Breaking News

ওয়াকফ সংশোধনী নিয়ে বিজেপি এত উৎসাহী কেন?

লোকসভায় ওয়াকফ সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনের সংশোধনী নিয়ে বেশ হইচই করেছে বিজেপি। তাদের ভাবখানা হল, ওয়াকফ সম্পদের বিলি-ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে দুর্নীতি দূর করার জন্যই নাকি এই সংশোধনী! সত্যিই কি তাদের উদ্দেশ্য তাই? একটু খতিয়ে দেখা দরকার।

ভারতে বহু ধর্মের মানুষের বাস। এখানে হিন্দু, মুসলমান, জৈন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ছাড়াও আরও নানা ধর্মীয় গোষ্ঠী আছে। সুতরাং ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনে সংশোধনী আনলে তা যে বেশ সংবেদনশীল তা মনে রাখা দরকার। এই কারণে এ বিষয়ে বিচার করতে গেলে সমস্তরকম বিদ্বেষপ্রসূত মানসিকতা ও ধর্মীয় সংস্কার থেকে মুক্ত হতে হবে।

ওয়াকফ মূলত মুসলিম ধর্মীয় নিয়মকানুনের ভিত্তিতে তৈরি একটি আইনসম্মত ব্যবস্থা, যার সাহায্যে ধর্মীয় বা সেবামূলক যে কোনও কাজে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি দান করা যায়। যাঁরা ওয়াকফে দান করেন তাঁদের বলা হয় ওয়াকিফ। এই সম্পত্তি থেকে যা আয় তা সাধারণের উপকারের জন্য ব্যয় করা হয়। ওয়াকফ হিসাবে ঘোষিত সম্পদ ফেরৎ বা বিক্রয়যোগ্য নয়। এই সম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রেও হস্তান্তর করা যায় না। প্রসঙ্গত, ওয়াকফের সম্পদ মুসলমান, অমুসলমান– অর্থাৎ ধর্ম নির্বিশেষে গরিবদের জন্যই ব্যয় করা হয়ে থাকে।

১৯২৩ সালের মুসলমান ওয়াকফ আইন থেকে শুরু করে স্বাধীন ভারতেও কয়েকবার ওয়াকফ আইন সংশোধন হয়েছে। অবশেষে ১৯৯৫ সালে আনা আইন অনুযায়ী বর্তমান ব্যবস্থা চলছে। কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল এবং রাজ্যভিত্তিক ৩০টি কাউন্সিল এই সম্পত্তির তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছে। মুসলিম ধর্মীয় আইনে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নির্বাচিত হয় ওয়াকফ বোর্ড। এর নিয়ন্ত্রণ এবং যথাযথ হিসাব রাখার দায়িত্বও তাঁদেরই। ওয়াকফ সংক্রান্ত বিচারের জন্য নিযুক্ত হয় সিভিল আদালতের সমান ক্ষমতা সম্পন্ন ওয়াকফ ট্রাইবুনাল। এর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অ্যাপিল করা যায় না। যদিও সরাসরি হাইকোর্ট এই সংক্রান্ত বিচার গ্রহণ করতে পারে। এর চেয়ারম্যান হন মুসলিম আইন সংক্রান্ত জ্ঞান সম্পন্ন একজন রাজ্য সিভিল সার্ভিসের অফিসার। বিচারপতি শাশ্বত কুমারের নেতৃত্বে নিযুক্ত কমিটি ২০১১-তে বলেছিল ওয়াকফ সম্পত্তির আওতায় থাকা জমির মোট মূল্য ১ লক্ষ ২ হাজার কোটি টাকা, যা থেকে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা আয় হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে মাত্র ১৬৩ কোটি টাকা আয় পাওয়া যাচ্ছে।

এই পর্যবেক্ষণকে হাতিয়ার করে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ওয়াকফ ব্যবস্থাকে কেন্দ্রীয় সরকার এবং আমলাদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ২০২৪-এর ৮ আগস্ট লোকসভায় ওয়াকফ সংশোধনী বিল আনে। এই সংশোধনীতে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলে অমুসলিম সদস্যরাও থাকবেন। বোর্ডের স্বশাসিত চরিত্রের বদলে এর সার্ভে কমিশনারের জায়গা নেবেন জেলাশাসক। তিনিই যে কোনও ওয়াকফ সম্পত্তিকে এর তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। কোনও ওয়াকফ সম্পত্তিকে সরকারি সম্পত্তি বলে মনে করলে জেলাশাসক সরাসরি তা ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিতে পারবেন। ট্রাইবুনালের সিদ্ধান্ত আর চূড়ান্ত থাকবে না। ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান অমুসলিম হতে পারবেন, এমনকি মুসলিম আইনে তাঁর জ্ঞান না থাকলেও চলবে। অমুসলিম এবং অন্তত পাঁচ বছর আগে যাঁরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি, তাঁদের দান ওয়াকফ হিসাবে গ্রাহ্য হবে না। একমাত্র সম্পত্তির মালিকরাই তা ওয়াকফে দান করতে পারবেন, ব্যবহারকারী বা দীর্ঘদিনের দখলি সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি ওয়াকফে দান করা যাবে না।

এই সংশোধনী নিয়ে মুসলিম সমাজের বড় অংশ আশঙ্কায় ভুগছেন। কারণ অমুসলিম এবং এই ধর্মের রীতি, আইন ইত্যাদি কিছুই না জেনেও কেউ মুসলিম ধর্ম বিষয়ক একটি বোর্ডের কর্তা হয়ে যেতে পারেন! দীর্ঘ বছর ধরে ওয়াকফ হিসাবে ব্যবহৃত জমিতে গড়ে ওঠা মসজিদ, কবরস্থান, স্কুল, হাসপাতাল, দোকান ইত্যাদির জমিও ওয়াকফ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চলে যাচ্ছে জেলাশাসকের হাতে। দান-করা, খয়রাতি সাহায্য করার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার– সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠান তৈরি ও পরিচালনা করার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে এর পিছনে বিজেপি সরকারের বিশেষ মতলব আছে।

যদিও দেশের সাধারণ মানুষের সামনে একটু উদার সাজতে বিলটিকে খুঁটিয়ে বিচার করার কথা বলে ৩১ জন সদস্যের যৌথ সংসদীয় কমিটি বা জেপিসিতে এটিকে পাঠায় বিজেপি সরকার। এই কমিটির নেতৃত্বে অবশ্য আছেন বিজেপিরই সাংসদ জগদম্বিকা পাল। গায়ের জোরে নিজেদের বক্তব্য পাশ করিয়ে নিতে বিজেপি সাংসদরা কার্যত মরিয়া চেষ্টা করে চলেছেন। যদিও বিরোধীদের প্রবল বিরোধিতার সামনে সরকার নতি স্বীকার করে জেপিসি-র মেয়াদ বাড়িয়ে আলোচনার সুযোগ দিতে রাজি হয়। ঠিক হয় ২০২৫-এর বাজেট অধিবেশনের শেষ দিনে বিলটি তোলা হবে।

এ দেশে ওয়াকফ আইনই কিন্তু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও তার সম্পত্তি সংক্রান্ত একমাত্র আইন নয়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময় থেকেই মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির মন্দির সংক্রান্ত আইন, পরবর্তীকালে গুরুদ্বার, গির্জা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত আইন এসেছে। স্বাধীন ভারতেও হিন্দুদের দেবত্র সম্পত্তির আইন আছে, যেখানে দেবতার মূর্তি সম্পত্তির মালিক বলে গণ্য হয়। ভারতীয় ট্রাস্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী মন্দির পরিচালনার আইনি ব্যবস্থাও আছে যে ধর্ম সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে ট্রাস্ট বা বোর্ড ইত্যাদি হয়, তার সমস্ত সদস্য সেই ধর্মেরই লোক হন। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন ওয়াকফ সংশোধনী বিলে বলা হচ্ছে, ওয়াকফগুলি স্থায়ী ইসলামি ধর্মীয় সংস্থা ও শরিয়তি আইনের রীতিতে গঠিত হলেও তার সদস্য থাকতে পারবেন অন্য ধর্মের অনুগামী কোনও আমলা!

সাধারণত যাঁরা ধর্মীয় সূত্রে এই সব সংস্থার অংশীদার তাঁরাই এর নীতি ও কর্মপন্থা স্থির করেন। সেটাই কাম্য। কিন্তু এ দেশে কোনও সরকার এবং তার পরিচালক রাজনৈতিক দল এই সংস্থাগুলির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা ও তাদের নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানোর সুযোগ ছাড়ে না। এর মধ্যে বহু দুর্নীতিও যুক্ত হয়ে থাকে।

কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত বিচারপতি সাচার কমিশন ২০০৬ সালে মুসলমান জনগণের বাস্তব অবস্থার সমীক্ষা করে একটা রিপোর্ট পেশ করে। তারা দেখায়, মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অপুষ্টি, অশিক্ষা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। কর্মসংস্থানেও তারা অনেক পিছিয়ে আছে। স্বনিযুক্তি প্রকল্পের ঋণেও তারা পিছিয়ে। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার সুযোগ সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত। ঘরে ঘরে শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগে। ওজন গড়পড়তা মানের অনেক কম থাকে। শহরাঞ্চলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাদের বসবাস করতে হয়। মেহনতি গরিব মুসলমান জনগণের দুর্দশা দূর করতে কমিশন প্রস্তাব করে ওয়াকফ বোর্ডগুলিকে আরও ক্ষমতা দেওয়া দরকার, সে কারণে ট্রাইবুনালের হাতেও আরও অনেক বেশি ক্ষমতা দেওয়া প্রয়োজন। বিজেপি সরকার তা না করে ঠিক উল্টোটাই করল। এর ফলে দরিদ্র মুসলমান জনগণের স্বার্থ আরও বিপন্ন হবে।

প্রশ্ন এসেছে, এই বিল নিয়ে রাজ্যের সাথে কেন কোনও পরামর্শ করা হয়নি। জমি অধিগ্রহণের অধিকার রাজ্যের আছে। রাজ্যেও ওয়াকফ বোর্ড আছে। কেন্দ্র কি জানে না যে, ওয়াকফে শুধু মুসলিমরাই নয়, হিন্দুরাও দান করে? সাধারণের কল্যাণের জন্য স্কুল, হস্টেল সহ অনেক কিছুই আছে ওয়াকফ সম্পত্তিতে। বহু ওয়াকফ অমুসলিমদের দানেই তৈরি হয়েছে। কলকাতার পাম এভিনিউ, পার্কসার্কাস, বক্তিয়ার শাহ রোড সহ নানা জায়গায় ওয়াকফের বেদখল সম্পত্তি উদ্ধার হয়েছে সম্পূর্ণ আইনি পথে লড়াই করে। তা জনস্বার্থে কাজেও লাগছে। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার এ সব কিছু দখল করার মতলবেই এই সংশোধনী এনেছে।

আশঙ্কা– খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, ধর্মীয় সংস্থাগুলির স্বায়ত্তশাসনের অধিকারও কেড়ে নেওয়ার এটা সূচনা নয় তো! একমাত্র হিন্দু ধর্মীয় সংস্থা ও তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে থাকবে, সরকারি সহায়তায়। অন্য দিকে আরএসএস এবং বিজেপির পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম বিদ্বেষের প্রচার ও প্রসার চলতে থাকবে। কোনও শুভবুদ্ধির মানুষ এটা মেনে নিতে পারেন না।

ওয়াকফ বোর্ডে কিছু দুর্নীতি নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু এই কারণে ওয়াকফ বোর্ডকে অকেজো করে দিয়ে সরকারি কব্জায় আনার যুক্তি কি মানা যায়? খবরে প্রকাশ, রাম মন্দির ট্রাস্টেও দুর্নীতি হয়েছে। সে সব ক্ষেত্রে সরকার কি একই দৃষ্টিভঙ্গি নেবে?

আজকাল আবার সব মসজিদের নিচেই নাকি মন্দির পাওয়া যাচ্ছে! এর লম্বা তালিকা আরএসএস-এর আছে। সাম্প্রদায়িক হুজুগে মাতিয়ে মুসলমানদের বিদেশি বলে তারা চিহ্নিত করতে চাইছে। আরএসএস-এর তত্ত্বই হল মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা। তারা থাকবে হিন্দুদের কাছে মাথা নত করে, দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে, কোনও নাগরিক অধিকার ছাড়াই। এমনই বিভেদমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলে বিজেপি।

ওয়াকফ আইন সংশোধনের আড়ালে এই হীন মতলবই বিজেপি পূরণ করতে চাইছে। একে প্রতিহত করা প্রতিটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের কর্তব্য।