উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম, প্লাস্টারহীন ইটের দেওয়ালে কাঁচা হাতে তুলির টান পড়েছে। ফুটে উঠেছে কটা অক্ষর– ২৪ এপ্রিল শহিদ মিনার ময়দান চলুন। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পশ্চিম থেকে পূর্বে রাজ্যের প্রান্তে প্রান্তে কয়েক সপ্তাহ ধরে গ্রাম, গঞ্জ, হাট-বাজার, শহরের রাজপথ কিংবা গলিপথ ধরে এগিয়ে গেলে দেওয়ালে লেখা এ আহ্বানে চোখ একবার অন্তত পড়েনি এমন মানুষ কম। কোথাও লেখা বেশ অভ্যস্ত পাকা হাতের, একবার চোখ পড়লেই দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। কোথাও বা নিতান্ত অপটু হাতের চেষ্টা, কিন্তু তাও চোখ না টেনে পারে না। এই কাঁচা অপটু দেওয়াল লিখনও যেন অদম্য শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ঘোষণা করছে– প্রতিকূলতা, ঝড় ঝাপটা যতই আসুক না কেন, আমরা পিছিয়ে যাব না।
২৪ এপ্রিল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর ৭৫তম প্রতিষ্ঠা দিবস। সারা ভারতের অন্তত ২৩টি রাজ্যে রাজধানী শহর বা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই দিনটিকে সামনে রেখে সভা এবং নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। কলকাতার শহিদ মিনারে ২৪ এপ্রিলের সমাবেশ আজ এক বিশেষ ঐতিহ্যে পরিণত। পশ্চিমবঙ্গের বামমনস্ক মানুষ এই সমাবেশের খোঁজ নিতে থাকেন অনেক আগে থেকেই। নির্বাচন কিংবা করোনা পরিস্থিতির কারণে যে বছর এই সমাবেশ হতে পারেনি তার খোঁজও তারা নিয়েছেন। বামপন্থী আন্দোলনের বর্তমান রূপরেখা, আগামী দিনের কর্তব্য বুঝে নিতে যে হাজার হাজার মানুষ ওই দিন শহিদ মিনার ময়দানে আসেন, তাঁরা জানেন এই বিশাল সমাবেশের খবর কোনও খবরের কাগজ, টিভি চ্যানেল, রেডিও প্রচার করবে না। অথচ সারা পশ্চিমবঙ্গে শহর গ্রামে ছড়িয়ে গেছে এর কথা। ছড়িয়েছে মুখে মুখে, ছড়িয়েছে বাড়ি বাড়ি নিবিড় প্রচারে, দেওয়াল লিখনে, হাতে লেখা বা ছাপা পোস্টারে। হয়েছে অসংখ্য হাটসভা, পথসভা, ছোটো ছোটো প্রচার স্কোয়াড। কোথাও আবার সুসজ্জিত প্রদর্শনীতে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের নানা উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছে। বহু এলাকায় হয়েছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তা সংবলিত বইয়ের স্টল।
২০১৯-এ লোকসভা নির্বাচন এবং পরবর্তী দুটি বছর করোনা অতিমারি জনিত অস্বাভাবিক পবিস্থিতিতে ২৪ এ
প্রিলের কেন্দ্রীয় সমাবেশ হতে পারেনি। তাই এই বছরের সমাবেশ ঘিরে আগ্রহ অনেক বেশি। এর মধ্যে দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে চলছে প্রবল দাবদাহ, উত্তরবঙ্গে ঝড়বৃষ্টিতে বহু ক্ষতি হয়েছে। বোরো ধান এখনও সব জায়গায় ঘরে ওঠেনি। চাষির কাছে এ বড় চিন্তার বিষয়। যারা দিনমজুরি করেন, তাঁদের অনেকের দু’বছর প্রায় রোজগার না থাকার পর সবে কিছু কাজ মিলছে। তবু জেলায় জেলায় দলের কর্মী সমর্থকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যেতে হবে সমাবেশে, কলকাতায়। সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের ভাষণ থেকে বুঝে নিতে হবে দিনবদলের বিপ্লবী রাজনীতির নানা চড়াই উৎরাই, বুঝে নিতে হবে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কর্তব্য। যেমন তেমন বাঁচা নয়, মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা অনুযায়ী মাথা উঁচু করে মানুষের মতো মর্যাদা নিয়ে বাঁচা।
কলকাতা থেকে দূরবর্তী জেলাগুলির আসার ক্ষেত্রে সমস্যা কম নয়। করোনা অতিমারির সময় থেকে জেনারেল কম্পার্টমেন্ট বন্ধ রেখেছিল রেল, আজও তা বন্ধ। ফলে সকলকে আসতে হবে রিজার্ভেশন করে। তার জন্য লাগবে অনেক টাকা। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি থেকে এই যাতায়াতে টিকিট এবং খাওয়া খরচ ধরে প্রায় এক হাজার টাকা খরচ। কোথায় পাবেন গরিব মানুষ? জলপাইগুড়ির মানিকগঞ্জ কিংবা নাথুয়া হাটের দিনমজুরি করা কর্মীরা তাই অতিরিক্ত কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে জোগাড় করেছেন টাকা। অনেকেই আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের কাছে চেয়েছেন পাথেয়। তাঁরাও দিয়েছেন। যে কর্মী সমর্থকরা আসতে পারেননি তাঁরাও যথাসাধ্য টাকা তুলে দিয়েছেন অন্যদের যাতায়াত খরচের জন্য। মালদার কর্মীরা একই পদ্ধতিতে টাকা জোগাড় করেও যখন পুরো টিকিটের দাম তুলতে পারেননি, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যেকটি টিকিট কাটা সম্ভব, বাকিরা ঝুঁকি নিয়েই ট্রেনে উঠবেন। টিকিট পরীক্ষক এলে বোঝাবেন, কেন এই যাওয়ার আহ্বান তাঁরা ফেলতে পারেননি, যদি তিনি ছেড়ে দেন ভাল, না হলে জেলে যেতেও তাঁরা প্রস্তুত হয়েই উঠেছেন ট্রেনে। পুরুলিয়ার বাগমুণ্ডি, আড়শা, ঝালদার কর্মীরা যখন আগের দিন দুপুরে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন তখন এলাকা পুড়ছে রোদে, তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রির বেশি। আগে যত ট্রেন চলত, তাঁরা সন্ধ্যায় বেরিয়ে কলকাতা আসতে পারতেন। এখন উপায় নেই, তাই তাঁরা দূর গ্রাম থেকে গাড়ি ভাড়া করে ২৩ তারিখে এসেছেন ঝালদা রেল স্টেশনে। সেখান থেকে বিকেলে ট্রেন ধরে পৌঁছেছেন খড়গপুর। সারা রাত স্টেশনে কাটিয়ে ভোরের লোকাল ধরে হাওড়া। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার গোসাবা, পাথরপ্রতিমার জি-প্লট, এল-প্লট, সাগর থেকে রওনা দিতে হয়েছে রাত থাকতে, প্রথমে জলপথ, তারপর মোটরভ্যান কিংবা অন্য গাড়িতে স্টেশন, সেখান থেকে ট্রেন। অনেকে ২৪-এর রাতে বাড়িও পৌঁছাতে পারবেন না। থাকতে হবে স্টেশনে কি কাকদ্বীপে কোনও আশ্রয়ে। জটা কঙ্কনদীঘি, রায়দীঘির নানা গ্রাম থেকেও একইভাবে এসেছেন কর্মী সমর্থকরা। বাস কিংবা ট্রাক ভাড়া এখন এত বেশি যে, সরাসরি তার ব্যবস্থা করার উপায় নেই। অদ্ভূত এক দৃঢ়পণ– যত কষ্টই হোক তবু এই দিনটাতে ময়দানে আসতে হবেই। প্রবল দাবদাহকে উপেক্ষা করে শিয়ালদহ এবং নানা জায়গা থেকে মিছিল করে কর্মী-সমর্থকরা সমাবেশে এসেছেন।
এই সমাবেশের খরচ জোগাড় করতে কলকাতা সহ রাজ্যের সব জেলাতেই সাধারণ মানুষের কাছে অর্থ সাহায্য চেয়ে আবেদন জানিয়েছেন দলের কর্মীরা। শুধু তাই নয়, নিজেরাও পারিবারের খরচ বাঁচিয়ে টাকা জমিয়েছেন, দলকে দিতে হবে বলে। কমসোমলের কিশোর-কিশোরীরাও প্রতিদিন কিছু না কিছু টাকা জমিয়েছে, বড়দের কাছে চেয়েছে কমরেড শিবদাস ঘোষের প্রতিকৃতির সামনে গার্ড-অব অনারে যে তাকে পৌঁছাতেই হবে।
অন্য দল যখন বড় বড় সভা করে তার চাকচিক্যই আলাদা, টাকার স্রোত সেখানে বয়ে যায়। অন্যদিকে ২৪ এপ্রিল দেখা গেল বৈভব নয়, এক অপূর্ব নিষ্ঠা, সৌন্দর্যবোধের ছাপ মঞ্চ থেকে মাঠের সর্বত্র। এমন একটা দল, যাদের পিছনে মালিকদের টাকার থলির জোর নেই, বুর্জোয়া মিডিয়ার প্রচার নেই, প্রশাসন পাশে নেই, স্বাভাবিকভাবেই মিডিয়াতে মুখ দেখা যায় এমন তারকাদের হুড়োহুড়ি নেই, তবু প্রখর রোদে, গরমে হাজার হাজার মানুষ কোন শক্তিতে সব প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করতে পারেন?
প্রশ্নটা শুনে, ময়দানের শহিদ মিনার ঘেঁষা অংশে বুকস্টলের সামনে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ একমুখ হাসি নিয়ে একটা বই তুলে দেখালেন–এটাই শক্তি। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারাই সেই শক্তি। উত্তরটা বিবেকে একটা ধাক্কা দিল– দৃষ্টি গেল পতপত করে ওড়া মঞ্চের লাল পতাকাটার দিকে। ওকে তুলে রাখার শক্তি যে এখানেই মজুত।