সিবিআই থেকে আদালত– বিচারের নামে নির্লজ্জ প্রহসন যখন মানুষকে হতাশার মধ্যে নিক্ষেপ করতে উদ্যত, ঠিক তখন ২১ জানুয়ারির মহামিছিল বিপরীত বার্তা দিয়ে গেল। সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি। মানুষ আছে, তাদের চোখের জল আছে। ওই চোখের জলে ভিজানো প্রতিবাদ আছে। ওই দিন কলকাতার রাজপথ প্রবীণ থেকে নবীনের কণ্ঠে গর্জিত হল সেই আস্থা, সেই বিশ্বাস– রাস্তা ছাড়ি নাই, আন্দোলন চলবেই, শেষ আমরা দেখেই ছাড়ব।
দার্জিলিংয়ের পাহাড় থেকে সুন্দরবনের খেত খামার জনপদ– গত দেড় মাস ধরে একটি আওয়াজেই আন্দোলিত হয়েছে– ২১ জানুয়ারি মহামিছিলে কলকাতায় চলুন। অভয়ার মর্মান্তিক মৃত্যুর বিচার চাই, বেকারদের কাজ চাই, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি চাই, কৃষকের ফসলের ন্যায্য মূল্য চাই, বিদ্যুতের স্মার্ট মিটার বাতিল করতে হবে ইত্যাদি জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলির প্রতিকারের দাবিতে শত শত কণ্ঠ হাট-বাজার-পাড়া মথিত করে মানুষকে আহ্বান করেছে মিছিলে শামিল হওয়ার জন্য।
২১ জানুয়ারি প্রমাণ করে দিল– মানুষ সাড়া দিয়েছেন। মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত ও গরিব ঘরের রমণী থেকে শুরু করে গ্রামীণ যুব সমাজ, খেতমজুর, কৃষক, কলকারখানা, চা-বাগানের শ্রমিক সহ সমস্ত অংশের মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল এই মিছিলে।
২১ জানুয়ারি লেনিন স্মরণ দিবসে মহামিছিলের দিন স্থির করার পিছনে উদ্দেশ্য ও বার্তাও পরিষ্কার। তা হল শ্রমিক-কৃষকের শোষণ-লুণ্ঠন, বেকারত্বের জ্বালা, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার সমস্যা থেকে নারীর অবমাননা-অত্যাচার নিপীড়ন– সব কিছুকেই সমূলে উৎপাটিত করতে হলে সরকার পরিবর্তন দিয়ে হবে না। সমাজ ব্যবস্থার, উৎপাদন ব্যবস্থার, রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হবে– যে পথ মহান লেনিন রাশিয়ার বুকে এঁকে দিয়েছিলেন।
হেদুয়ার রাস্তায় মঞ্চ বেঁধে সভা চলেছে দুপুর থেকেই। রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য এই সভা থেকে বলেন, আজকের এই জনজোয়ারের বার্তা– এই আন্দোলন আগামী দিনে আরও তীব্র রূপ ধারণ করবে। রাজ্যের রাজধানী থেকে জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়বে। আন্দোলনের জোয়ারে আগামী দিনগুলো গোটা পশ্চিমবাংলা ভাসবে। মহান মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে সংগ্রামী বামপন্থার ঝান্ডাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে এই লড়াই আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব। এটাই আমাদের অঙ্গীকার।
মিছিলের চলার পথে বহু মানুষ সংহতি জানাতে রাস্তার দু’পাশে এসে দাঁড়ান। তাঁদের অনেকেই মিছিলের স্লোগানে গলা মেলান। কলেজ স্কোয়ারের সামনে প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতা সমিতি, ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে নেতৃবৃন্দের হাতে পুষ্পস্তবক তুলে দেন তাঁদের প্রতিনিধিরা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী ইউনিয়ন, পরিবহণ শ্রমিক সংগঠন, হুগলি জেলার বিদ্যুৎগ্রাহকদের দুটি সংগঠনও নেতৃবৃন্দকে অভ্যর্থনা জানান। বউবাজার মোড় এবং হিন্দ সিনেমার মোড়েও নাগরিকরা পুষ্পস্তবক তুলে দেন নেতৃবৃন্দের হাতে।
ওয়েলিংটন স্কোয়ারের মুখে মঞ্চের উপর রাখা মহান লেনিনের প্রতিকৃতিতে যখন মাল্যদান করে সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ শ্রদ্ধা জানালেন– হাজার হাজার কণ্ঠে ধ্বনি উঠল, মহান নেতা লেনিন জিন্দাবাদ, মার্ক্সবাদ লেনিনবাদ শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা জিন্দাবাদ। কমরেড অসিত ভট্টাচার্য সহ উপস্থিত অন্য পলিটবুরো সদস্যরা লেনিনের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানালেন। মঞ্চ থেকেই প্রভাস ঘোষ নেমে গেলেন মিছিলে। রাজ্য সম্পাদক, পলিটবুরো সদস্য কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য পুষ্পস্তবক দিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন তাঁকে। এর পর তাঁর নেতৃত্বেই মিছিল এগিয়ে চলল ধর্মতলার দিকে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে প্রভাস ঘোষ বলেন, বিচারের নামে প্রহসন হয়েছে। এই হত্যার জন্য যারা প্রকৃত দায়ী তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রাক্তন অধ্যক্ষ, পুলিশ অফিসার সবাইকেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার উভয়ই চেয়েছে যাতে ন্যায়বিচার না হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের স্বার্থ হল, পশ্চিমবঙ্গে এই আন্দোলন যে উত্তাপ ও পরিবেশ সৃষ্টি করেছে তাতে যদি দোষীরা ধরা পড়ে তার প্রভাব সারা ভারতে পড়বে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতেও রোজ ধর্ষণ অত্যাচার ঘটছে। সেখানেও দোষীদের শাস্তির দাবি উঠবে। এই জন্যই কেন্দ্রীয় সরকার সিবিআইকে সেই ভাবে পরিচালিত করেছে যাতে প্রকৃত দোষীরা ধরা না পড়ে। রাজ্যের শাসক দলেরও একই স্বার্থ। তিনি বলেন, এই আন্দোলনের দাবি ন্যায়সঙ্গত। বিচারের প্রহসনে দোষীরা ছাড়া পেলেও জনগণের চোখে তারা ঘৃণিত হয়েই থাকবে। দোষিদের শাস্তির দাবিতে আমাদের এই আন্দোলন চলবে। জনগণ নিশ্চিত থাকতে পারেন, আমাদের দল আন্দোলনের রাস্তা থেকে সরে আসবে না।
মিছিল যখন ধর্মতলায় পৌঁছাল, গোটা চত্বর থিক থিক করছে মানুষের ভিড়ে। কিন্তু এত রাস্তা হেঁটে আবার তারপর নিজেদের জেলায় বাসস্থানে ফিরে যাওয়ার ঝক্কি মাথায় নিয়েও কারও মুখে ক্লান্তি ও বিরক্তির ছাপ নেই। এত বড় একটা প্রতিবাদী মিছিল করতে পেরে সকলেই যেন আনন্দিত, তৃপ্ত।