এ মিছিলের শুরু অনেক আগেই, শেষও বহুদূরের লক্ষ্যে

এই কি বিচার হল? কোথায় রইল ন্যায়? দুর্নীতি-খুন ধর্ষণের বড় চক্রীরা তো বহাল তবিয়তেই রইল! তবে কি কেন্দ্রীয় সরকারের ‘খাঁচার তোতা’ সিবিআইয়ের মালিকরা তাদের কর্মচারীদের কলকাতা পুলিশের তৈরি বয়ানের বাইরে আর কোনও বুলি শেখাতে নারাজ! এই সঞ্জয় রায়ই যদি একমাত্র দোষী হয় তবে তিনি কি এতটাই প্রভাবশালী, যে তাকে বাঁচাতে আর জি কর মেডিকেল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ, টালা থানার প্রাক্তন ওসি, কলকাতা পুলিশের বড় বড় কর্তা, রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রশাসনের একাধিক কর্তা, রাজ্যের শাসক দলের থ্রেট কালচারের মাথা চিকিৎসক নামধারী ক্রিমিনালরা প্রমাণ লোপাটে হাত লাগাতে ৯ আগস্টের ওই অভিশপ্ত ভোরেই সক্রিয় হয়ে উঠেছিল? ১৮ জানুয়ারি আদালতের রায় যখন কার্যত একা সঞ্জয় রায়কেই দোষী সাব্যস্ত করে অভয়ার খুনের বিচারে দাঁড়ি টানার কথা বলছে– দেশের কোটি কোটি মানুষের মনে প্রশ্ন হয়ে দেখা দিল প্রায় এই কথাগুলোই।

এতদিন ধরে অনেকেই ভাবছিলেন, অভয়ার ন্যায়বিচার যে মিছিলের প্রথম দাবি, তাতে পা মেলানো উচিত। ২১ জানুয়ারি তা পৌঁছে গেল সিদ্ধান্তে– এই মিছিলে হাঁটতে হবে, তুলতে হবে উচ্চস্বরে দৃপ্ত স্লোগান– শাসক তুমি রেহাই পাবে না। কোনও দিন রাজনৈতিক মিছিলে না হাঁটা মানুষও এসে দাঁড়ালেন মিছিলের সারিতে।

২১ জানুয়ারি, সুবিশাল মিছিলটার শুরু কি হেদুয়া পার্কেই? আর শেষটা কি এসপ্ল্যানেডের মোড়ে? যে জনপ্লাবনে এ মিছিল ভাসল, তার কি এখানেই সূচনা আর সমাপ্তি? মাইক যখন থেমেছে, স্লোগানের উচ্চকিত স্বর যখন বিশ্রামে, তখনও কিন্তু এই মিছিলে অংশ নেওয়া মানুষ তো বটেই, যাঁরা মিছিল দেখতে রাস্তার দু’ধারে এসে দাঁড়ালেন, এমনকি দূরে থেকেও পাশে থাকলেন যে অসংখ্য মানুষ, তাঁদের চোখমুখ, তাঁদের আলোচনা বলে দিয়ে গেল এ মিছিলের শুরু সমাজের অনেক গভীরে। বুকে জমে থাকা অনেক অনেক বঞ্চনা, ক্ষোভ-বিক্ষোভগুলোর দানা বাঁধা জাগরণের রূপ এই মিছিল। এমন এক মিছিলের শুরু যেমন একদিনের পথ হাঁটায় সীমাবদ্ধ থাকে না, শেষও সেখানে নয়– এ বহন করে নিয়ে যায় অনেক দূর পথ চলার আহ্বান।

 অভয়ার ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলনের শুরু থেকেই একদিকে চলেছে সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির স্বার্থে একে আত্মসাৎ করার চেষ্টা। বিপরীতে চলেছে জনগণের সক্রিয় ভূমিকাকে যথাযোগ্য স্থান দিয়ে সঠিক দিশায় আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লড়াই, যার মধ্যে আছে একটা জনমুখী রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি। আন্দোলন এগিয়েছে কখনও দ্রুত পায়ে, কখনও ধীর লয়ে, কিন্তু গতি তার স্তব্ধ হয়নি। জনগণের অঙ্গীকার– পূর্ণাঙ্গ ন্যায়বিচার আদায় না করে এই আন্দোলন থামবে না। অভয়া আন্দোলনের এই দৃঢ়তা একদিনে গড়ে ওঠেনি। এ শুধু কিছু ক্ষোভের ফেটে পড়া স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশই নয়, এই বিক্ষোভ গড়ে উঠেছে অসংখ্য যন্ত্রণার সুরাহা চাওয়ার সম্মিলিত আকুলতায়।

সারা দেশেই নারী নির্যাতন-খুন-ধর্ষণ, শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন একটা অসহনীয় পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে। পশ্চিমবঙ্গে স্বাস্থ্য নিয়ে দুর্নীতি এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে নিয়োগ-দুর্নীতি সমস্ত নজিরকে ছাপিয়ে গেছে। শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় পাশ করা প্রার্থীরা দিনের পর দিন রাস্তায় বসে আছেন নিয়োগের অপেক্ষায়, অথচ স্কুল থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সব চলছে অস্থায়ী শিক্ষকের ভরসায়। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের শিক্ষানীতি শিক্ষাকে পুরোপুরি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার একটি সুচতুর পরিকল্পনা। ‘টাকা যার শিক্ষা তার’ এই নীতিতে সাধারণ ঘরের সন্তানদের শিক্ষা থেকেই বঞ্চিত করার ছক তৈরি করেছে কেন্দ্র-রাজ্য উভয়েই। হাসপাতাল কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উভয় ক্ষেত্রকেই বেসরকারি মালিকদের কাছে বেচে দেওয়ার চেষ্টায় নেমেছে কেন্দ্র-রাজ্য দুই সরকারই। জনজীবনের এমন কোনও ক্ষেত্র নেই যেখানে মানুষ একটু স্বস্তি পেতে পারে। বাজারে গেলে দামের ছ্যাঁকা, ওষুধ কিনতে গেলে দামের বহরে মাথায় হাত। চাষি বীজ-সার-বিদ্যুতের দামে বিপর্যস্ত। অথচ উৎপাদিত ফসল বেচতে গেলে চাষি দাম পাচ্ছে সামান্যই, লাভ দূরে থাক খরচটাই উঠছে না। বিদ্যুতের মতো অত্যাবশকীয় পরিষেবার মূল্য নানা অজুহাতে শুধু যে বাড়ছে তাই নয়, বিদ্যুতের পরিষেবাকে পুরোপুরি একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের কাছে বেচে দেওয়ার জন্য নানা আইন করে চলেছে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার। স্মার্ট মিটারের নামে বিদ্যুৎগ্রাহকদের লুঠ করবার পরিকল্পনা চলছে। বেকারত্বের হার সর্বকালের রেকর্ড ছাপিয়ে যাচ্ছে বার বার। এতেই শেষ নয়, সরকারি-বেসরকারি কাজে লক্ষ লক্ষ অস্থায়ী কর্মী, অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মী, পণ্য ডেলিভারি ও পরিবহণের অ্যাপভিত্তিক কোম্পানিগুলোতে কর্মরত গিগ কর্মী, আশাকর্মী, স্কিম ওয়ার্কার এদের কারও চাকরির কোনও স্থিরতা নেই। নেই উপযুক্ত এবং সুনির্দিষ্ট বেতনের নিশ্চয়তা, সামাজিক সুরক্ষা। শ্রম কোডের নামে শ্রমিকদের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিচ্ছে সরকার। সমস্ত কিছু মিলিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ বারবার ফেটে পড়তে চেয়েছে বিক্ষোভে। কিন্তু পথ পায়নি। অভয়া আন্দোলন সেই পথ খুলে দিয়েছে। যে কারণে ১৪ আগস্ট মেয়েদের রাত দখলের ডাক সমস্ত মানুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ডাকে পরিণত হতে পেরেছে।

নাগরিকদের নিজস্ব পরিসরে চলতে চলতেই আন্দোলন আজ এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে সমস্ত ক্ষেত্রে চলা আন্দোলনগুলিকে একটা বৃহত্তর রূপ দেওয়ার প্রয়োজন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এই আন্দোলন কোনও দলের সরকারি গদি দখল কিংবা আর এক দলের গদি বাঁচানোর প্রতিযোগিতায় হারজিতের প্রশ্নকে সামনে রেখে পরিচালিত নয়। এর লক্ষ্য দাবি আদায়ের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের নিজস্ব রাজনৈতিক হাতিয়ার গণকমিটির সক্রিয় ভূমিকা প্রতিষ্ঠা করা। ২১ জানুয়ারির মহামিছিলে পথ হাঁটা অধিকাংশ মানুষ কোনও না কোনও ভাবে সারা বছর ধরে এই আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে থেকেছেন। তাঁরা কেউ একদিন মিছিলে হেঁটে গা গরম করতে আসেননি। সারা বছর ধরেই তাঁদের কেউ ব্লকের প্রশাসনকে চাপ দিয়েছেন কৃষকের সমস্যা সমাধানে, গ্রামের রাস্তা-পানীয় জল-১০০ দিনের কাজ নিয়ে। এলাকায় আবাস দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে তাঁরাই ছিলেন মুখ্য ভূমিকায়। অভয়া আন্দোলনকে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়েছেন তাঁরাই। এই মিছিলে হাঁটা আশা-অঙ্গনওয়াড়ি-মিড ডে মিল কর্মীরা তাঁদের কঠিন কর্তব্য পালনের ফাঁকেই স্কিম ওয়ার্কারদের আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিয়েছেন জেলায় জেলায়। এসেছেন সংগঠিত-অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা যাঁরা সারা বছর ধরে শ্রমিকের অধিকার হরণের মালিকি চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। এই মিছিলে পা মেলানো ছাত্র কর্মীরা নানা জেলায় স্কুলে অতিরিক্ত ফি নেওয়া রুখতে যেমন তৎপর থেকেছেন, তেমনই বিজেপি সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি ও তারই কার্বন কপি রাজ্যের তৃণমূল সরকারের শিক্ষানীতির সর্বনাশা দিক নিয়ে জেলায় প্রচারের ঝড় তুলেছেন। একটার পর একটা আন্দোলন করে চলা বিদ্যুৎগ্রাহক কর্মীরাও এসেছেন ২১-এর মিছিলে পা মেলাতে।

এই মানুষগুলি দিনের পর দিন মহামিছিল সফল করবার আহ্বান ছড়িয়ে দিয়েছেন পাড়ায় পাড়ায়, ঘরে ঘরে। হাটে-বাজারে-গঞ্জে। রেলস্টেশন-বাসস্ট্যান্ডে রাস্তার মোড়ে মোড়ে মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন লক্ষ লক্ষ প্রচারপত্র। মাইক প্রচারে, পোস্টার-ফ্লে’-দেওয়াল লিখনে ভরিয়ে দিয়েছেন এলাকা। শহরের বস্তি, পাড়া-মহল্লা, গ্রামের হাটে-পাড়ার মধ্যে সংগঠিত করেছেন অসংখ্য গ্রুপ বৈঠক। মানুষ মন প্রাণ দিয়ে গ্রহণ করেছেন মহামিছিলের আমন্ত্রণ। বলেছেন, অবশ্যই পা মেলাব এই মিছিলে– এ তো আমারই দাবি, আমারই বুকের যন্ত্রণা প্রতিকারের দাবিই সোচ্চারে তুলে ধরার মিছিল। সাধারণ মানুষ উদার হাতে আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন এই মিছিলের জন্য। উজাড় করা সেই প্রত্যাশা পূরণের অঙ্গীকার বহন করেছে এই মহামিছিল।

২১ জানুয়ারি, পৃথিবীর বুকে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রথম সফল রূপকার মহান নেতা লেনিনের মৃত্যুর ১০২তম দিবস অতিক্রান্ত হল এই দিনেই। নিছক একটি দিন পেরিয়ে যাওয়া নয়, ২১ জানুয়ারির মিছিলে জড়িয়ে থেকেছে দিন বদলের স্বপ্ন। লেনিনের শিক্ষাকে এ দেশের বুকে বিশেষীকৃতভাবে প্রয়োগ করতে গিয়ে মহান নেতা শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছিলেন, গণআন্দোলন যদি এই অসুস্থ সমাজটাকে বদলের স্বপ্ন মানুষকে না দেখাতে পারে তা হলে কোনও প্রতিবাদ, কোনও আন্দোলনই তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। আজকের সমাজে অভয়াদের বিচার অধরা থাকে, দুর্নীতিবাজ, খুনি, খুনের মদতদাতারা, ধর্ষকরা সরকারি ক্ষমতাধর দলের আশ্রয় পায়। সমাজের এই দুর্বিষহ অবস্থায় বিচার চাইবার স্লোগানে, দৃঢ়পণ আন্দোলনে কিছু দাবি আদায় হতেও পারে, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ জয় অধরাই থেকে যায়। তা পেতে হলে এই সমাজটাকে বদলে নতুন সমাজকাঠামোর জন্য লড়াইটাকে জড়িয়ে নিতে হবে আন্দোলনের ধারার সাথে। আর সেই পথের দিশারি হলেন মহান নেতা লেনিন। আন্দোলনে দাঁড়িয়ে যে মানুষগুলো স্লোগানে গলা মোলাচ্ছেন, তাঁরা যদি রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গিটাকে স্বচ্ছ করার চেষ্টায় না নামেন, কোন শক্তি তাঁদের গদি দখলের খেলায় দাবার ঘুঁটিতে পরিণত করতে চাইছে, আর কোন শক্তি চাইছে তাদের দিন বদলের পথে নিয়ে যেতে, তা চিনবার চোখ তৈরি করার চেষ্টা না করেন তা হলে মানুষকে বারে বারে ঠকতে হবে। এই শিক্ষাই দিয়ে যান লেনিন ও তাঁর উত্তরসাধকরা।

রাজনীতির এই দিশা চেনার পাঠ ২১ জানুয়ারির মিছিলে ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নাগরিক আন্দোলনকে দখল না করে রাজনীতির ঠিক-বেঠিক চিনিয়ে দেওয়ার অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে পেরেছে বলেই ২১ জানুয়ারির মিছিলে দেখা মিলেছে এমন বহু জনের যাঁরা কোনও দিন আগে কোনও রাজনৈতিক দলের ডাককে নিজের ডাক বলে মনে করেননি। এ বার তাঁরা এই ডাকের মধ্যে পেয়েছেন, নিজেদের শক্তির সন্ধান– তাই এসেছেন দলে দলে।

এই মিছিলকে আরও এগিয়ে নিয়ে চলার দায়িত্ব বুকে নিয়েই তাঁরা নিজের এলাকায়, নিজের ঘরে ফিরেছেন। মিছিলের কাজ কিন্তু শেষ হয়নি। ন্যায়বিচার শুধু নয়, সমাজে যথার্থ ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই মিছিল এগিয়ে চলেছে অবিচল।