বিদ্যুৎ ছাড়া নাগরিক জীবন অচল। অথচ লোকসভার ভোটে এই বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে কেন্দ্র বা রাজ্যের সরকারকে বিশেষ কিছু বলতে শোনা যাচ্ছে না। বিরোধী দলগুলির মধ্যে একমাত্র এস ইউ সি আই (সি) ছাড়া অন্যরাও জনজীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে একেবারেই নীরব। জনবিরোধী বিদ্যুৎ আইন ২০০৩ এবং তার সংশোধনী বিল ২০২২ এনে মোদি সরকার বিদ্যুৎ শিল্পের সার্বিক বেসরকারিকরণ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ, বিদ্যুৎ বিল, খারাপ মিটার পরিবর্তন ইত্যাদি পরিষেবা নিয়ে অভিযোগ, সর্বোপরি বিদ্যুতের মাশুল নির্ধারণ, সরকারি ভর্তুকি এ সবের নিষ্পত্তির যতটুকু অধিকার রাজ্য সরকারের এখনও আছে তার সমস্তটা কেন্দ্রীয়ভাবে কুক্ষিগত করার জন্য ‘ইলেকট্রিসিটি কনট্রাক্ট এনফোর্সমেন্ট অথরিটি’ নামের একটি সংস্থা তৈরি করছে বিজেপি সরকার। ফলে আরও এক ধাপ বিদ্যুৎ মাশুল বাড়বে। এই সংশোধনী আইনে পরিণত হলে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন এই ‘অথরিটি’ (ইসিইএ) বিদ্যুতের ক্রয়, বিক্রয় ও সঞ্চালন প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণের অধিকারী হবে। রাজ্য সরকার ও রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের ক্ষমতা এবং ‘ওমবাডসম্যান’-এর মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও কোম্পানির নানা অন্যায়ের প্রতিকারে গ্রাহকদের সব সুযোগ কেড়ে নেওয়া হবে।
সমস্ত তথাকথিত ক্রস সাবসিডি তুলে দিয়ে সকলের মাশুল সমান করা হবে। এতে সাধারণ গ্রাহকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ, পরিকাঠামো তৈরিতে মোট ব্যয়ের ৯০ শতাংশ হয় পুঁজিপতিদের শিল্প-কারখানার জন্য বিদ্যুৎ পৌঁছাতে। ক্রস সাবসিডি তুলে দিলে সেই বৃহৎ শিল্পপতিদের মাশুল কমবে, আর গৃহস্থ, ক্ষুদ্রশিল্প, ক্ষুদ্রব্যবসা ও কৃষিতে বিদ্যুৎ মাশুল ব্যাপক বাড়বে।
ভোটের প্রচারে বিজেপি এই বিষয়গুলি গোপন রাখছে। এই সর্বনাশা বিদ্যুৎ নীতির বিরুদ্ধে এস ইউ সি আই (সি) তীব্র প্রতিবাদ করে চলেছে। আন্দোলনের ফলে চাপে পড়ে কেন্দ্রীয় সরকার ধূর্ততার সাথে বলেছে, যদি কোনও সরকার গ্রাহকদের কিছু ভর্তুকি দিতে চায় তবে তা সরাসরি বিদ্যুৎ গ্রাহকদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দেবে। এ কথার অর্থ– আগে বিশাল অঙ্কের পুরো বিলটাই মেটাতে হবে। তারপরে সামান্য ভর্তুকির প্রশ্ন। রান্নার গ্যাসে সরকার কীরকম ভর্তুকি দেয় (!) তা সকলের জানা। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটবে।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আরেকটা কৌশল হল, বিদ্যুৎ বন্টন সংস্থা (ডব্লিউবিএসইডিসিএল /সিইএসসি ইত্যাদি) গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে নতুন করে ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়োগ করবে, যাদের লাইসেন্স দরকার হবে না। তাদের মুনাফার জন্য আরও এক দফা বিদ্যুতের মাসুল বাড়বে। শুধু তাই নয়, লাইসেন্সবিহীন ফ্র্যাঞ্চাইজির মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিল, মিটার, লাইন মেরামত, ট্রান্সফরমার মেরামত ও প্রতিস্থাপন, নতুন লাইন নেওয়া, নিরাপত্তা ইত্যাদির সমাধানে গ্রাহক হয়রানি ও অর্থ ব্যয় প্রবলভাবে বৃদ্ধি পাবে।
এই সংশোধনীতে ‘ক্রস-বর্ডার ট্রেড’-র নামে বিদ্যুতে বৈদেশিক বাণিজ্যের (আমদানি-রপ্তানি) ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অর্থাৎ দেশের মানুষের প্রয়োজন না মেটাতে পারলেও বিদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে পারবে।
মোদি সরকারের এই বিদ্যুৎ নীতি পুরোপুরি জনস্বার্থ বিরোধী এবং পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষাকারী। দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনেরও অন্যতম দাবি ছিল এই বিদ্যুৎ বিল বাতিল করতে হবে। তার সাথে বিদ্যুৎ শিল্পে কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মচারীদের যৌথ প্রতিবাদ এবং এসইউসিআই(সি) উদ্যোগে রাজ্যে রাজ্যে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের সংগঠিত আন্দোলনের চাপে এই বিল সংসদে পেশ করেও পিছু হটেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। আন্দোলনের এ এক বিরাট জয়। কিন্তু মোদি সরকার এই সর্বনাশা নীতি বাতিল করেনি। শেষ পর্যন্ত রিভ্যাম্পড ডিসট্রিবিউশন সেক্টর স্কিম, ইলেকট্রিসিটি রুল২০২২, ২০২৩ করে স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার (যা কিনা বিদ্যুৎ গ্রাহকদের টাকা লুট করার যন্ত্র), টিওডি সিস্টেম বিল ও ডাইনামিক প্রাইসিং পদ্ধতি চালু করার হুলিয়া জারি করেছে। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে হাই টেনশন বিদ্যুৎ গ্রাহকদের (বাল্ক কনজিউমার) রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানির বদলে বিদ্যুৎ পরিবহণ (ট্রান্সমিশন) কোম্পানির সাথে যুক্ত করতে হবে। ফলে বণ্টন কোম্পানি যথেচ্ছ দাম বাড়ালে তার ধাক্কা সামলাবে শুধু গৃহস্থ ও অন্যান্য ক্ষুদ্র বা মাঝারি বিদ্যুৎ গ্রাহকরা। এইসব পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে সরকারি বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানিকে একচেটিয়া কর্পোরেট হাউসের হাতে তুলে দেওয়ার রাস্তা পরিষ্কার করা হচ্ছে।
সংবিধানে ‘বিদ্যুৎ’ কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ তালিকাভুক্ত। ফলে চাইলেই রাজ্য সরকার এই নীতি না মেনে তার বিরোধিতা করতে পারত।কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যুতের মাশুল ৫০ শতাংশ কমানোর বাস্তব পরিস্থিতি থাকলেও মাশুল কমানোর দাবির মান্যতা দেওয়া হচ্ছে না, স্মার্ট মিটার বসানো হচ্ছে। রাজ্যের বিদ্যুৎ গ্রাহকদের একমাত্র সংগঠন অ্যাবেকার লাগাতার আন্দোলনের চাপে মাশুল বাড়াতে পারেনি সরকার। কিন্তু অন্য ভাবে রাজ্যের গ্রাহকদের উপর ফিক্সড চার্জ দ্বিগুণ, মিনিমাম চার্জ তিনগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ক্ষুদ্রশিল্পে ও কৃষিতে কোনও মিনিমাম চার্জ ছিল না, প্রতি মাসে প্রতি কেভিএ-তে ক্ষুদ্রশিল্পে ২০০ টাকা এবং কৃষিতে ৭৫ টাকা নতুন করে চাপানো হচ্ছে। এতে প্রতিটি পরিবারে আর্থিক চাপ বাড়ছে। ভোটে ওরা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বলছে, কিন্তু গ্রাহকদের পকেট ফাঁকা করার স্থায়ী ব্যবস্থা যে হয়েছে তা গোপন করছে।
কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি সহ সংসদীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতোই বর্তমান রাজ্য সরকারি দল তৃণমূল কংগ্রেস, একচেটিয়া পুঁজিপতি গোয়েঙ্কার মালিকানাধীন বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে নির্বাচনী বন্ডে ৪৪৪ কোটি টাকা নিয়েছে। শুধু হলদিয়া এনার্জি থেকেই নিয়েছে ২৮১ কোটি টাকা। একচেটিয়া কর্পোরেট হাউসের সেবাদাস সরকারগুলো তাদের সেবাও করেছে দু’হাত ভরে। মহারাষ্টে্র এখন বিজেপি জোট ক্ষমতায়, মোদিজির ভাষায় যাকে বলে ডবল ইঞ্জিন সরকার। সে রাজ্যের বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ২০২৪-২৫ বর্ষের জন্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানি টাটা পাওয়ারের মাশুল ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। অথচ টাটা পাওয়ার ১২ শতাংশ মাশুল বৃদ্ধির দাবি করেছিল। (সূত্র- মহারাষ্ট্র বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের ২০২৪-২৫ বর্ষের ট্যারিফ অর্ডার)। কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর, পুদুচেরি, চণ্ডীগড়ের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এবং উত্তরপ্রদেশের সরকার তাদের পূর্বাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ নিগম বেসরকারিকরণ করার উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু দেশ জুড়ে প্রবল প্রতিরোধে সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ওই আন্দোলনের জন্য বিদ্যুৎ শিল্পে কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মচারীদের উপর ব্যাপক আক্রমণ নেমে এসেছিল।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের (পিডিসিএল) থেকে অনেক কম দামে বিদ্যুৎ পাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সেখান থেকে না নিয়ে হলদিয়া এনার্জি থেকেই কয়েক গুণ বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার হিসাব দেখিয়ে বারবার বিদ্যুতের মাশুল বাড়ানোর আবেদন জানিয়েছে গোয়েঙ্কার মালিকানাধীন সিইএসসি, যা বিদ্যুৎ আইন-২০০৩ বিরোধী। বিদ্যুৎ গ্রাহক সংগঠন অ্যাবেকা প্রতিবারই ওই অযৌক্তিক হিসাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং পিডিসিএল-এর থেকে বিদ্যুৎ কেনার দাবি জানিয়েছে।
২০১৬-১৭ থেকে দেশীয় কয়লার দাম ৪০ শতাংশ কমেছে, কয়লার উপর জিএসটি ৭ শতাংশ কমেছে, কোম্পানির কারিগরি ও বাণিজ্যিক ক্ষতি (টিসি লস) ২ শতাংশ কম হওয়াতে বিদ্যুতের মাশুল ৫০ শতাংশ কমানো যায়। গ্রাহক সংগঠন অ্যাবেকাও এই দাবি করেছে। কিন্তু রাজ্য সরকার তা কমাচ্ছে না। রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানি (এসইডিসিএল)-র বিদ্যুতের দাম কমালে পাছে সিইএসসি-র দাম কমাতে হয়, তাই এসইডিসিএল-র বিদ্যুতের মাশুলও কমানো হয়নি। অর্থাৎ সরকার জনগণকে কম দামে বিদ্যুৎ দিতে পারলেও দিচ্ছে না গোয়েঙ্কার স্বার্থে। রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির ২০১৬-১৭ বর্ষে গড় দাম ছিল ইউনিট প্রতি ৭ টাকা ১২ পয়সা, সিইএসসি-র ছিল ৭ টাকা ৩১ পয়সা। বর্তমান বর্ষেও বিদ্যুতের গড় দাম একই আছে, এক পয়সাও কমানো হয়নি। উপরন্তু ব্যাপক মিনিমাম চার্জ ও ফিক্সড চার্জ বাড়ানো হয়েছে যার ফলে রাজ্যের ক্ষুদ্রশিল্প ও ক্ষুদ্রকৃষি বিপদাপন্ন। গৃহস্থ গ্রামীণ ক্যাটাগরির ৩০০ ইউনিট স্ল্যাবে ১৮ পয়সা দাম বাড়ানো হয়েছে। বাণিজ্যিক গ্রামীণ ক্যাটাগরি তুলে দেওয়ার ফলে তাদের প্রথম দুটো স্ল্যাবে ২ পয়সা করে বেশি দিতে হবে।
সাধারণ বিদ্যুৎ গ্রাহকদের ঘাড় মটকে দুটো কোম্পানিরই বিগত সাত বছর ধরে বিপুল মুনাফা করছে। প্রতি বছরই কোম্পানির আইনসম্মত সাড়ে ষোল শতাংশ মুনাফা ছাড়াও শত শত কোটি টাকা অতিরিক্ত সাশ্রয় হয়েছে। ওই টাকাতেই বন্টন কোম্পানির আমলা ও সরকারের মন্ত্রীদের বিলাস বাড়ছে। বন্টন কোম্পানির বিলাসবহুল অফিস হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ টাকা মাসিক ভাড়ায় বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের অফিসের আয়তন অপ্রয়োজনীয় ভাবে বাড়ছে। গোয়েঙ্কা শত শত কোটি টাকা নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজ্য সরকারি দলকে দিয়েছে, আবার বিজেপিকেও দিয়েছে। অথচ এই লাভের টাকায় গ্রাহকদের একটু ভাল পরিষেবা দেওয়ার পরিকাঠামো তৈরি, কিংবা তাদের আর্থিক সুরাহা দেওয়ার কোনও সদিচ্ছা সরকারের নেই। রাজ্যের বিদ্যুৎ গ্রাহকদের দাবি– রাজ্যের এই দুটি বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির অ্যাকাউন্ট সিএজি-কে দিয়ে তদন্ত করে তার রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হোক। কিন্তু রাজ্য সরকার তা করছে না। পূর্বতন সিপিএম পরিচালিত রাজ্য সরকারও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত জনবিরোধী নীতি নিয়েছিল। আজ তাদের কথাও মানুষ বিশ্বাস করছে না। কর্পোরেট স্বার্থবাহী বিদ্যুৎনীতি রুখতে হলে আন্দোলন ছাড়া বিকল্প কোনও রাস্তা নেই। এই আন্দোলনেরই নির্ভরযোগ্য শক্তি এস ইউ সি আই (সি)। এদেরকে ভোট দিলে গণআন্দোলনই শক্তিশালী হবে। জয়ী করলে পার্লামেন্টের ভেতরে জনবিরোধী নীতি আটকে দেওয়া যাবে।