এস ইউ সি আই (সি) দলের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা সম্পাদক এবং ওই জেলার বামপন্থী আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা কমরেড গোপেশ মহন্ত-র জীবনাবসান ঘটেছে ১০ জুন, ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালে। বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি ফুসফুসের জটিল রোগে ভুগছিলেন, এর মধ্যে করোনা আক্রান্ত হওয়ায় অবস্থা জটিল হয়ে যায়। ডাক্তার-নার্সদের অক্লান্ত চেষ্টায় করোনা মুক্ত হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর জীবন রক্ষা করা যায়নি।
কমরেড গোপেশ মহন্ত ছাত্রাবস্থাতেই বামপন্থী ভাবধারার সাথে যুক্ত হয়ে খাদ্য আন্দোলন এবং তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে নানা আন্দোলনে যোগ দিয়ে অনেকবার কারারুদ্ধ হন। প্রথম জীবনে তিনি আরএসপি দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাজ্যের প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচনে তিনি ভাটপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান নির্বাচিত হন। কিন্তু কিছুদিন পরেই আরএসপি-র সঙ্গে আদর্শগত ক্ষেত্রে পার্থক্যের জন্য তিনি প্রধান পদ এবং দল থেকেও পদত্যাগ করেন। পরে এলাকার মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে নির্দল প্রার্থী হিসাবে পুনরায় নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সাল নাগাদ তাঁর পরিচিত এক শিক্ষকের কাছ থেকে বিশিষ্ট মার্কসবাদী দার্শনিক ও চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের ‘ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও আমাদের কর্তব্য’ বইটি পড়ে এস ইউ সি আই (সি) দলের আদর্শের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। এই বিষয়ে আরও আলোচনার জন্য তিনি এক বন্ধুকে নিয়ে সরাসরি কলকাতায় দলের কেন্দ্রীয় অফিসে চলে আসেন। সেখানে দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ আলোচনার পর দলের আদর্শকেই নিজের জীবনাদর্শ রূপে গ্রহণ করেন।
জেলায় ফিরে দলের সংগঠন গড়ে তোলার কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। দক্ষিণ দিনাজপুরে দলের সাংগঠনিক বিস্তারের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দলের কাজ শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পারিবারিক বিষয়ে দলের গাইডলাইনকেই প্রাধান্য দিয়ে চলতে থাকেন। স্ত্রী এবং সন্তানদের ভাল-মন্দ, ভবিষ্যৎ-ভাবনা দলের হাতেই ছেড়ে দেন।
পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক কমরেড গোপেশ মহন্তশুধু তাঁর ছাত্রছাত্রীদেরই নয়, এলাকার আরও অনেকের অভিভাবক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনে অভ্যস্ত এই মানুষটি ছিলেন উন্নত রুচি-সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধসম্পন্ন বিরল চরিত্রের অধিকারী। যাঁরাই তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁর চরিত্রের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়েছেন। তাঁর প্রখর শ্রেণিচেতনা রূপ পেয়েছিল গরিব মানুষের প্রতি গভীর দরদবোধের মধ্যে। দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে তিনি ছিলেন সর্বদাই সচেষ্ট। বিস্তীর্ণ এলাকায় নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক কাজ গড়ে তুলেছিলেন তিনি। দরিদ্র ছাত্রদের সব দিক থেকে সাহায্য করা, মনীষী চর্চায় উৎসাহ দেওয়া ইত্যাদি নানা কাজের উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। জেলায় বিদ্যুৎ গ্রাহক আন্দোলন, প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলনে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। বিপ্লবী রাজনীতি তাঁর মধ্যে উচ্চ হৃদয়বৃত্তির জন্ম দিয়েছিল। সুবক্তা না হয়েও দলের রাজনীতি এবং আদর্শের কথাগুলি সহজ কথায় মানুষের মধ্যে নিয়ে যেতে পারতেন। তাঁর চরিত্রের মধুর আকর্ষণেই সাধারণ মানুষ দলের রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হতেন। জেলার সাধারণ কর্মীদের কাছে তাঁর ভূমিকা ছিল পিতৃসম। প্রবল ধৈর্য ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। জীবনের শেষ পর্যায়ে হাসপাতালে প্রবল রোগ যন্ত্রণার মধ্যেও এই ধৈর্যের পরিচয় তিনি দিয়েছেন। ওই পরিস্থিতিতেও তাঁর মুখের হাসি মুছে যায়নি।
১০ জুন রাত্রে তাঁর মৃত্যুসংবাদ আসার পরেই দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় দলের সমস্ত অফিসে রক্তপতাকা অর্ধনমিত করা হয়। পরদিন তাঁর মরদেহ হাসপাতাল থেকে বালুরঘাটের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে কমরেড গোপেশ মহন্ত-র বিপ্লবী জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের পক্ষে মাল্যদান করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড অশোক সামন্ত। পলিটবুরো সদস্য কমরেড সৌমেন বসুর পক্ষেও মাল্যদান করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড অমিতাভ চ্যাটার্জী এবং কমরেড স্বপন চ্যাটার্জী মাল্যদান করেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড সুভাষ দাশগুপ্তের পক্ষেও মাল্যদান করা হয়। রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড কিষান প্রধান, দক্ষিণ দিনাজপুরের পূর্বতন জেলা সম্পাদক কমরেড সাগর মোদক সহ চিকিৎসক, নার্স স্বাস্থ্যকর্মীরা মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান।
বালুরঘাটের পথে গভীর রাতেও কৃষ্ণনগর, গাজোল, মালদায় দলের নেতা-কর্মীরা শ্রদ্ধা জানান। মরদেহ বালুরঘাটে দলের জেলা কার্যালয়ে পৌঁছলে নেতা-কর্মীদের সাথে বহু সাধারণ মানুষ সমবেত হয়ে শ্রদ্ধা জানান। পূর্বতন জেলা সম্পাদক কমরেড প্রণবেশ চৌধুরী এবং বর্তমান জেলা কমিটির সদস্যরা শ্রদ্ধা জানান। অন্যান্য বামপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। শেষ যাত্রায় কমসোমলের সদস্যরা গার্ড অফ অনার দেয় এবং শত শত মানুষ তাতে অংশ নেন।
কমরেড গোপেশ মহন্তর মৃত্যুতে দল হারাল এক গুরুত্বপূর্ণ সংগঠককে, জেলাবাসী হারাল একজন বলিষ্ঠ বামপন্থী নেতা ও সাধারণ মানুষের অভিভাবকতুল্য একজনকে।
২১ জুন বালুরঘাটে তাঁর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ শ্রদ্ধা জানান। এছাড়াও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড অমিতাভ চ্যাটার্জী শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বক্তব্য রাখেন। সভাপতিত্ব করেন জেলা কমিটির সদস্য কমরেড নুরুল ইসলাম।
কমরেড গোপেশ মহন্ত লাল সেলাম