এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির প্রবীণ সদস্য, শিক্ষা আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা, দলের ইংরাজি মুখপত্র ‘প্রোলেটারিয়ান এরা’র একনিষ্ঠ লেখক–কর্মী কমরেড অনীশ রায় জটিল টিবি, কিডনির সমস্যা ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২৯ নভেম্বর ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন৷ বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর৷
১৯৬০–এর দশকের শেষ দিকে রাজ্য কমিটির প্রবীণ সদস্য কমরেড ধ্রুবজ্যোতি মুখার্জীর মাধ্যমে কমরেড অনীশ রায় দলের সংস্পর্শে আসেন৷ প্রথমে তিনি পথিকৃৎ–এর সঙ্গে যুক্ত হন৷ পথিকৃৎ–এ তিনি দলের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও বর্তমানে পলিটবুরোর প্রবীণ সদস্য কমরেড মানিক মুখার্জীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন৷ কমরেড মানিক মুখার্জীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি দলেরও গুরুত্বপূর্ণ কর্মী হয়ে ওঠেন৷ মার্কসবাদ–লেনিনব ঘোষের চিন্তাধারাকে আয়ত্ত করার তীব্র আকাঙক্ষা থেকে তিনি এর অনুশীলন শুরু করেন৷ দলের সাথে একাত্ম হওয়ার সংগ্রামে তিনি আত্মনিয়োগ করেন৷ এর মধ্য দিয়ে তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা বিকশিত হয়ে উঠতে থাকে৷ তাঁকে পথিকৃৎ সংগঠনের পার্টি ইউনিটের দায়িত্ব দেওয়া হয়৷
তিনি উজ্জ্বল অ্যাকাডেমিক কেরিয়ারের অধিকারী ছিলেন৷ অতি অল্প বয়সেই তিনি ভূ–তত্ত্ব নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করার কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতার প্রখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন৷ পরে তিনি জীবাশ্ম বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন৷ সরল অমায়িক ব্যবহার ও নিজের বিষয়ের উপর অগাধ জ্ঞান এবং আকর্ষণীয় শিক্ষণ পদ্ধতির জন্য তিনি ছাত্রদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র হয়ে ওঠেন৷ বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই লেখার তাঁর সাবলীল দক্ষতা ছিল৷ দলের আদর্শ অনুশীলনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাঁর কলম ক্রমাগত পরিশীলিত হয়ে উঠতে থাকে৷ তিনি নবগঠিত সরকারি কলেজ শিক্ষক সংগঠনে যুক্ত হয়ে কলেজ শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলনে সামিল হন৷ কমরেড অনীশ রায় তাঁর চাকরিজীবন এবং পার্টিজীবনকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে মিলিয়ে দিতে পেরেছিলেন৷ সহকর্মী ও ছাত্রদের মধ্যে দলের রাজনীতি ও আদর্শ নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর নিয়মিত চেষ্টা ছিল৷
দলের রাজনীতি ও আদর্শের চর্চা ও তার প্রকাশভঙ্গিমা আয়ত্ত করার মধ্য দিয়ে তিনি দলের বাংলা মুখপত্র গণদাবীর লেখক প্যানেলের অন্তর্ভুক্ত হন৷ নেতৃত্বের গাইডেন্সের ভিত্তিতে দলের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের খসড়াও তিনি রচনা করেন৷ ২০০৩–এর মাঝামাঝি থেকে পলিটবুরোর সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে তিনি দলের ইংরেজি মুখপত্র ‘প্রোলেটারিয়ান এরা’য় লেখার দায়িত্ব পান৷ দল এবং দলের নেতৃত্বের প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল শিক্ষণীয়৷ তার রূপ এমনই ছিল যে, বয়সে অনেক ছোট এমনকি তাঁর ছাত্রের নেতৃত্বেও কাজ করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আনন্দের সাথে৷ একসাথে অনেক দায়িত্ব এলেও নিঃশব্দে নীরবে তার সবগুলি পালন করার জন্য সর্বোত্তম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য৷ এর মধ্য দিয়ে তিনি দলের আদর্শগত সংগ্রামে মূল্যবান অবদান রেখেছেন৷ তাঁর স্ত্রী ও ছোট বোনকে তিনি দলে যোগ দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন৷ সন্তানরাও দলের সমর্থকে পরিণত হয়েছেন৷ তাঁর পরিবার–পরিজন, বন্ধুবান্ধব ও ছাত্রদের মধ্যে তিনি দলের আদর্শ সঞ্চারিত করেছেন৷ বিদেশে বসবসকারী বহু ছাত্রের সাথে তিনি নিয়মিত রাজনৈতিক মতামত বিনিময় করতেন৷
২০১৪–র নভেম্বরে কমরেড গৌরীশঙ্কর ঘটকের মৃত্যুর পর অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে তিনি নির্বাচিত হন৷ শিক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজেও দক্ষতার পরিচয় দেন তিনি৷ দেশের অন্যান্য অগ্রগণ্য শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের সাথে নিবিড় সংযোগ গড়ে তুলে তিনি সরকারের সর্বনাশা জাতীয় শিক্ষানীতি প্রতিরোধ আন্দোলনে অগ্রগণ্য ভূমিকা নেন৷ তাঁর নেতৃত্বে সেভ এডুকেশন আন্দোলন গতিলাভ করে এবং রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে৷ এই কাজে তাঁর সাফল্যের ফলে শিক্ষাবিদ–শিক্ষানুরা মানুষ তাঁকে ২০২১–এ দ্বিতীয়বার সেভ এডুকেশন কমিটির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করেন৷ ভগ্ণ স্বাস্থ্য উপেক্ষা করে সেভ এডুকেশন আন্দোলনকে সংহত করতে তিনি দেশের নানা প্রান্তে ঘুরেছেন৷ এমনকি হাসপাতালের শয্যা থেকেও তিনি চিকিৎসকদের অনুমতি নিয়ে অনলাইন সেমিনার ও শিক্ষা সংক্রান্ত কর্মসূচিতে অংশ নেন৷
নম্র ও বিনয়ী ব্যবহার এবং হূদয়ের কোমলতা ছিল তাঁর চারিত্রিক সৌন্দর্য৷ এই নিরহঙ্কার মানুষটিকে বাইরে থেকে দেখে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা, বিপ্লবী চরিত্রের বর্ণময়তা সবসময় বোঝা যেত না৷ অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য অনেকসময় তিনি প্রকাশ্য সভার মঞ্চে বিশেষ আসতে চাইতেন না, কিন্তু পার্টি যখন চেয়েছে তিনি তাঁর কুণ্ঠার বেড়া ভেঙে দলের সিদ্ধান্তকে হাসিমুখে কার্যকর করেছেন৷
তাঁর মৃত্যুতে দল হারাল অত্যন্ত মূল্যবান একজন নেতৃস্থানীয় সংগঠককে, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন বঞ্চিত হল এক দক্ষ নেতৃত্ব থেকে৷
কমরেড অনীশ রায় লাল সেলাম