Breaking News

ক’বছরেই তৃণমূলের আয় ৫৪৫ কোটি টাকা!

২০২১-২২ অর্থ বছরে তৃণমূলের অর্থভান্ডার তার আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৬৩৩ শতাংশ (৭৪.৪ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৫৪৫.৭৫ কোটি টাকা) বেড়েছে। আয়ের মাপকাঠিতে দেশে বিজেপির পরেই দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস। এই অর্থবর্ষে সাতটি রাজনৈতিক দল মোট ২১৭২ কোটি টাকা আয় করেছে অজানা উৎস থেকে। এর মধ্যে বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম-এর মতো দল রয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর) রাজনৈতিক দলগুলির আয়-ব্যয়ের হিসাব দিয়ে এই তথ্য প্রকাশ্যে এনেছে।

এতদিন আয়ের নিরিখে বিজেপির পরে দ্বিতীয় দল ছিল কংগ্রেস। প্রশ্ন হল, সর্বভারতীয় দল হিসাবে যে তৃণমূলের প্রায় কোনও অস্তিত্বই নেই, হঠাৎ তার এই বিপুল সম্পদবৃদ্ধি সম্ভব হল কী করে? তৃণমূলের এই আয়ের ৯৬ শতাংশেরও বেশি অর্থ এসেছে নির্বাচনী বন্ড থেকে। এর মানে, কর্পোরেট সংস্থা বা বড় প্রতিষ্ঠানের থেকেই তৃণমূলের আয়ের বেশিরভাগ অর্থ আসছে।

পুঁজিপতিদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলির লেনদেনের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ২০১৭ সালে চালু করেছে ‘নির্বাচনী বন্ড’ প্রকল্প। এ এমন এক ব্যবস্থা যাতে দেশের মানুষের কাছে নিজেদের পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রেখে পুঁজিমালিকরা পছন্দের রাজনৈতিক দলগুলির পিছনে বিপুল টাকা ঢেলে তাদের দিয়ে নিজেদের স্বার্থ পূরণের কাজগুলি করিয়ে নিতে পারে। অরুণ জেটলি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন নরেন্দ্র মোদি সরকার এই ব্যবস্থা চালু করেছিল। সেই সময় তৃণমূল কংগ্রেস নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থায় অস্বচ্ছতার অভিযোগ এনে বলেছিল, কোন কর্পোরেট সংস্থা কোন দলকে কত চাঁদা দিচ্ছে, তা তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় আনা হোক। কারণ এই ব্যবস্থার সবটাই গোপন। শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের আয়কর দফতর তা জানতে পারে। এখন তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রশ্ন ওঠায় দলের জাতীয় মুখপাত্র বলেছেন, আমরা চেয়েছিলাম নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচনী তহবিল তৈরি করে সরকারি অর্থে বিভিন্ন দল ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক। তা মানা হয়নি। কিন্তু নির্বাচনে খরচ মেটাতে সব দলেরই অর্থ প্রয়োজন। এখনও কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে পারে।’ এই স্বীকারোক্তি থেকে স্পষ্ট, এই ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নেই এবং অস্বচ্ছ পথেই তাঁদের এই বিপুল পরিমাণ অর্থ এসেছে। কিন্তু সত্যিই কি স্বচ্ছতা এই ব্যবস্থায় থাকা সম্ভব?

যথেষ্ট পরিকল্পনা করেই বিজেপি সরকার নির্বাচনী বন্ড চালুর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, অন্য দলগুলিও সেই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে। সরকারে থাকার সুবাদে দেশি-বিদেশি পুঁজিমালিকদের দেশের সম্পদ লুটে নেওয়ার অবাধ সুযোগ করে দেওয়ার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে মোটা টাকা ঘুষ নেওয়াই ছিল বিজেপির নির্বাচনী বন্ড চালুর উদ্দেশ্য। বন্ড চালু করে কারা তাদের পিছনে পুঁজি ঢালছে সে ব্যাপারে দেশের জনসাধারণকে বিজেপি নেতারা অন্ধকারে রাখতে চান। এইভাবেই পুঁজিপতিদের সীমাহীন লুট চালানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে দেশের উন্নয়নের নামে আসলে নিজেদের ‘উন্নয়ন’ ঘটিয়েছেন বিজেপি নেতারা। এ সবই চলছে গণতন্ত্রের নামে। এটাই সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আজকের চেহারা। একটি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৭-‘১৮ সালে দেশের প্রথম সারির পাঁচটি রাজনৈতিক দলের এক বছরের মোট আয়ের চার গুণ বেশি অর্থ একা বিজেপি সংগ্রহ করেছে। ওই বছরে বিজেপি মোট যত আর্থিক সাহায্য পেয়েছে, তার ৫৩ শতাংশেরই উৎস গোপন রেখেছে তারা। ২০১৭-‘১৮ সালে নির্বাচনী বন্ড থেকে বিজেপি পেয়েছিল ২১০ কোটি টাকা, যেখানে অন্য বড় দলগুলি মিলে পেয়েছিল ৫ কোটি টাকা। আর পাঁচ বছরের মাথায় ২০২১-২২-এ নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপির আয় পাঁচ গুণেরও বেশি– ১০৩৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। তৃণমূলের আয় ৫২৮ কোটি টাকা।

২০১৭ সালে নির্বাচনী বন্ড প্রকল্প চালু হওয়ার আগে কোম্পানি আইন অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলিকে অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ ছিল। এই প্রকল্পে নরেন্দ্র মোদিরা সেইসব বিধিনিষেধ তুলে দিয়ে অনুদানের পরিমাণ সীমাহীন করে দিয়েছেন। বিপুল পরিমাণ অর্থ রাজনৈতিক দলগুলিকে কারা দিচ্ছে, তার সবটাই দেশের মানুষের কাছ থেকে গোপন রাখার বন্দোবস্তও করে ফেলেছে তারা। এমনকি বন্ড-ক্রেতা সংস্থাগুলোকেও এই দানের কোনও রকম হিসাব রাখতে হয় না। অর্থাৎ আয়কর কর্তৃপক্ষ যাতে দাতা সংস্থাগুলিকে এ ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন করতে না পারে, সরকার তারও ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, ‘বৈদেশিক অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১০’ সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধিত এই আইন অনুযায়ী, ভারতে রেজিস্ট্রিকৃত বিদেশি কোম্পানিগুলি রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে যত খুশি টাকা দিতে পারে। স্বভাবতই ভোটসর্বস্ব সব দল এর সুযোগ নিতে উঠেপড়ে লেগেছে।

সম্প্রতি তৃণমূলের বিপুল আয়ের যে খবর প্রকাশ্যে এসেছে, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমেই তা এসেছে, নাকি নানা দুর্নীতির সাথে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা যে জড়িয়ে পড়েছেন, তারই বিপুল পরিমাণ অংশ এতে যোগ হয়েছে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।

নির্বাচনী বন্ড চালু হওয়ার সময় একমাত্র এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) এর বিরুদ্ধতা কর়েছিল। বলেছিল, মুখে জনগণের স্বার্থরক্ষার কথা বললেও আসলে এই সব দলগুলিই শেষ পর্যন্ত পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করে চলে। নির্বাচনী বন্ডই তার প্রমাণ। নির্বাচনী বন্ড আসলে পুঁজিপতি ও ভোটবাজ দলগুলির গোপন আঁতাত। জনস্বার্থ নিয়ে যে দল লড়ে তাদের নির্বাচনী খরচ জনগণই দেয়। আর পুঁজিপতি শ্রেণি, কর্পোরেটদের স্বার্থরক্ষাকারী বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূলের মতো জাতীয় ও আঞ্চলিক দলগুলি কর্পোরেটদের থেকে পাওয়া নির্বাচনী বন্ড ভাঙিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভোট কিনতে খরচ করে। ফলে নির্বাচন হয় অসম।

আর একটা কথা সেদিন এস ইউ সি আই (সি) দল বলেছিল, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বুর্জোয়ারা এই সব দলগুলিকে কার্যত কিনে নিয়ে নিজেদের গোলামে পরিণত করে। আজ এ কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে। এই গোপন ব্যবস্থার দ্বারা পুঁজিপতিরা তাদের পছন্দমতো রাজনৈতিক দলকে ‘পলিটিকাল ম্যানেজার’ হিসাবে সরকারি গদিতে বসিয়ে আর্থিক থেকে শুরু করে সমস্ত বিষয়েই নিজেদের স্বার্থপূরণকারী নীতি চালু করিয়ে নিচ্ছে। অন্য দিকে নির্বাচনে পুঁজিপতিদের দেওয়া এই টাকাই দলগুলি দেদার খরচ করে তাদের প্রচারে, জনগণের ভোট কিনতে।

আজ বিজেপির মতো তৃণমূল কংগ্রেসেরও দায়িত্ব তাদের এই বিপুল অর্থভান্ডারের উৎসের স্বচ্ছতার প্রমাণ দেওয়া। কর্পোরেট পুঁজিপতিদের ‘উন্নয়নকারী’ বিজেপি, তাদের কেন্দ্রীয় সরকার অবিলম্বে প্রকাশ্যে আনুক কোন দল কীভাবে টাকা তুলছে তার খতিয়ান। এটাই আজ জনসাধারণের দাবি।