এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) পূর্ব বর্ধমান জেলা কমিটির সদস্য, এ আই ইউ টি ইউ সি পূর্ব বর্ধমান জেলা কমিটির সম্পাদক ও রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড অরুণাংশু সরকার ২৯ মে ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬১ বছর। তিনি করোনা এবং তার পরবর্তী শারীরিক জটিলতা নিয়ে ওই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।
জন্মসূত্রে তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে নদীয়া জেলায়। পরিবার ছিল অত্যন্ত দরিদ্র। নদীয়াতেই তিনি দলের ছাত্র সংগঠন এ আই ডি এস ও-র কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু আশির দশকের শুরুতে কর্মসংস্থানের তাগিদে অবিভক্ত বর্ধমান জেলার চিত্তরঞ্জনে চলে যান। সেখানে তাঁর দাদারা কর্মসূত্রে থাকতেন। চিত্তরঞ্জনেই সক্রিয়ভাবে দলের কাজ তিনি শুরু করেন । তাঁর মর্যাদাবোধ ছিল অত্যন্ত প্রখর। বিভিন্ন কারণে কিছুদিন পরেই তিনি দাদাদের আশ্রয় ত্যাগ করে একাই একটি ঝুপড়িতে থাকতে শুরু করেন। সে সময় রাস্তায় রাস্তায় কখনও বাদাম, কখনো শশা বিক্রি করে তাঁর দিন চলত। তৎকালীন সময়ে রাজ্য জুড়ে প্রাথমিকে ইংরেজি ও পাশ-ফেল পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে আন্দোলন চলছে। ১৯৮৩ সালে ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে আয়োজিত পথসভায় বক্তব্য শুনে তিনি ওখানে উপস্থিত এসইউসিআই(সি) নেতাদের সঙ্গে পরিচিত হন এবং দলের সাথে আবার তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার অনুশীলন তিনি গভীরভাবে শুরু করেন। কমরেড প্রণবেশ দত্ত তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং সেখান থেকেই তিনি দলের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কাজের প্রতি তাঁর আবেগ ও নিষ্ঠা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজেকে দলের সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে ভাবতে শুরু করেন এবং সেভাবেই দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
এর কিছুদিন পর নেতৃত্বের নির্দেশে এক কথায় দৃষ্টিহীন বিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিয়ে তিনি বর্ধমানে চলে আসেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই স্কুলে থেকেছেন এবং প্রায় একক উদ্যোগেই এই স্কুলের প্রসার ঘটানোর ক্ষেত্রে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। যেখানেই দৃষ্টিহীন ছাত্রের সন্ধান পেয়েছেন তিনি সেখানেই ছুটে গেছেন। এই স্কুলের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজে দৃষ্টিমান হয়েও দৃষ্টিহীনদের প্রতি যে মমত্ববোধ ও দায়িত্ববোধের স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন, তা সকলের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ। তাঁর মৃত্যুতে স্কুলের আবাসিক ছাত্র, শিক্ষক ও শুভানুধ্যায়ীরা অভিভাবকহীন হওয়ার শোক অনুভব করছেন। বিদ্যালয়ের ছাত্রদের শিক্ষিত ও যথার্থ অর্থে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কাজে তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা ছিল।
এর পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষকে নিয়ে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও তিনি উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন। বিশেষ করে মোটরভ্যান চালক, আশাকর্মী, আইসিডিএস কর্মী, মিড-ডে মিল কর্মী ও বিড়ি শ্রমিকদের নানা আন্দোলন সংগঠিত করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং তার ধারাবাহিকতাতেই পরবর্তীকালে দলের শ্রমিক সংগঠনের জেলা সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। শোষিত শ্রমিকদের ব্যথা বেদনা অন্তর দিয়ে অনুভব করতেন বলেই তিনি অত্যন্ত আবেগের সাথে তাদের আন্দোলনের একজন শরিক হতে পেরেছিলেন। সেজন্যই নিপীড়িত বঞ্চিত শ্রমিকদের কাছে তিনি ছিলেন একান্ত আপনজন। তাই তাঁর মৃত্যুতে তাঁরাও স্বজন হারানোর ব্যথা অনুভব করছেন।
কমরেড অরুণাংশু সরকারকে যখন যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং হাসিমুখে ও নিষ্ঠার সাথে প্রতিটি দায়িত্ব পালনে ব্রতী হয়েছেন, কখনও আপত্তি করেননি। এই দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই তিনি দলের অবিভক্ত বর্ধমান জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। প্রখর শ্রেণি চেতনাকে ভিত্তি করেই গরিব মানুষদের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা গড়ে উঠেছিল। তিনি সুবক্তা ছিলেন না কিন্তু ‘বিপ্লবী রাজনীতি উচ্চতর হৃদয়বৃত্তি’– এই বোধ তাঁর আচার-আচরণ-সংস্কৃতিতে এমনভাবে ফুটে বেরোত, যা অন্যদের স্পর্শ করে যেত। অত্যন্ত সহজ সরল জীবনে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন এবং বাস্তবিক অর্থেই নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কোনও চাহিদা তাঁর কোনও দিনই ছিল না। তিনি যাঁদের সাথে মিশতেন তাঁদের ওপর গভীর ছাপ ফেলতে পারতেন এবং সকলের কাছেই দলের চিন্তাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। সে কারণেই অবিভক্ত বর্ধমান জেলা ও পরে পূর্ব বর্ধমান জেলায় তিনি বহু কর্মীকে দলের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছিলেন। তাঁর অসম্ভব ধৈর্য ও নিষ্ঠা ছিল। তাই তিনি বহু কষ্টকর কাজও অনায়াসে এবং হাসিমুখে করতে পারতেন। তাঁর অকাল প্রয়াণে শ্রমজীবী মানুষ হারালো তাঁদের একান্ত আপন জনকে। দল হারালো বিপ্লবের একজন বলিষ্ঠ সৈনিক ও দক্ষ সংগঠককে।
কমরেড অরুণাংশু সরকার লাল সেলাম