মনে রাখবেন, স্কুল-কলেজ এমনি এমনি খুলছে না। খুলছে এক এবং একমাত্র গণআন্দোলনের চাপে। স্কুল খোলার দাবি জানিয়ে বাঁকুড়ায় গ্রেপ্তার হয়েছিল ডিএসও-র সদস্যরা। মিথ্যে কেসে আটকে রাখা হয়েছিল তাদের। স্কুল খোলার দাবিতে আন্দোলন, অবস্থান, বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন আরও বহু মানুষ, সংগঠন। শিশুসন্তানের হাত ধরে আন্দোলনে এসেছেন উদ্বিগ্ন মা-বাবা। রাজ্যজুড়ে আওয়াজ উঠেছে ‘আর নয় গুগল জুম, ফিরিয়ে দাও ক্লাসরুম।’
মনে রাখবেন অমিতের কথা। মালদার অমিত মন্ডল। দু’বছর স্কুল বন্ধ। অভাবের সংসারে একটু সুরাহা হবে বলে রাজস্থানে নির্মাণশ্রমিকের কাজে গিয়েছিল। কর্মস্থলেই দুর্ঘটনায় মারা গেছে অমিত। তার কফিনবন্দী দেহ আসছে বাড়িতে। ক্লাস নাইনের মেধাবী ছাত্র অমিত জেনে গেল না, কয়েকদিন পরেই এইট থেকে টুয়েলভের জন্য খুলে যাচ্ছে স্কুল। অমিতের মা নিশ্চয়ই শুনবেন স্কুল খোলার খবর। দিন যাবে। সংসারের হাজার কাজের মাঝে আড়াল খুঁজে অমিতের মা আঁচলে চোখ মুছবেন। অতলস্পর্শী শোকের সমুদ্রে ডুবে যেতে যেতে তার ডুকরে উঠতে ইচ্ছে করবে, ওগো ইস্কুলটা আরও আগে খুললে তো ছেলেটা এভাবে চলে যেত না?
মুর্শিদাবাদের সেই মেয়েটির কথা মনে রাখবেন। কদিন আগে মেয়ে স্কুলে আসে না কেন খোঁজ নিতে শিক্ষকরা পৌঁছে গেছিলেন তার বাড়িতে। রুগ্ন অসুস্থ মেয়ে তখন পাঁচমাসের অন্তঃসত্ত্বা। নিজেদেরই ভাত জোটে না ঠিক করে, তাও মদ্যপ বাবার অত্যাচার থেকে কোনওমতে বাঁচিয়ে মেয়েকে সামলে রেখেছেন মা। একপেট খিদে নিয়ে শীতের রোদে গা এলিয়ে বসে মেয়েটি দেখবে, মাঠের আলপথ ধরে আবার ইস্কুল যাচ্ছে তার বন্ধুরা। পিঠে রংচটা ব্যাগ, পায়ে ছেঁড়া চটি। স্কুলের কথা, বন্ধুদের কথা ভেবে চোখ ফেটে জল আসবে তার। স্মার্টফোন কিনতে না পারার হীনমন্যতায় যে মেয়েটি যে ছেলেটি শেষ করে দিল নিজের জীবন, বিহারে কাজ করতে গিয়ে ম্যানহোলে পড়ে মারা গেল যে দুই স্কুলছাত্র, তার ক্ষতিপূরণ দেবে কোন সরকার, কোন পাড়ার শিক্ষালয়?
এই দু’বছরে বিশ্বে নতুন করে আট কোটি লোক গরিব হয়েছে। ২০২১-এর ডিসেম্বরে ভারতে কর্মহীন লোকের সংখ্যা ৫৩ মিলিয়ন। আর কয়েকশো গুণ মুনাফা বাড়িয়ে নিয়েছেন আম্বানি আদানি। হু হু করে বেড়েছে ‘বাইজুস’, ‘আনঅ্যাকাডেমি’, ‘টিউটোপিয়া’র ইউজার সংখ্যা আর লাভের অঙ্ক।
আপনার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে আপনি যতটা আনন্দ পান, অমিতের মা-ও ঠিক তেমনই পেতেন। আমার আপনার সন্তানের মতোই ওই মেয়েটিরও পূর্ণ অধিকার ছিল স্কুলে ফেরার, শেখার। এই পৃথিবীর অমল আলোয় আনন্দে বাঁচার।
অমিতদের যারা বাঁচতে দিল না, তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চারে বলতে পারার নামই মানবজীবন।
সঙ্ঘমিত্রা চট্টোপাধ্যায়, দমদম