প্রথমে ৫০ হাজার কোটি, পরে ২৯ হাজার কোটি– একের পর এক কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত বিজেপির পরমপ্রিয় শিল্পপতি গৌতম আদানি এবং অনিল আম্বানি গোষ্ঠী৷ অভিযোগ শুধু বিরোধী দলের নয়, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির অধীনস্থ খোদ রাজস্ব গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ (ডিআরআই) ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানি নিয়ে ২৯ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির কথা জানিয়েছে৷
২০১৪ সালের অক্টোবরে ডিআরআই কয়লা আমদানিতে বড় দুর্নীতির অভিযোগ করে৷ ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ ওই গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, ৪০টি সংস্থা সন্দেহের তালিকায়, এর মধ্যে রয়েছে আম্বানি ও আদানিদের সংস্থা৷ কয়লা আমদানিতে ২৯ হাজার কোটি টাকা, বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কারখানার যন্ত্রাংশ আমদানিতে ৯ হাজার কোটি টাকা এবং বিদ্যুৎ বিতরণে ১০ হাজার কোটি টাকা খরচ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে৷ এভাবে দুর্নীতির মধ্য দিয়ে আদানি গোষ্ঠী ৫০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে৷
২০১৭ সালের সেপ্টম্বরে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠনের দাবি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের খ্যাতনামা আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ ও অন্যান্যরা দিল্লি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন৷ কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে (!) চলতি বছরের ৯ মার্চ কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ রাজস্ব গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ আদালতকে জানায়, সিট দরকার নেই৷ কেন তদন্ত এড়ানোর চেষ্টা? বিদেশ থেকে ৭০ শতাংশ কয়লা আমদানি করে আদানির সংস্থা৷ সেই সংস্থা সিঙ্গাপুর আদালতে আবেদন করে, তদন্তের জন্য ভারত সরকার যে নথি চাইছে, তা যেন না দেওয়া হয়৷ কংগ্রেসের অভিযোগ, সিঙ্গাপুরের আইন দেখিয়ে সেই তথ্য দেওয়া হয়নি৷ এমনকী বিষয়টি নিয়ে ইডি–র তদন্ত ধামাচাপা দিয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার৷ শুধু তাই নয়, আদানির বিরুদ্ধে ইডি–র যে সব অফিসার প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সিবিআইকে পর্যন্ত কাজে লাগানো হয়েছে বলে অভিযোগ৷ ফলে মোদি সরকার যে আদানির কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দিতে তদন্ত চাইছে না, তা পরিষ্কার৷
এই কয়লা কেলেঙ্কারি শুরু কংগ্রেস শাসনে৷ ২০১২ সালে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে কয়লা কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছিল, এতে রাজস্ব বাবদ সরকারের ক্ষতি হয়েছিল ১ লক্ষ ৮৬ হাজার কোটি টাকা৷ ক্যাগের রিপোর্ট ছিল, নানা বেসরকারি ও সরকারি দপ্তরকে ১৯৪টি কয়লা ব্লক বেচার ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে৷ সেই সময় সিবিআই তদন্তের দাবি উঠেছিল৷ সিবিআই তদন্তে কংগ্রেস কয়লা কেলেঙ্কারিতে দোষী সাব্যস্ত হয়৷
কয়লা ব্লক দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কংগ্রেস ২০১৩ সালে সিবিআই তদন্তের রিপোর্টকে পর্যন্ত পাল্টে দিয়েছিল৷ অন্যান্য নানা বহুজাতিক কোম্পানি ছাড়াও জিন্দাল, এসার গ্রুপ ও লক্ষ্মী মিত্তালদের কয়লা ব্লক বেচে দিয়েছিল কংগ্রেস৷ কয়লার সরাসরি ব্যবহার হয় যে শিল্পে (ক্যাপটিভ প্রয়োজনে), তা ছাড়াও বহু ব্লক কিনে তা থেকে কয়লা উত্তোলন করে বিপুল দামে খোলা বাজারে বিক্রি করে বিপুল লাভ করেছে তারা৷ আজ কংগ্রেস হইচই করলেও সে ইতিহাস দেশের মানুষ ভুলে যায়নি৷
আদানি প্রমুখ শিল্পপতিরা কয়লা উৎপাদনের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ব্যবসাতেও বড় লগ্নি করেছে৷ তারা কয়লার উৎপাদন ব্যয় বহুগুণ বাড়িয়ে দেখায়, তার ভিত্তিতেই কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিদ্যুতের দাম ঠিক করে৷ ফলে বিদ্যুৎ মাশুলের বোঝা বেড়ে চলছে সাধারণ মানুষের উপর৷ আর শিল্পপতি গোষ্ঠীর লাভের বিপুল পরিমাণ টাকা চলে যাচ্ছে কর ফাঁকি দেওয়ার স্বর্গরাজ্য মরিশাসে৷ নানা ভুয়ো সংস্থার হাত ঘুরে সেই টাকা মরিশাসে গৌতম আদানির দাদা বিনোদ আদানির মালিকানাধীন একটি ট্রাস্টের সিন্দুকে জমা হয়েছে এমন অভিযোগ উঠছে৷ এই বিনোদ আদানির নাম বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা সংক্রান্ত পানামা নথিতেও ছিল৷ প্রধানমন্ত্রীর পদে বসে মোদিজি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘তোপ’দেগে বলেছিলেন, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা৷’ মানুষ দেখছে নরেন্দ্র মোদি তাঁর প্রিয় শিল্পপতিদের দুর্নীতির মাখন খেতেই সাহায্য করছেন৷
একে তো হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি, তার পরেও চলছে কর ফাঁকি৷ কংগ্রেসের ধারাবাহিকতায় বিজেপি একচেটিয়া পুঁজিপতিদের দেদার লুঠতরাজের সুযোগ করে দিচ্ছে, তাদের হাজার হাজার কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণ মকুব করে দিচ্ছে৷ এভাবেই ললিত মোদি থেকে শুরু করে বিজয় মাল্য, নীরব মোদি, মেহুল চোকসি, আম্বানি, আদানিরা বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে সম্পদের পাহাড় বাড়িয়ে চলেছে৷ বিশ্বের সম্পদশালীদের তালিকার শীর্ষে উঠছেন আম্বানি–আদানিরা৷ আর আর্শীবাদধন্য হচ্ছে তাদের মদতদাতা বিজেপি–কংগ্রেস৷ অন্যদিকে বিপুল ক্ষতি হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষের৷ তাদের বাড়তি মাশুল গুনতে হচ্ছে৷ এমনিতেই বিপুল মূল্যবৃদ্ধি, বেকারিতে মানুষ জেরবার, তার উপর বাড়তি বিদ্যুৎ মাশুল তাদের জীবনের সংকটকে আরও জোরালো করে তুলছে৷ ক্রয়ক্ষমতা কমছে দিনের পর দিন৷ স্বভাবতই বাজার সংকটে জর্জরিত পুঁজিপতিরা দেশের নানা প্রাকৃতিক সম্পদ জল–জমি–খনি সমস্ত কিছুতে অবাধ লুঠপাঠ চালিয়ে মুনাফার ধারা অব্যাহত রাখার মরিয়া চেষ্টা করে যাচ্ছে৷ আর তাদের রাজনৈতিক ম্যানেজার বিজেপি ‘দোস্ত’ শিল্পপতিদের মুনাফার পথকে নিষ্কণ্টক করছে৷
(৭১ বর্ষ ৭ সংখ্যা ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)