মরদেহ নিয়ে আসা হয়। ইতিমধ্যে সংবাদ পেয়ে কলকাতার ও মালদা জেলা সহ অন্যান্য জেলার বহু কমরেড অফিসে সমবেত হন। সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের পক্ষে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড মানব বেরা, প্রবীণ পলিটবুরো সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্যের পক্ষে মাল্যদান করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড অশোক সামন্ত। পলিটবুরো সদস্য ও রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান। পলিটবুরো সদস্য কমরেড কে রাধাকৃষ্ণ ও কমরেড স্বপন ঘোষও মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান। এ ছাড়াও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড শঙ্কর দাশগুপ্ত, স্বপন ঘোষাল, সুভাষ দাশগুপ্ত মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান। আন্তর্জাতিক সঙ্গীত পরিবেশনের পর তাঁর মরদেহ নিমতলা শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
কমরেড গোপাল নন্দী ১৯৬০-’৬১ সাল নাগাদ দলের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন উত্তর কলকাতার উল্টোডাঙা অঞ্চলের তদানীন্তন সম্পাদক বিশিষ্ট জননেতা কমরেড বাদল পাল প্রতিষ্ঠিত ফ্রি কোচিং সেন্টারে অন্যান্য অনেকের সাথে ছাত্র হিসাবে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে। পরিবার ছিল দরিদ্র। পিতার কঠোর শাসন ছিল। তাঁর মধ্যেই কমরেড বাদল পালের স্নেহ ও সাহচর্য তাঁকে দলের কাছে নিয়ে আসে। তদানীন্তন কলকাতা জেলা সম্পাদক কমরেড আশুতোষ ব্যানার্জীও তাঁকে প্রভাবিত করেছিলেন। সংগঠন গড়ার আকাঙক্ষা কমরেড গোপাল নন্দীর মধ্যে প্রথম থেকেই ছিল। এ জন্যই ডিএসও কর্মী হিসাবে তিনি বঙ্গবাসী কলেজকে বেছে নেন সেখানে সংগঠন গড়ে তুলবেন বলে। এসএফআই (তদানীন্তন বিপিএসএফ) এবং ছাত্রপরিষদের প্রবল আক্রমণের ফলে তিনি ওই কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। উত্তর কলকাতার মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। সে সময় পার্টির আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি বীরভূম জেলায় সংগঠন গড়ে তোলার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বীরভূমের গ্রামে গ্রামে ঘুরে কে কে এম এফ-এর সদস্য সংগ্রহ করেন। সে সময় বেলডাঙা কলেজকে কেন্দ্র করে নদিয়ায় ছাত্র যোগাযোগ পাওয়া যায়। তাদের ভিত্তি করে পার্টি সংগঠন গড়ার জন্য কমরেড প্রভাস ঘোষ তাঁকে নদিয়ায় পাঠান। সেখানেও তিনি ঘুরে ঘুরে যোগাযোগ বের করেন। নদিয়ায় সংগঠনের কাজ শুরুর পর্বেই স্বয়ং কমরেড শিবদাস ঘোষ তাঁকে ডেকে মালদা জেলায় সংগঠনের কাজ করবার জন্য পাঠিয়ে দেন। কোনও পরিচিতি নেই, যোগাযোগ নেই, কমরেড গোপাল নন্দী সেখানে গিয়ে নানা ভাবে পরিচিতি তৈরি করে একজন, দু’জন করে দলের সাথে যুক্ত করতে থাকেন। মালদা থেকেই তিনি পশ্চিম দিনাজপুর, বালুরঘাট, রায়গঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলে যান। এসব অঞ্চলে তখন দলের যোগাযোগ বিশেষ ছিল না। তিনি সেখানে পড়ে থেকে, ঘুরে ঘুরে একটি দুটি করে যোগাযোগ বের করেন এবং পার্টি ইউনিট গড়ে তোলেন। মোটরভ্যান চালকদের বিরাট সংগঠন তাঁর নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে। পঞ্চানন্দপুর নদীভাঙন প্রতিরোধ আন্দোলনেও তিনি নেতৃত্ব দেন। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের আবেদনে সাড়া দিয়ে শয্যাশায়ী অবস্থাতেই তিনি তাঁর জীবন সংগ্রামের কিছু ইতিবৃত্ত লিখিত ভাবে রেখে গেছেন। যেটি পড়লে আজকের দিনের পার্টির তরুণ কর্মীরা শুধু প্রেরণা পাবে তাই নয়, কী ভাবে সহায় সম্বলহীন হয়ে শুধু মানুষের উপর আস্থা এবং আদর্শের উপর বিশ্বাস রেখে একজন তরুণ বিপ্লবী কর্মী হাটে-মাঠে ঘুরে বেড়িয়েছেন, আশ্রয়-খাওয়াদাওয়ার বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে, সেই কাহিনিও জানতে পারবেন এবং পথচলায় রসদ পাবেন।
তাঁর সন্তানকে কলকাতায় ডাক্তারি পড়ার জন্য কলেজে ভর্তি করে নেতৃত্বের কাছে এসে বলেছিলেন, পার্টির হাতে তুলে দিয়ে গেলাম। সন্তান পিতার সেই মর্যাদা রেখেছেন। তাঁর কমরেড স্ত্রী শিক্ষকতার চাকরি করতেন। সেই সূত্রে তিনি শিক্ষা আন্দোলনেও ভূমিকা পালন করেছেন।
কমরেড গোপাল নন্দী তাঁর শেষ লিখিত আবেদনে বলেছেন, ‘‘কমরেডস, আমার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই আমি এই শেষ আবেদন করছি– যে কোনও কাজে আনন্দ আর লাগাতার প্রচেষ্টা না থাকলে সেই কাজে সফল হওয়া সম্ভব নয়। তরুণ কমরেডদের প্রতি আমার আহ্বান, পার্টির কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করুন এবং নিজেদের গুণগত মান ক্রমাগত উন্নত করুন। পরিস্থিতি বুঝে, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত এলাকাতেই নিতে হবে, এখন টেলিফোন থাকার ফলে নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ আগের থেকে সহজ। আমাদের সময় এই সুযোগ ছিল না।
আবার বলছি, পাড়ায় পাড়ায় আমরা যতক্ষণ না ঢুকতে পারছি, এলাকা ভিত্তিক গণআন্দোলনের পরিবেশ না গড়ে তুলতে পারছি, ততক্ষণ জনগণ আমাদের দিকে আশা নিয়েই তাকিয়ে থাকবেন। গ্রামে গ্রামে, এলাকায় এলাকায়, আমরা গণআন্দোলন গড়ে তুলি জনগণ এটাই আমাদের কাছে চাইছেন। এটা করতে পারলে আমরা খুব দ্রুত এগিয়ে যাব। মৃত্যুশয্যা থেকে এইটুকু অনুরোধ আপনাদের কাছে রেখে গেলাম।’’
কমরেড গোপাল নন্দী লাল সেলাম