এস ইউ সি আই (সি)-র কেন্দ্রীয় কমিটির পলিটবুরোর প্রাক্তন সদস্য এবং এ আই ইউ টি ইউ সি-র প্রাক্তন সভাপতি | কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তী সুদীর্ঘ অসুস্থতার পর ৮ মে কলকাতা হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হিসপিটালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর।
১৯৫০-এর দশকের প্রথম দিকে, যখন কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তী দক্ষিণ কলকাতার কালীধন ইনস্টিটিউটের ছাত্র, সেই সময় তিনি কমরেড প্রভাস ঘোষের সংস্পর্শে আসেন এবং নানা রকম সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজকর্মে যুক্ত হন। সেই সময় থেকেই তিনি ধীরে ধীরে কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তা ও এস ইউ সি আই (সি)-র প্রতি আকর্ষণ বোধ করতে শুরু করেন এবং ক্রমশ দলের কাছাকাছি আসেন। পরে কমরেড শিবদাস ঘোষের সাথে তাঁর দেখা হয় এবং সেই পরিচয় ও আলাপ তাঁর মনে এতটাই গভীর ছাপ ফেলে যে তিনি দলে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন, এবং নিজেকে একজন সত্যিকারের বিপ্লবী হিসেবে গড়ে তুলতে মার্কসবাদ লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারাকে উপব্ধি করার সংগ্রাম শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে যখন ডিএসও’র সারা ভারত প্রতিষ্ঠা কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয় এবং কমরেড প্রভাস ঘোষ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন, কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তী তখন অন্যতম যুগ্ম সহসম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করেন। এরপর তাঁর পরিবার দক্ষিণ কলকাতার আবাস ছেড়ে উত্তর কলকাতার দমদমে চলে গেলে তিনি দমদমেই দলের ইউনিট গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। ১৯৬০-এর দশকের মধ্যভাগে তিনি এ আই ডি এস ও-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালে দিল্লিতে দলের সংগঠন গড়ে তুলতে তাকে সেখানকার দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়।
১৯৬৯ সালে একটি যোগাযোগের উপর ভিত্তি করে সংগঠন গড়ে তুলতে দলীয় নেতৃত্ব তাঁকে কেরালা পাঠান। এরপর থেকে শুধুমাত্র কেরালা নয়, সমগ্র দক্ষিণ ভারতেই সংগঠন গড়ে তোলার দায়িত্ব কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তীর উপরেই অর্পিত হয়। দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পার্টির সাংগঠনিক প্রসারের অনেকটাই তার কষ্টসাধ্য প্রচেষ্টার ফল। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি এমন বহু কমরেডকে দলে আনেন, যাঁরা পরবর্তীকালে দলের সংগঠনের কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং এখনও করছেন। এরপর নেতৃত্বের পরামর্শে তিনি পশ্চিমের কিছু রাজ্যেও দলের কাজকর্ম দেখাশোনা করতে শুরু করেন। ২০০৯ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত দলের দ্বিতীয় কংগ্রেস-এর আয়োজনে তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১২ সালের মার্চ মাসে দিল্লিতে দলের যে ঐতিহাসিক মিছিল হয়। তার আয়োজনেও তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
১৯৮৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত দলের প্রথম পার্টি কংগ্রেসে কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তী কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত এ আই ইউ টি ইউ সি-র সর্বভারতীয় সম্মেলনে তিনি সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন। দলের দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর তিনি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পলিটবুরোর অন্তর্ভুক্ত হন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত তিনি দলের কেন্দ্রীয় কমিটি এবং পলিটবুরোর সদস্য হিসেবে কাজ চালিয়ে গেছেন।
২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তী প্রবল শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে বাঙ্গালোরের সেন্ট মার্থা হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর নিম্ন শ্বাসনালীতে সংক্রমণ ধরা পড়ে। তাঁর অবস্থার অবনতি হতে থাকলে কমরেড প্রভাস ঘোষ অবস্থা খতিয়ে দেখার উদেশ্যে ডাক্তারদের একটি দলকে ব্যাঙ্গালোর পাঠান। তাঁদের কাছ থেকে অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হয়ে কমরেড প্রভাস ঘোষ তাঁকে আরও উন্নত চিকিৎসার উদ্দেশ্যে জরুরি ভিত্তিতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের সাহায্য কলকাতা আনার পরামর্শ দেন। সেইমতো কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তীকে কলকাতায় এনে ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক ও হসপিটালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষায় ধরা পড়ে, তাঁর হৃৎপিণ্ডের অনেকগুলি প্রাচীরের কোষেই রক্ত সঞ্চালনে বাধা তৈরি হওয়ায় অক্সিজেন পৌঁছচ্ছে না (ডাক্তারি পরিভাষায় গ্রস ইসকেমিয়া অব মাল্টিপল ওয়ালস অব হার্ট), তার ফলে হৃৎপিণ্ড স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে না পেরে ফেল করার দিকে যাচ্ছে; সেইসাথে ফুসফুসের প্রবল সংক্রমণ ও প্রদাহের ফলে (সিওপিডি) দেহে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে তখনই একটি অ্যানজিওপ্লাস্টি করে হৃৎপিণ্ডের একটি প্রধান ধমনী থেকে ব্লকেজ সরানো হয়। এর ফলে তাঁর অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হয় এবং বিপদ তখনকার মতো কাটে। কিন্তু এরপর থেকে তিনি কখনওই আর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি। একদল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নিয়মিত তত্ত্বাবধানে তাঁকে এরপর থেকে কলকাতাতেই থাকতে হয়। প্রায়শই তাঁর স্বাস্থ্য পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হত এবং সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ত যে, তাঁকে আবার হাসপাতালে ভর্তি করতে হত। শেষবার ১ মার্চ প্রবল শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে তাকে আবার ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালে ভর্তি করা হয়। সেখানে দেখা যায়, তাঁর কিডনিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অবস্থার ধীরে ধীরে ক্রমাবনতি হতে থাকে। ফুসফুসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়, দেহে সেপসিস ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষপর্যন্ত মাল্টি অর্গান ফেলিওর-এর ফলে তাঁর মৃত্যু ঘটে। কেন্দ্রীয় কমিটি সারা দেশে দু’দিনের শোক পালনের ডাক দেয়। সমস্ত কার্যালয়ে রক্তপতাকা অর্ধনমিত করা হয় এবং কমরেডরা কালো ব্যাজ পরিধান করেন।
তার মরদেহ ওই দিন বিকাল তিনটা নাগাদ লেনিন সরণিতে দলের কেন্দ্রীয় অফিসে আনা হয়। কোভিড বিধি মেনে নানা এলাকা থেকে নেতা কর্মীরা জড়ো হয়েছেন ততক্ষণে। প্রথমেই সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের পক্ষ থেকে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক কমরেড স্বপন ঘোষ। কমরেড অসিত ভট্টাচার্য, কমরেড মানিক মুখার্জী সহ অন্যান্য অনুপস্থিত প্রবীণ পলিটবুরো সদস্যসদের পক্ষ থেকেও মাল্যদান করা হয়। কমরেড গোপাল কুণ্ডু, ছায়া মুখার্জী, সৌমেন বসু, চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য সহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরাও মাল্যদান করেন। দলের গণসংগঠনগুলির সর্বভারতীয় কমিটির পক্ষ থেকে মাল্যদান করা হয়। কমরেড শিবদাস ঘোষের উপর রচিত সঙ্গীত ও আন্তর্জাতিক পরিবেশন করেন উপস্থিত কর্মীরা।
এরপর শবদেহবাহী গাড়িকে সামনে রেখে রক্তপতাকা সহ বাইক মিছিল করে কমরেডরা সামিল হন শেষ যাত্রায়। মরদেহ এ আই ইউ টি ইউ সি অফিস ঘুরে কেওড়াতলা শ্মশানে পৌছালে সেখানে উপস্থিত দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা লাল সেলাম ধ্বনিতে কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তীকে শেষ বিদায় জানান।
কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তী লাল সেলাম