টানা ১৪ দিন ছাত্রদের অনশন আন্দোলনের পর শেষ পর্যন্ত মাথা নোয়াতে বাধ্য হল কলকাতা মেডিকেল কলেজের উন্নাসিক কর্তৃপক্ষ৷ আরও একবার আন্দোলনের বিজয় প্রত্যক্ষ করল রাজ্যবাসী৷ এই আন্দোলনে সামিল ছাত্রছাত্রী এবং অসংখ্য ছাত্র–চিকিৎসক–অভিভাবক-বুদ্ধিজীবী-সাধারণ মানুষ যাঁরা পাশে দাঁডিয়েছেন, তাঁদের সংগ্রামী অভিনন্দন জানানো হয়েছে অল ইন্ডিয়া ডিএসও–র পক্ষ থেকে৷
সমস্ত ছাত্রের জন্য স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত পদ্ধতিতে হস্টেল বরাদ্দ করতে হবে– পড়াশোনার জন্য এই মৌলিক প্রয়োজনটির দাবিতে জীবন বিপন্ন করে ডাক্তারি ছাত্রদের এই অনশন আন্দোলন চালাতে হল কেন? এর কারণ, বছর কয়েক আগে পরিকাঠামোর কোনও তোয়াক্কা না করেই রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও ঐতিহ্যবাহী এই কলেজটির আসন সংখ্যা ১৫৫ থেকে বাডিয়ে ২৫৫ করে দেওয়া হয়েছে৷ এই কলেজের বহু ছাত্র শেষ তিন বছর ধরে কোনও হস্টেল অ্যালটমেন্ট পায়নি৷ অত্যন্ত অপ্রশস্ত ঘরে বেশ কয়েকজন ছাত্রকে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে৷ মাথার উপর থেকে কখনও ছাদ খসে পডে, তো কখনও ফলস সিলিং খুলে যায়৷ হস্টেলের চারপাশে মাসের পর মাস ধরে জমে থাকে আঁস্তাকুড়৷ তার উপরে আছে শাসক সংগঠনের দুর্নীতি–স্বজনপোষণ৷ ছাত্ররা সুরাহা চাইতে গেলেই দীর্ঘদিন ধরে নির্মীয়মান হস্টেলকে খুডোর কল দেখানো হয়েছে৷ স্বভাবতই এ বছর সেই নির্মীয়মান হস্টেল সম্পূর্ণ হবার পর থেকে ছাত্ররা সুরাহা দাবি করতে থাকে৷ কিন্তু কলেজ অথরিটি অত্যন্ত একরোখা ভাবে তাদের দাবি নস্যাৎ করে দেয় এবং শাসক দলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েম করতে নবাগতদের ওই হস্টেলে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়৷ তারই অঙ্গ হিসাবে সদ্য পাশ করা শাসকদলের এক ছাত্রনেতাকে হস্টেল সুপার ঘোষণা করে৷ প্রতিবাদে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে৷ শান্তিপূর্ণ ছাত্র–বস্থানে পুলিশি হস্তক্ষেপ হয়৷
শুরু থেকেই দাবিগুলির সমর্থনে অল ইন্ডিয়া ডিএসও আন্দোলনরত ছাত্রদের পাশে দাঁড়ায়৷ ৫ জুলাই ছাত্র–অবস্থানে পুলিশি হস্তক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ করে তারা৷ এর পরে অনশন আন্দোলনে যখনই পুলিশি হস্তক্ষেপ হয়েছে তখনই ডিএসও বিরোধিতায় সোচ্চার হয়েছে৷ ১৭ জুলাই ডিএসও–র পক্ষ থেকে প্রিন্সিপাল অফিসে বিক্ষোভ ও ডেপুটেশন হয় এবং অবিলম্বে হস্টেল সমস্যা সমাধানের দাবি জানানো হয়৷ রাজ্য জুডে মেডিকেল ও অন্যান্য কলেজগুলিতে দাবির সমর্থনে জনমত গঠন করা হয়৷ নর্থবেঙ্গল মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষকে ডেপুটেশন দিয়ে তাঁর মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি মানার আবেদন জনানো হয়৷ ২২ জুলাই–এর গণকনভেনশন ও মিছিলে ডিএসও কর্মীরা অংশগ্রহণ করে৷ আন্দোলনরত ছাত্রদের দাবির সমর্থনে সামিল হন প্রাক্তন এস ইউ সি আই (সি) সাংসদ ও ওই কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ডাঃ তরুণ মণ্ডল৷ ছাত্রদের দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানান তিনি৷ মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার এবং সরকারি ডাক্তারদের সংগঠন সার্ভিস ডক্টর্স ফোরামও এই আন্দোলনের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায়৷
শুধু কলকাতা মেডিকেল কলেজই নয় রাজ্যের প্রতিটি মেডিকেল কলেজের অবস্থাই কম–বেশি একই রকম৷ শাসকদল নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েম করার লক্ষ্যে কলেজের হস্টেলগুলিকে নিজেদের ছাত্রসংগঠন টিএমসিপি–র কুক্ষিগত করে রাখতে চায়৷ কলেজ কর্তৃপক্ষকেও তারা এই কাজে যথেচ্ছ ব্যবহার করে৷ হস্টেল অ্যালটমেন্টের ক্ষেত্রে কলেজ কর্তৃপক্ষের কোনও স্বচ্ছ ও সুনির্দিষ্ট নীতি নেই৷ হস্টেল পেতে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের দ্বারস্থ হতে হয় ছাত্রদের, যা সিপিএম–ফ্রন্ট সরকারের আমলের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়৷
শুধু আধিপত্য কায়েম করার অপচেষ্টাই নয়, কর্তৃপক্ষের মদতে টিএমসিপি হস্টেলগুলিতে ইন্ট্রো বা নবীনবরণের নাম করে ragging , তোলাবাজি, মাদক সেবন সহ নানা অপসংস্কৃতির চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে৷ এসবের প্রতিবাদ করলেই শুরু হয় হুমকি, জুলুম, সন্ত্রাস, হস্টেল থেকে বহিষ্কার, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা৷ ফলে রাজ্যের মেডিকেল কলেজগুলিতে গণতন্ত্র আজ বিপন্ন, পডাশোনার পরিবেশ বিঘ্নিত, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল কলুষিত৷ টিএমসিপি ও অগণতান্ত্রিক প্রশাসনের এই অশুভ আঁতাতের বিরুদ্ধেও ডিএসও দীর্ঘদিন ধরে কলেজে কলেজে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে৷ একমাত্র ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমেই যে দাবি আদায় করা সম্ভব, কলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের সাম্প্রতিক আন্দোলন ও বিজয় সেই শিক্ষাই দিয়ে গেল৷ ডিএসও দৃঢ়ভাবে মনে করে, মেডিকেল কলেজগুলিতে পডাশোনার সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখতে অবিলম্বে সরকার ও কর্তৃপক্ষের সদর্থক ভূমিকা নেওয়া দরকার৷ সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, কলকাতা মেডিকেল কলেজ সহ সমস্ত মেডিকেল কলেজগুলিতে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত ভাবে সকল ছাত্রছাত্রীদের হস্টেল অ্যালটমেন্ট দিতে হবে, হস্টেলগুলিতে ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে এবং নবাগত ছাত্রছাত্রীদের উপর ragging বন্ধ করতে হবে৷
(৭১ বর্ষ ১ সংখ্যা ৩ আগস্ট, ২০১৮)