পঞ্চায়েতে ১০০ শতাংশ আসনই পাবে তৃণমূল৷ বলে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ তাতে উৎসাহিত হয়ে তাঁর দলের নেতা–মন্ত্রীরা বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত করার জন্য নানা লোভনীয় পুরস্কার ঘোষণা করছেন৷মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছানুসারে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর দলের ‘উন্নয়ন বাহিনী’ প্রায় অর্ধেক আসনে বিরোধীদের মনোনয়নই দিতে দেয়নি৷ যে ক’টি আসনে বিরোধীরা প্রার্থী দিয়েছিল তাদের বাড়িতে বাড়িতে হামলা, বোমাবাজি, মারধোর, থান কাপড় পাঠিয়ে দেওয়া, পরিবারকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি ইত্যাদি মনোনয়ন প্রত্যাহার করানোর কোনও ‘গণতান্ত্রিক’ পদ্ধতিই তৃণমূলের ‘উন্নয়ন বাহিনী’ বাদ দেয়নি৷ বীরভূমের জেলা পরিষদ থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত সমিতি এবং প্রায় সমস্ত গ্রাম পঞ্চায়েতের ১০০ শতাংশই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী তৃণমূল৷ মুর্শিদাবাদে জেলা পরিষদে সামান্য কয়েকটা আসনে বিরোধী প্রার্থী থাকলেও বাকি দুটি স্তরে অর্ধেকের বেশি আসনেই তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী৷ বাঁকুড়াতেও তাই৷ সারা রাজ্যে একই চিত্র, প্রায় অর্ধেক আসনে তৃণমূলই একচ্ছত্র৷
অথচ মুখ্যমন্ত্রীর বড়াই, রাজধর্মই তিনি রক্ষা করেছেন৷ কেমন রাজধর্ম তার মানে কি রাজার পায়ে প্রজাদের লুটিয়ে পড়া গণতন্ত্রে এই শব্দটির অন্য মানে আছে৷ মুখ্যমন্ত্রী সে মানেটি ভুলিয়ে দিতে চেয়েছেন৷
জেলায় জেলায় প্রবল সন্ত্রাসের মধ্যেও এস ইউ সি আই (সি)–র প্রার্থী হিসাবে যাঁরা মনোনয়ন দিয়েছিলেন তাঁদের বাড়িতে শুধু নয়, আত্মীয়–স্বজনের বাড়িতেও এমনকী প্রার্থীর প্রস্তাবক ও তাঁদের আত্মীয়দের বাড়িতে পর্যন্ত তৃণমূলের দুষ্কৃতী বাহিনী হামলা করেছে৷ মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করার জন্য বাইক বাহিনী পিস্তল, ছুরি, লাঠি নিয়ে রাতেও তল্লাসি চালিয়েছে এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থীদের বাড়িতে৷ বাঁকুড়ার ওন্দা, ছাতনা, তালডাংরা, হিড়বাঁধ, কোচবিহারের বক্সিরহাট, তুফানগঞ্জ, দিনহাটা, পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়া, কাঁথি, ময়না নন্দীগ্রাম সহ বেশিরভাগ ব্লক, মুর্শিদাবাদের জেলা জুড়ে সন্ত্রাস চরমে উঠেছে৷ তুফানগঞ্জে প্রসেনজিৎ সরকারের বুকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে, হলদিয়ায় অনুপ গিরিকে অপহরণ করে তুলে নিয়ে গিয়ে প্রাণনাশের চরম হুমকি দেওয়া হয়েছে৷ হাইকোর্টের নির্দেশে ২৩ এপ্রিল মনোনয়ন জমা দেওয়ার যে অতিরিক্ত দিন নির্বাচন কমিশন দিয়েছিল সেই দিন দক্ষিণ ২৪ পরগণার মন্দিরবাজার জেলা পরিষদ কেন্দ্রের জন্য মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে ডায়মন্ডহারবারে এসডিও অফিসে রিটার্নিং অফিসারের টেবিলের সামনেই এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থী সুকান্ত নস্করকে মারধোর করে তার কাগজপত্র কেড়ে নেওয়া হয়৷ বজবজ–২ বিডিও অফিসে এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থীদের গায়ের জোরে আটকে দেওয়াই শুধু হয়নি, ডোঙাড়িয়াতে পার্টি অফিসের দরজা ভেঙে ঢুকে পিস্তল, ভোজালি, রড, লাঠিধরী মুখে কালো কাপড় বাঁধা তৃণমূলের বাইক বাহিনী এলাকায় দলের নেতা কমরেড অজয় ঘোষকে মেরে রক্তাক্ত করে দেয়৷ বাওয়ালি আঞ্চলিক সম্পাদক কমরেড বাসুদেব কাবড়ির বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে তাঁকে খুনের হুমকি দেয়৷ অফিসের আসবাবপত্র ভেঙে, মহান মার্কসবাদী নেতা ও মনীষীদের ছবি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়৷ পুলিশ কিছুই করেনি৷
নির্বাচন কমিশন ৫৮ হাজার পুলিশ দিয়ে ৫৮ হাজার ৪৬৭টি বুথে একই দিনে নির্বাচন করাতে চেয়েছে, তাতে কেমন গণতন্ত্র থাকবে সে কথা বলে দিয়েছেন তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি৷ ভোটের দিনেও যে ‘উন্নয়ন’ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে এবং প্রয়োজনে ভোটারের হয়ে ব্যালটে ছাপ দিয়ে দেবে তা প্রকাশ্যে বলেই দিয়েছেন তিনি৷ এর পরেও নাকি ‘অবাধ ও শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচন হবে মুখ্যমন্ত্রীর আশা৷
তৃণমূলের এই সন্ত্রাসের চেহারা দেখে মানুষের মনে পড়ে যাচ্ছে সিপিএম জমানার কথা৷ হুবহু একই ছবি৷ সেই প্রার্থী হতে বাধা, প্রার্থী হলে বাড়িতে আক্রমণ, মনোনয়ন প্রত্যাহার করার জন্য হুমকি, না করতে চাইলে বাড়ির দরজায় সাদা থান পৌঁছে দিয়ে প্রাণহাণির ত্রাস সৃষ্টি, বন্দুক বাহিনী নামিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি, খুন, রক্তপাত– এর সব ক’টি রাস্তাই ছিল সিপিএমের নির্বাচনী রণকৌশল৷ বিরোধীরা প্রার্থী হতে গিয়ে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুললে সিপিএম নেতারা বলতেন, ‘আমরা কি প্রার্থী খুঁজে দেব?’ হাড় হিম করা সন্ত্রাসের দক্ষতা সিপিএম অর্জন করেছিল৷ এখন তৃণমূল তাকে কপি করতে গিয়ে এখনও সিপিএমের সূক্ষ্মতাটুকু শিখে উঠতে পারেনি৷ পার্থক্য ঘটে যাচ্ছে এতেই৷ তাই তৃণমূলকে একেবারে নগ্ন সন্ত্রাসের রাস্তায় যেতে হয়েছে৷ একদল তৃণমূল নেতা দলের দোষ স্খালনের জন্য বলে বেড়াচ্ছেন, সিপিএম থেকে আসা বেনোজল সব তৃণমূলে ঢুকেছে, তারাই দলের কাছে নিজেদের দাম প্রমাণ করতে এমন সব জঘন্য কাজ করছে৷ এ কথা সত্যি হলে দলীয় নেতৃত্ব তা অনুমোদন করতেন কি? কোথাও তৃণমূল নেতাদের মুখে এর বিরুদ্ধে নিন্দা শোনা যাচ্ছে না৷ তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকার কোথাও পুলিশকে সন্ত্রাস বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছে বলেও সংবাদ নেই৷ এইসব লোক হাসানো ছেঁদো কথা যে যাই বলুক, রাজ্যের মানুষ দেখছেন সন্ত্রাসের রাজনীতি সিপিএম যেখানে শেষ করেছিল, তৃণমূল তার পর থেকে শুরু করেছে৷
সিপিএম একসময় বলত, যেহেতু রাজ্য সরকারে তারাই আছে, তাই কোনও পঞ্চায়েতে বিরোধীরা জিতলে সেখানে উন্নয়ন হবে না৷ আজ তৃণমূলের কণ্ঠে সেই একই সুর৷ এটা কেমন গণতন্ত্রের কণ্ঠস্বর এ তো মানুষকে হুমকি দেওয়া যে, রাজ্য সরকারে যারা আছে সেই দলকেই পঞ্চায়েতে না জেতালে রাস্তাঘাট, পানীয় জলের কল কিংবা কন্যাশ্রী থেকে শুরু করে কোনও সরকারি সুবিধা বা ন্যায্য পাওনা সরকার দেবে না এটাই যদি তৃণমূলকে জেতানোর যুক্তি হয়, তাহলে বিজেপি যদি প্রচার করে আমরা কেন্দ্রে আছি তাই রাজ্য সরকারেও আমাদেরই থাকার হক আছে, না হলে কেন্দ্র কোনও টাকা দেবে না– তৃণমূল তা মানবে তো? আসলে স্বৈরাচারীরা এই ভাষাতেই কথা বলে৷ তৃণমূল–সিপিএম–কংগ্রেস যারাই ক্ষমতায় যায় তারাই জানে মানুষের সত্যিকারের সমর্থন নয়, তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার চাবিকাঠি হচ্ছে একদিকে গায়ের জোর, অন্যদিকে কোটি কোটি মানুষের দারিদ্র–বেকারি নাচার অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদের টাকার লোভ দেখিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা, আর টাকার জোরে টিভি, খবরের কাগজ, সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রচারের জৌলুস৷ সব বুর্জোয়া শাসকের মতোই মুখ্যমন্ত্রীও এটাকেই শক্তি ভেবেছেন৷ কিন্তু যে কটা আসনে ভোট হবে তার সব কটাতে তৃণমূল যদি জেতেও, তাতেই কি প্রমাণ হয়ে যাবে মানুষ তাদের পক্ষে? তৃণমূল সরকারের জনবিরোধী কাজকে মানুষ সমর্থন জানাচ্ছে? সিপিএমও বলত একই কথা– ‘আমরা ভোটে জিতছি তাই আমরাই ঠিক’৷ সিপিএম মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, আমরা ২৩৫, ওরা ৩০– ওদের কথা শুনতে হবে? পশ্চিমবঙ্গের মানুষ নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই ঔদ্ধত্যের জবাব দিয়েছে সিপিএমকে৷
আজ তৃণমূল যদি ভেবে থাকে সন্ত্রাস আর ঔদ্ধত্য দিয়েই তারা মানুষকে চিরদিন দাবিয়ে রাখবে, তবে তাদের শেষের দিনের শুরু হতে বিলম্ব হবে না৷ তারা ভুলে গেছে ইতিহাসের শিক্ষা৷ সাধারণ মানুষকে গণআন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে সরকার যে সমীহ করতে বাধ্য হয়, তার শিক্ষা কিছুটা হলেও মানুষ তাদের দিয়েছে পাশ–ফেল চালুর দাবিতে গত জুলাইয়ে এস ইউ সি আই (সি)–এর ডাকা বনধের পাশে বিপুল সমর্থন নিয়ে দাঁড়িয়ে৷ যা দেখে উদ্ধত সরকারকেও চিঠি লিখে বলতে হয়েছে, দাবি আমরা মানবো৷ ভোটে গায়ের জোরে ওরা অনেক সিট পেতে পারে, কিন্তু শেষ কথা বলে গণআন্দোলন৷ উন্নত নীতি–নৈতিকতার আধারে গড়ে ওঠা আন্দোলনই সন্ত্রাস মোকাবিলারও পথ৷
(৭০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ২৭ এপ্রিল, ২০১৮)