Breaking News

ওষুধের দাম ৫০ শতাংশ বাড়াল কেন্দ্রীয় সরকার, পুঁজিপতিদের পৌষমাস, জনগণের সর্বনাশ

ফাইল ফটো

এ বছর এপ্রিলে প্যারাসিটামল সহ ৮০০টি ওষুধের দাম বাড়ার পর অক্টোবরে আবার ৫০ শতাংশ হারে বাড়ছে ৮টি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম। চমকে ওঠার মতো বিষয়। ওষুধ তো আলু-পটল নয় যে, একটার দাম বাড়লে আরেকটা দিয়ে চালানো যাবে। এর সাথে মানুষের বাঁচা-মরা জড়িয়ে রয়েছে। এই ভয়ঙ্কর মূল্যবৃদ্ধির বাজারে একটা কথা মানুষের মুখে মুখে প্রায়ই ঘোরে– খাবার না খেলেও হবে, কিন্তু যে করেই হোক ওষুধ তো খেতে হবে। আগুন দামের জন্য অন্যান্য খাবার কিনতে না পারলেও ওষুধ কিনে খেতে বাধ্য হন মানুষ। এই যখন অবস্থা তখন কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিকাল প্রাইসিং অথরিটি বা এনপিপিএ-কে অনুমোদন দিয়েছে ওষুধের দাম বিপুল হারে বাড়ানোর জন্য।

এমন অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধির কারণ কী? কোম্পানিগুলির যুক্তি, ওষুধ তৈরির কাঁচামালের দাম অত্যন্ত বেড়েছে, ফলে তৈরির খরচ বেড়েছে। এই ওষুধগুলি যাতে বাজার থেকে উধাও হয়ে না যায়, তাই× বৃহত্তর স্বার্থের দিকে তাকিয়েই নাকি দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত! সে জন্য অ্যাজমা, গ্লুকোমা, থ্যালাসেমিয়া, যক্ষ্মা ও মানসিক অসুখের ওষুধ সহ অন্যান্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম ৫০ শতাংশ বাড়ানার সিদ্ধান্ত। স্বভাবতই এর মাশুল গুনতে হবে জনসাধারণকে।

এই দামবৃদ্ধির আক্রমণ থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচানোর জন্য সরকারের কি কিছুই করার ছিল না? সরকার কি খতিয়ে দেখেছে– এই দামবৃদ্ধির সত্যই প্রয়োজনীয় ছিল কি না। যদি তা-ই হয় তবে কাঁচামালের দামবৃদ্ধি জনিত উৎপাদন ব্যয়বৃদ্ধি কি সরকার জনস্বার্থে ভর্তুকি দিয়ে সামাল দিতে পারত না? সরকার তো পুঁজিপতিদের কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়। ব্যাঙ্ক থেকে পুঁজিপতিরা ঋণ নিয়ে শোধ না করলে সরকার তা শোধ করে। এসব ক্ষেত্রে তো সরকারের টাকার অভাব হয় না। দেশের জনগণের চিকিৎসার কথা ভেবে এই ভর্তুকি দেওয়া জরুরি ছিল।

দেশের ২৪ কোটি মানুষ অতি দারিদ্রে ডুবে রয়েছেন। ওষুধের এই ব্যাপক দামবৃদ্ধিতে তাদের উপর কি আরও ভারি বোঝা চাপবে না? সমাজের বড় একটা অংশ কি চিকিৎসার সুযোগের বাইরে চলে যাবে না? দেশে দু’রকমের ওষুধের তালিকা রয়েছে। প্রয়োজনীয় ওষুধ বা শিডিউলড ড্রাগস ও নন-শিডিউলড ড্রাগস। সরকার থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম বেঁধে দেওয়া হয় প্রতি বছর। তার পরও সেগুলির দাম বেড়ে চলেছে। আর নন-শিডিউলড ওষুধের দাম তো ওষুধ কোম্পানিগুলি সরকারের অনুমতি নিয়ে ইচ্ছামতো নির্ধারণ করে। বিশ্বের ২০ শতাংশ জেনেরিক ওষুধ ভারত থেকে নানা দেশে রপ্তানি হওয়ার জন্য ভারতকে বিশ্বের ফার্মেসি বলা হয়। তা হলে সেই দেশের মানুষের জন্য ওষুধ-সঙ্কটের অজুহাত দেওয়া হচ্ছে কেন? বিপুল দামবৃদ্ধি করে কর্পোরেট কোম্পানিগুলির মুনাফা আরও আকাশচুম্বী করাই কি এর উদ্দেশ্য নয়?

কাঁচামালের দাম কিছু বাড়ার জন্য কি ওষুধ কোম্পানিগুলির লোকসান হচ্ছে? তথ্য দেখাচ্ছে, ওষুধ কোম্পানিগুলির লাভ বেড়েই চলেছে উত্তরোত্তর। রেড্ডি ল্যাবরেটরিজ, সিপলা, সান ফার্মা, অরবিন্দ ফার্মা, ডিভিজ ল্যাবরেটরি, অ্যালকেম, ম্যানকাইন্ড, গ্লেনমার্ক, অ্যাবট, টরেন্ট ফার্মাসিউটিক্যালের মতো বড় ওষুধ কোম্পানিগুলি লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা মুনাফা করছে। শুধু এ বছরই রেড্ডি ল্যাবরেটরিজ লাভ করেছে ২৬০০ কোটি টাকা, সিপলা ২৪০০ কোটি টাকা, সান ফার্মা ১৬০০ কোটি টাকা। তাদের লাভের অঙ্ক এতটাই বিপুল যে দেশের শীর্ষস্থানীয় পুঁজি মালিকদের মধ্যে বেশ উপরের দিকে রয়েছে এই ওষুধ কোম্পানিগুলি। তা সত্ত্বেও ক্ষতির অজুহাত মানছে কেন সরকার? ২০২৪-এ ৯৪৫ কোটি টাকার বন্ড বিজেপি সহ নানা রাজ্যের শাসক দলকে দিয়েছিল ৩৫টি ওষুধ কোম্পানি। এর মধ্যে বিজেপির ভাণ্ডারে গিয়েছে ৩৯৩.৯৫ কোটি, বিআরএস-এর ৩২৮.৫ কোটি, কংগ্রেসের ১১৫.৪৫ কোটি। বাকিটা গিয়েছে টিডিপি সহ নানা রাজ্যের শাসক দলের ভাণ্ডারে। কোনও কোনও ওষুধ কোম্পানি নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন করার জরিমানা স্বরূপ শাসক দলকে নির্বাচনী বন্ড দিয়ে ছাড় পেয়েছে।

শাসক দল ও সরকারের সাথে ওষুধ কোম্পানিগুলির যোগসাজশ কত গভীর তা বোঝা যায় আরেকটি ঘটনায়। দিল্লির আবগারি দুর্নীতি মামলায় ২০২২-এ অরবিন্দ ফার্মার মালিক পি শরৎ রেড্ডি গ্রেপ্তার হওয়ার ৫ দিনের মধ্যেই বিজেপির ভাণ্ডারে ৫ কোটি টাকা ভেট দেয় তাঁর সংস্থা। ছাড়া পেতে সংস্থার মোট অনুদানের ৫৭ শতাংশ দেয় বিজেপিকে। ফলে সহজেই ওষুধের বিপুল দামবৃদ্ধির অবাধ সরকারি ছাড়পত্রের কারণটা পরিষ্কার হয়ে যায়।

বুর্জোয়া এই ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যকে পণ্য হিসাবে দেখা হয়, পরিষেবা হিসাবে নয়। এই ব্যবস্থার রক্ষক শাসক দলগুলি পুঁজিপতি শ্রেণির সেবক হিসাবে সব রকম নীতি নির্ধারণ করে। স্বাস্থ্যনীতি, ওষুধ নীতিও সেভাবেই নির্ধারিত হয়। তারা বহুজাতিক ওষুধ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে বিকিয়ে দেয়। এদের দাক্ষিণ্যে ভোটে বিপুল ব্যয় করে ক্ষমতাপিপাসু দলগুলি। শাসক দলের ভাণ্ডারে উপচানো নির্বাচনী বন্ড তার জ্বলন্ত উদাহরণ। সে জন্যই জনস্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ ক্রমশ কমিয়ে পুঁজিমালিকদের সেবায় নিজেকে উজাড় করে দেওয়াই আজ সরকারগুলোর একমাত্র ‘কর্তব্য’। আর এই কর্তব্যপালনে সবাইকে ছাপিয়ে গেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার।