দলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির প্রবীণ সদস্য কমরেড কার্তিক সাহা ৩০ জানুয়ারি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকরা জানান ব্রেন স্ট্রোক অর্থাৎ মস্তিষ্কে প্রবল রক্তক্ষরণে তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসার সব রকম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পরদিন ৩১ জানুয়ারি তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। ১ ফেব্রুয়ারি তাঁর মরদেহ রাজ্য অফিসে নিয়ে আসা হয়। অফিসে তখন কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং থাকায় সমস্ত সদস্যরা এবং রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে বহু কর্মী সমবেত হন শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ মাল্যদান করে বিপ্লবী শ্রদ্ধা জানান। পলিটবুরোর প্রবীণ সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্যের পক্ষ থেকে মাল্যদান করা হয়। রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান।
দরিদ্র পরিবারের সন্তান কমরেড কার্তিক সাহা ষাটের দশকের গোড়ায় ছাত্রাবস্থায় কলকাতার উল্টোডাঙার তৎকালীন আঞ্চলিক সম্পাদক, রাজ্য কমিটির প্রয়াত সদস্য কমরেড বাদল পালের সংস্পর্শে এসে সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার সন্ধান পান। কমরেড বাদল পাল একটি অবৈতনিক কোচিং সেন্টার পরিচালনা করতেন। সেখানে কার্তিক সাহা শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। পরবর্তী কালে কমরেড বাদল পাল প্রতিষ্ঠিত শরৎ শিক্ষায়তন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথমে সহকারী শিক্ষক হিসাবে এবং পরে প্রধান শিক্ষক হিসাবে কমরেড কার্তিক সাহা দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তাঁর ছাত্রজীবনও অব্যাহত ছিল। স্নাতক স্তরে পড়াশুনার জন্য তিনি আশুতোষ কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৮ সালে তিনি ওই কলেজে এআইডিএসও পরিচালিত ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে সিপিএমের চূড়ান্ত সংকীর্ণতা ও দলবাজির পরিণতিতে একের পর এক যৌথ সংগঠনগুলিতে ভাঙন অনিবার্য হয়ে ওঠে। তখন সিপিএমের আধিপত্যবাদী ভূমিকার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, পার্টির নির্দেশে সমস্ত অংশের প্রাথমিক শিক্ষকদের যুক্ত করে তিনি বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতিকে গড়ে তোলেন। যার সভাপতি ছিলেন কমরেড সুকোমল দাশগুপ্ত এবং কমরেড কার্তিক সাহা ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। সিপিএমের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে জেলায় জেলায় এই নতুন সংগঠনকে নিয়ে যেতে অসামান্য সংগ্রাম সেদিন তিনি পরিচালনা করেছেন, তার মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন শিক্ষক আন্দোলনের একজন বলিষ্ঠ নেতা। তাঁর নেতৃত্বে শিক্ষকদের জীবন-জীবিকার নানা সমস্যা প্রতিকারের দাবিতে বহু আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। দেশের বুকে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা অন্যান্য গণআন্দোলনগুলিতেও তিনি আমৃত্যু সাধ্যানুযায়ী সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন।
শুধু শিক্ষক আন্দোলনেই নয়, শিক্ষা আন্দোলনেও তিনি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭৭ সালে সিপিএম নেতৃত্বাধীন ফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে প্রাথমিকে ইংরেজি ও পাশফেল প্রথা তুলে দিলে তার বিরুদ্ধে দলের পক্ষ থেকে কমরেড মানিক মুখার্জীর নেতৃত্বে রাজ্যের প্রথিতযশা শিক্ষাব্রতী ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত ‘শিক্ষা সংকোচন বিরোধী ও স্বাধিকার রক্ষা কমিটি’-র পরিচালনায় ঐতিহাসিক ভাষা-শিক্ষা আন্দোলন এ রাজ্যে গড়ে উঠেছিল। এই আন্দোলনের সামনে সিপিএম-ফ্রন্ট সরকার শেষপর্যন্ত নতিস্বীকার করে প্রাথমিকে ইংরেজি ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিল। এর সূচনা থেকেই তিনি ও তাঁর নেতৃত্বে বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গিয়েছে। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পাশফেল তুলে দেওয়ার ফলে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার উপর যে আঘাত নেমে এসেছিল তাকে মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে পার্টির সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৯২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বতন উপাচার্য বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডঃ সুশীল কুমার মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে এবং কমরেড কার্তিক সাহার সম্পাদনায় ও প্রত্যক্ষ পরিচালনায় গঠিত হয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন পর্ষদ। তার তত্ত্বাবধানে সারা রাজ্যে চতুর্থ শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা চালু হয়। আন্দোলনের মঞ্চ হিসাবে পরীক্ষা পরিচালনার এই উদ্যোগ এ দেশের শিক্ষা আন্দোলনে এক নজিরবিহীন ঘটনা। একই ভাবে কেন্দ্রের সর্বনাশা জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ‘সেভ এডুকেশন কমিটি’ দেশজুড়ে যে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলছে, সেখানেও কমরেড কার্তিক সাহা এক নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন সারা বাংলা সেভ এডুকেশন কমিটির সম্পাদক ছিলেন।
তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এ রাজ্যে গড়ে উঠেছে অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি। সম্পাদক হিসাবে এর দায়িত্ব তিনি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বহন করেছেন। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে তিনি নিজের পরিবারকে পরিচালনা করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর স্ত্রী বিয়ের আগেই পার্টির ভাল কর্মী ছিলেন। কন্যাও দলের সঙ্গে যুক্ত হন। বেশি বয়সেও কমরেড কার্তিক সাহার চিন্তার সক্রিয়তা বহাল ছিল এবং দেশের ও সমাজের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি সুচিন্তিত মতামত পার্টির কাছে ব্যক্ত করে সাহায্য করে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে পার্টির বড় ক্ষতি হল, শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলনেরও ক্ষতি সাধিত হল।
১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার আশুতোষ কলেজ হলে স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন পলিটবুরো সদস্য কমরেড সৌমেন বসু। সভাপতিত্ব করেন পলিটবুরো সদস্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য।
কমরেড কার্তিক সাহা লাল সেলাম