Breaking News

কবর খোঁড়া ছাড়া আর কোনও সম্বল নেই বিজেপির

এ বার বিজেপি পড়েছে মুঘল সম্রাট অওরঙ্গজেবের সমাধি নিয়ে! ১৭ মার্চ বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং আরএসএস-বিজেপির মদতপুষ্ট কিছু সংগঠন হঠাৎ নাগপুরে ৩০০ বছরের বেশি আগে মৃত এই মুঘল সম্রাটের সমাধির প্রতিরূপ এবং একটি সবুজ চাদর পুড়িয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। তাদের দাবি, মহারাষ্ট্রের অওরঙ্গাবাদ জেলার খুলতাবাদে অওরঙ্গজেবের সমাধি অপসারণ করতে হবে।

এদের উস্কানিমূলক বক্তব্য ও সংখ্যালঘুদের প্রতি উগ্র বিদ্বেষমূলক আচরণের ফলে নাগপুর শহরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। এতে হিন্দু-মুসলমান বহু সাধারণ মানুষের ক্ষতি হয়েছে। এই দাঙ্গার পক্ষে সাফাই গেয়ে রাজ্যের বিজেপি জোটের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিস বলেছেন, ছত্রপতি শিবাজির পুত্র সম্ভাজিকে কেন্দ্র করে নির্মিত সিনেমা ‘ছাওয়া’ দেখে মানুষের আবেগ উথলে ওঠায় তা সামলানো যায়নি। কিন্তু এই আবেগ তোলার কাজটা করেছে কে? মহারাষ্টে্র বিজেপি জোট সরকারই নয় কি? শুধু তাই নয়, বিজেপি এমএলএ প্রবীণ দাতকে পর্যন্ত বলেছেন, পুলিশ সময়মতো হস্তক্ষেপ করলে এই দাঙ্গা এড়ানো যেত।

কিন্তু বিজেপির ‘মহায্যুতি সরকার’ আদৌ এই দাঙ্গা বন্ধ করতে চেয়েছিল কি? চাইবে কী করে? মাত্র কয়েক মাস আগে টাকার থলি আর কেন্দ্রীয় সরকারের ইডি সিবিআইয়ের মতো এজেন্সিগুলোর চোখ রাঙানির জোরে শিবসেনা এবং এনসিপিকে ভেঙে মহারাষ্ট্রের রাজ্য সরকারের গদি দখল করেছে বিজেপি। সেই সময় তারা যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার কোনওটিই পূরণ করার ইচ্ছা বা ক্ষমতা তাদের নেই। একেবারে শুরু থেকেই এই সরকারের জোটসঙ্গীদের মধ্যে প্রবল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছে। ফলে ‘লাডলি বহিন যোজনা’ই হোক কিংবা অন্য প্রতিশ্রুতিগুলিই হোক, তা পূরণ করতে সরকার অপারগ। বিজেপি, শিবসেনা, কংগ্রেস, এনসিপি–এরা সকলেই নানা সময়ে মহারাষ্টে্র রাজ্য সরকার চালিয়েছে। তারা প্রত্যেকেই বৃহৎ ব্যবসায়ী এবং পুঁজিপতিদের বিপুল কর ছাড়, বিনা পয়সায় জমি, শিল্পের নামে নানা খাতে টাকা পাইয়ে দেওয়ার মতো কাজ করতে করতে মহারাষ্ট্রকে ঋণের ফাঁসে জড়িয়েছেন। এই মুহূর্তে মহারাষ্ট্র সরকারের ঋণ সাড়ে ৮ লক্ষ কোটি টাকা। ফলে সরকারের অতি প্রয়োজনীয় কাজেরও টাকা নেই। বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচের জল, পানীয় জলের আকাল। চাষির আত্মহত্যায় মহারাষ্ট্র দেশের মধ্যে প্রথম। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ। মারাঠওয়াড়া এলাকার সরপঞ্চ দেশমুখের খুনের প্রতিবাদে বিদ এবং প্রভানী জেলায় প্রবল জনরোষ এবং আন্দোলনের ফলে সরকারের মুখরক্ষায় মন্ত্রী ধনঞ্জয় মুণ্ডেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। থানে জেলার স্কুলে শিশুকন্যাদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনাকে চাপা দিতে পুলিশের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে জনরোষ ফেটে পড়েছে। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে সরকারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভকে বিপথগামী করার যে রাস্তাটা সব শাসক ভাল চেনে, মহারাষ্ট্রের বিজেপি জোটও সেই রাস্তাতেই হাঁটছে। তাই মুখ্যমন্ত্রী ফড়নবিস সহ অন্য মন্ত্রীরা বিশেষত মন্ত্রী নীতেশ রানে একের পর এক সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক মন্তব্য করে চলেছেন।

কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের় অপশাসনের বিরুদ্ধেও গণবিক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছে। কৃষকরা নতুন করে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নতুন শ্রমকোড, বিদ্যুৎ আইন, শিক্ষানীতি–সমস্ত ক্ষেত্রেই বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে। এর থেকে মানুষের চোখ ঘোরাতেই কখনও সিনেমা, কখনও অন্যকিছুর জিগির তুলে দেশজুড়ে প্রবল উগ্র হিন্দুত্বের সেন্টিমেন্ট জাগিয়ে তুলতে চেয়েছে বিজেপি। আবার পশ্চিমবঙ্গের মতো যে রাজ্যে তারা ক্ষমতায় নেই সেখানেও বিজেপির নিজেদের স্বপক্ষে ভোট চাইবার কোনও গণতান্ত্রিক হাতিয়ার নেই। তাই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীকে বলতে হচ্ছে বিজেপি জিতলে মুসলিম বিধায়কদের চ্যাং দোলা করে ছুঁড়ে ফেলে দেব! আরএসএস প্রধানকে পশ্চিমবঙ্গে ডেকে এনে হিন্দুত্বের হাওয়া তোলার চেষ্টা করতে হচ্ছে। এতগুলি এমএলএ নিয়েও কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেসের জনবিরোধী শাসনের বিরুদ্ধে বাংলায় কোনও রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরা বা জনস্বার্থ সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কর্মসূচি নিতে পারছে না কেন তা মানুষকে ভাবাচ্ছে। আসলে বিজেপি আজ আদর্শগত-চিন্তাগত-রাজনৈতিক দিক থেকে এতটাই দেউলিয়া যে তাদের কার্যত কোনও কিছু বলবার নেই। তাদের কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলির বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষোভে ফুঁসছে। ফলে মুসলিম বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও দেশপ্রেমের নামে সমস্ত বিরোধী কণ্ঠস্বরকে গলা টিপে মারার চেষ্টা ছাড়া জনগণকে বিজেপির আজ কিছুই দেওয়ার নেই।

বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি এখন জনগণের দুঃস্বপ্নের রাজ্যে পরিণত হচ্ছে। তাদের আদর্শগত অভিভাবক আরএসএস-ও এক সময় শৃঙ্খলা এবং উগ্র সাম্প্রদায়িক-জাতীয়তাবাদী বুলি দিয়েও কিছু সৎ মানুষকে টানতে পারত, আজ তাদেরও সেই ক্ষমতা নেই। আরএসএস যে পুরোপুরি টাকার থলির কাছে আত্মসমর্পণ করা একটি সংগঠন তা তাদের নেতাদের চারপাশে ভিড় করে থাকা ধান্দাবাজ ক্ষমতালোভীদের দেখে মানুষ অনেকটাই ধরতে পারছে। এই পরিস্থিতিতে বিজেপিকে আরও বেশি বেশি করে উগ্র সাম্রদায়িক রাস্তা নিতে হচ্ছে।

এই প্রসঙ্গে যে ‘ছাওয়া’ সিনেমাটি নিয়ে এত হইচই, যার নায়ককে ঘিরে আবেগ থেকে নাকি একেবারে ৩০০ বছরের ইতিহাসই মুছে ফেলতে চাইছে বিজেপি-আরএসএস– তার নায়কটিকে দেখা যাক। প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, কোনও গল্প-উপন্যাস, সিনেমা ইত্যাদি ইতিহাস নয়। এগুলিকে ইতিহাস আশ্রিত বলে কেউ দাবি করলেই তা ইতিহাসের প্রকৃত ছবি হয়ে ওঠে না। ছত্রপতি শিবাজির পুত্র সম্ভাজিকে নিয়ে মারাঠা লেখক শিবাজি সাওন্তের উপন্যাস এবং তার থেকে তৈরি সিনেমাটি যে ইতিহাসের কোনও ধার ধারেনি, তা যে কোনও ইতিহাসবোধ সম্পন্ন মানুষ বুঝবেন। এই সিনেমার কারিগরদের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে ব্যবসা করা, সে কাজটিতেই তাঁরা নজর দিয়েছেন। অথচ ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার এমনকি আরএসএস-এর পরম পূজ্য বিনায়ক দামোদর সাভারকর পর্যন্ত এই সম্ভাজিকে বদরাগী, দুশ্চরিত্র, অপদার্থ ইত্যাদি বলেছেন। এমনকি পিতা শিবাজির সঙ্গে তাঁর বিশ্বাসঘাতকতা ও মোগল সেনাপতি দিলির খাঁর সঙ্গে হাত মেলানোর কথাও ইতিহাসেই আছে। যে কারণে পরে পেশোয়ারা শক্তিশালী হলেও মহারাষ্টে্র সম্ভাজি বীর হিসাবে পূজিত হননি।

যদিও আধুনিক ইতিহাস পাঠের মাপকাঠিতে সামন্তী যুগের কোনও শাসককেই একমাত্রিক বিচার করা যায় না। একজনের সব ভালো আর অপরের সব খারাপ এ ভাবে ইতিহাস লিখতে যাওয়াই চলে না। ঠিক এই কারণেই মুঘল সম্রাট অওরঙ্গজেব সম্বন্ধেও একমাত্রিক এবং তাঁর ধর্মপরিচয় ভিত্তিক বিচার চলে না। কিন্তু বিজেপির এখন প্রয়োজন ভারতের ইতিহাসকে বিকৃত করে মুসলমান মাত্রেই চরম খারাপ বলে তুলে ধরা। তাদের দরকার এখন তীব্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষ ছড়ানো। এ কারণেই হঠাৎ করে অওরঙ্গজেবের কবর নিয়ে তারা উঠে পড়ে লেগেছে। যদিও বিগত ৩০০ বছরে ওই কবরে সম্রাটের সব হাড়ই মাটিতে মিশে যাওয়ার কথা। তার উপরের সৌধটিও মুঘলদের তৈরি নয়। অওরঙ্গজেব চেয়েছিলেন তাঁর সমাধি হবে অনাড়ম্বর। ফলে সম্রাটকে যখন কবরস্থ করা হয় সেখানে কোনও সৌধ তৈরি হয়নি। পরে ব্রিটিশ আমলে হায়দরাবাদের নিজাম এটি তৈরি করেছেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই সমাধি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের অধীনে একটি হেরিটেজ সাইট। এখানে হামলার ঘটনা দেখেও সরকার চোখ বুঁজে থাকল কী করে? দাঙ্গাবাজদের প্রতি প্রশ্রয়ের মনোভাব ছাড়া তা হতে পারত কি? মনে পড়ে যায় তালিবানের হাতে ধ্বংস হওয়া বামিয়ানের বুদ্ধ মূর্তি, বিজেপি-আরএসএস বাহিনীর হাতে ধ্বংস হওয়া অযোধ্যার বাবরি মসজিদের কথা। কোনও মতবাদ, কোনও শাসকের ভূমিকা কারও অপছন্দ হতেই পারে, কিন্তু তার ইতিহাস-সিদ্ধ ভূমিকাকে গায়ের জোরে মুছে দেওয়ার চেষ্টা যারা করে তাদের সভ্যতার শত্রু ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় কি? স্মরণ করা ভাল, কিছু দিন আগে জাতির অভিভাবক সাজার চেষ্টায় আরএসএস প্রধান মোহন ভগবত বলেছিলেন, আর কোনও মসজিদের নিচে মন্দির খুঁজব না আমরা! কিন্তু তাঁদের পরিস্থিতি যা তাতে বোঝা যাচ্ছে এই কবর খোঁড়ার রাজনীতি ছাড়া অন্য সম্বল নেই তাদের।

নাগপুরের সাম্প্রতিক দাঙ্গা প্রসঙ্গে এস ইউ সি আই (সি)-র মহারাষ্ট্র রাজ্য সাংগঠনিক কমিটির সম্পাদক কমরেড অনিল ত্যাগী ২১ মার্চ এক বিবৃতিতে দাবি জানিয়েছেন, হাইকোর্টের কর্মরত বিচারপতিকে দিয়ে এই দাঙ্গার তদন্ত করতে হবে। দলের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানানো হয়েছে। ধর্ম-বর্ণ-জাত নির্বিশেষে খেটেখাওয়া মানুষের ওপর পুঁজিপতি শ্রেণি ও তাদের সেবাদাস সরকারের আক্রমণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বানও জানানো হয়েছে।