এ মিছিল তো আমারই

কত মিছিল তো দেখেছে কল্লোলিনী কলকাতা! কতবার শত সহস্র পদভারে কম্পিত হয়েছে কালো পিচ ঢালা রাজপথ। কত নিদাঘের ঘর্মাক্ত দুপুরে, অজস্র বর্ষণে সিক্ত সন্ধ্যায় কিংবা পাতা ঝরা শীতের সোনালী রৌদ্রে ঝলসে উঠেছে উদ্ধত মুষ্টিবদ্ধ স্লোগান। কিন্তু ২১ জানুয়ারির এমন মহামিছিলই বা কলকাতা দেখেছে কতদিন? এ মিছিল ছিল এক দৃঢ়প্রতিজ্ঞার, এক নির্দিষ্ট অভিমুখে নিবিষ্ট। কারণ এই মিছিলের ছিল এক পূর্বপ্রস্তুতি। দীর্ঘ পাঁচমাস ধরে কলকাতা মহানগর সহ সারা বাংলা প্রত্যক্ষ করেছে অভিনব প্রতিবাদ। আর জি কর হাসপাতালে কর্তব্যরত তরুণী চিকিৎসকের ওপর নৃশংস নির্যাতন ও হত্যার বিচার চেয়ে গড়ে উঠেছে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ। ক্ষুদ্র গণ্ডিবদ্ধ জীবনের স্বার্থপরতা, হীনতা, আত্মকেন্দ্রিকতার বেড়া ভেঙে অপার পবিত্র আত্মীয়তায় একে অপরের হাতে হাত রেখে গর্জে উঠেছে মানুষ। শহর গ্রাম জুড়ে কিশোরীর হাতের আল্পনার মতো অজস্র মিছিলে উচ্চকিত হয়েছে বিচারের দাবি। দলীয় স্লোগানের সাথে ভুক্তভোগী মানুষের এক অবজ্ঞার দূরত্ব থাকে। কিন্তু সেই স্লোগানই কখন আটপৌরে মেয়ের মতো পাড়ায় এলাকায় ঘরের অন্তঃপুরে এমন আপন হয়ে উঠেছে– উই ওয়ান্ট জাস্টিস।

এই অসংখ্য অসংগঠিত স্বতঃস্ফূর্ত গণপ্রতিবাদকেই মালার মতো গেঁথেছে ২১-এর মহামিছিল। কারণ এই অভিনব গণজাগরণ কেবল একটি হত্যা বা নির্যাতনের প্রতিবাদ নয়, এই সূচিমুখ দিয়ে মুক্ত হয়েছে বহুদিনের অব্যক্ত নিষ্পেষণ, বেদনা, প্রতিবাদের লাভাস্রোত। বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের অন্যতম মহান নেতা কমরেড মাও সে তুং-এর এক অমূল্য শিক্ষা– ‘ফ্রম দ্য মাসেস, টু দ্য মাসেস’। এই সমাজেই আছে মানুষের অনমনীয় তেজ, অকুতোভয় প্রতিরোধের শক্তি। সেই অশৃঙ্খলিত, বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদগুলিকে একটি বিপ্লবী দল আকরের মতো ধারণ করে। বিপ্লবী প্রজ্ঞায় শাণিত করে। তারপর তাকে সুনির্দিষ্ট লক্ষে্য চালিত করে গণআন্দোলনে। তাই এই পাঁচ মাস ধরে বাংলার গ্রামে শহরে পাড়ায় মহল্লায় যে অজস্র স্বতঃস্ফূর্ত গণপ্রতিবাদ ফুটে উঠেছে ফুলের মতো, বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের আর এক মহান নেতা কমরেড লেনিনের স্মরণ দিবস ২১ জানুয়ারি কলকাতার বুকে হাজার হাজার মানুষের মহামিছিল সেই অসংখ্য পুষ্পে সজ্জিত। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ অমোঘ লক্ষ্যে শাণিত। তাই ২১ জানুয়ারি কলকাতার বুকে মহামিছিল, ছাত্র যুব নারী শ্রমিক কৃষক– সমাজের নানা স্তরের মানুষের মহামিলনের তরঙ্গ দুকূল প্লাবিত করে এগিয়েছে, রাস্তার দুধারে দাঁড়ানো মানুষের সহর্ষ অভিবাদনকে সঙ্গী করে।

শিশু কোলে মা হাঁটছে মিছিলে। ঘুমিয়ে গেছে ছেলে। তবু হাঁটছে মা। মেডিকেল কলেজের সামনে দাঁড়ানো এক মা গভীর আবেগে বলছে, এ মিছিল তো আমারই। আমারও তো এমনি হাঁটা উচিত। কলেজ স্ট্রিটের সামনে চলছে মিছিলের জনপ্লাবন। স্কুল পড়ুয়া ছাত্ররা দু’পাশে দাঁড়িয়ে। মিছিলের স্লোগান অনুরণিত হচ্ছে কচিকণ্ঠে–উই ওয়ান্ট জাস্টিস। মিছিল এগিয়ে চলেছে। হিন্দ সিনেমার মোড়ে আটকে পড়া পথচলতি মানুষ। সাধারণভাবে থমকে যাওয়া মানুষ বিরক্ত হয়। খোঁজে মিছিলের শেষ। কিন্তু মিছিল বাড়ছে, মিছিল চলছে। শেষ নেই তার। এই দীর্ঘ মিছিলের পাশে দাঁড়ানো মানুষের বিরক্তি নেই, এক অপূর্ব প্রশান্তি চোখে মুখে। শেষ নয়, মিছিলের শেষ না হওয়াতেই যেন আনন্দ তাদের। কারণ এই মিছিল আর জি করের নির্যাতিতার বিচারের লড়াইকে তীব্র করবে তাই নয়, আরও অসংখ্য অবিচারের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের সংগ্রামকে উদ্বুদ্ধ করবে। এই প্রাণবন্ত জনস্রোতের অংশীদার কিংবা পাশে দাঁড়ানো অগণিত জনতার দীপ্ত উদ্ভাসে এই মহামিছিল অনন্য।

কৌশিক চ্যাটার্জী, বহরমপুর